ঢাকা: রাজধানীর দক্ষিণখান থানাধীন আইনুসবাগ (চাঁদনগর) এলাকায় প্রকাশ্য দিবালোকে আব্দুর রশিদকে (৩৮) নামে এক ব্যক্তিকে গুলি করে হত্যার ঘটনায় পৃথক দুটি মামলা দায়ের করা হয়েছে।
ভুক্তভোগীর পরিবার বাদী হয়ে একটি হত্যা মামলা এবং পুলিশ বাদী হয়ে একটি অস্ত্র মামলা দায়ের করেছে।
হত্যা মামলার এজাহারে জাপানি হান্নানসহ ১৩ জনের নামোল্লেখ করা হয়েছে। এছাড়াও মামলায় আরও ৫ জনকে অজ্ঞাতপরিচয় আসামি করা হয়েছে। এদের মধ্যে ৮ জন গ্রেফতার করা হয়েছে। গ্রেফতারকৃতরা হলেন-মূলহোতা আমিনুল ইসলাম হান্নান ওরফে জাপানি হান্নান ওরফে সাইনবোর্ড হান্নান, মো. একরামুল ইসলাম, শফিকুল ইসলাম ইমরান, আল-আমিন প্রধান, জহুরুল ইসলাম রিপন, খোরশেদ আলম, মো. মোশাররফ হোসেন ও মো. নুরুন নবী।
বুধবার (২৫ মার্চ) দিনগত রাতে নিহত আব্দুর রশিদের ভাই হারুন-অর রশিদ বাদী হয়ে দক্ষিণখান থানায় হত্যা মামলাটি দায়ের করেন।
এদিকে এ হত্যাকাণ্ডে জাপানি হান্নানের লাইসেন্স করা শর্টগান ব্যবহার করেছে। পুলিশ ঘটনাস্থলে গিয়ে হান্নানের হেফাজত থেকে একটি শর্টগান ও একটি পিস্তল উদ্ধার করে। এ বিষয়ে পুলিশ বাদী হয়ে অস্ত্র আইনে পৃথক আরও একটি মামলা দায়ের করেন।
বৃহস্পতিবার (২৫ মার্চ) বেলা সাড়ে ১১টার দিকে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) উত্তরা বিভাগের দক্ষিণখান জোনের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার (এডিসি) হাফিজুর রহমান রিয়েল বাংলানিউজকে বিষয়টি নিশ্চিত করেন।
তিনি বলেন, হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় বুধবার দিনগত রাতে নিহত রশিদের ভাই বাদী হয়ে থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেছে। এছাড়াও পুলিশ বাদী হয়ে অস্ত্র আইনে পৃথক আরও একটি মামলা দায়ের করেছে। বুধবার দুপুরে ঘটনাস্থল থেকে জাপানি হান্নানসহ তার ৮ সহযোগীকে আমরা গ্রেফতার করেছি। হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট হান্নানের আরও কয়েকজন সহযোগী পলাতক রয়েছেন। তাদের গ্রেফতারে পুলিশের অভিযান অব্যাহত রয়েছে।
এদিকে দক্ষিণখান থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) শিকদার মোহাম্মদ শামীম বাংলানিউজকে বলেন, গ্রেফতার ৮ আসামিকে বৃহস্পতিবার সকালে আদালতে পাঠানো হয়েছে। মামলাটি এখন তদন্তাধীন রয়েছে।
এর আগে বুধবার (২৪ মার্চ) বেলা সাড়ে ১১টার দিকে দক্ষিণখানের আইনুসবাগ (চাঁদনগর) এলাকার বালি ফেলাকে কেন্দ্র করে প্রকাশ্য দিবালোকে আব্দুর রশিদ নামে এক ব্যক্তিকে গুলি করে হত্যা করেন জাপানি হান্নান। নিজ জমিতে বালু ফেলাকে কেন্দ্র করে হান্নান তার লাইসেন্সকৃত শর্টগান দিয়ে রশিদ ও সোহেলকে লক্ষ্য করে গুলি চালায়। ঘটনাস্থলে রশিদ মারা যায়। এতে স্থানীয়রা ক্ষুব্ধ হয়ে জাপানি হান্নানের গাড়ি আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দেয়। ঘটনার সময় ঘটনাস্থলে উপস্থিত ছিলো পুলিশ। এরপর জাপানি হান্নানের বাড়ি জাপানি কটেজ থেকে অস্ত্রধারী হান্নানসহ ৮ জনকে গ্রেফতার করে দক্ষিণখান থানা পুলিশ। পরে ঘটনাস্থল থেকে নিহত আব্দুর রশিদের মরদেহ উদ্ধার করে প্রথমে দক্ষিণখানের কেসি হাসপাতাল এবং পরে সেখান থেকে সোহরাওয়ার্দী মেডিক্যাল মর্গে পাঠায় পুলিশ।
পুলিশ বলছে, এ ঘটনায় আসামি জাপানি হান্নানসহ তার ৬ সহযোগীকে গ্রেফতার করা হয়েছে। হত্যাকাণ্ডে ব্যবহৃত একটি শর্টগান ও একটি পিস্তল জব্দ করা হয়েছে। দুটিই হান্নানের লাইসেন্স করা অস্ত্র। পুলিশ ঘটনাটি তদন্ত করছে।
নিহত আব্দুর রশিদ থাকতেন রাজধানীর আশকোনার পানির পাম্পের পাশে ৪৩৪ নম্বর নিজ বাড়িতে। পরিবারে তার স্ত্রী, দুই সন্তান (এক ছেলে ও এক মেয়ে) রয়েছে। আগে তিনি গার্মেন্টস এক্সেসরিজের কারখানা পরিচালনা করতেন। সেটি বন্ধ করে তিনি বর্তমানে তার বাড়ি ও মার্কেট দেখাশোনা করতেন।
ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী স্থানীয় বাসিন্দা মোজাম্মেল পাটোয়ারী বাংলানিউজকে বলেন, লোকগুলো জাপানি হান্নানের বাড়ির সামনে এলেই ভবনের ভেতরে গ্যারেজ থেকে হান্নান তার শর্টগান দিয়ে প্রথমে একটি গুলি করে। গুলিটি রশিদের মাথায় লাগে। এরপর আরও একটি গুলি চালায়, সেটি তার বুকে লাগে। রক্তাক্ত অবস্থায় রশিদ মাটিতে পড়ে যায়। এলাকার সবার সামনে হান্নান গুলি করে এভাবে মানুষ হত্যা করেছে।
দক্ষিণখান এলাকার স্থানীয়দের অভিযোগ, জাপানি হান্নানের অত্যাচারে দক্ষিণখান এলাকার মানুষ অতিষ্ঠ। তিনি নিজের জোর খাটিয়ে অস্ত্রের ভয়ভীতি দেখিয়ে এতদিন মানুষের ওপর অত্যাচার করে এসছে। এবার মানুষ হত্যা করেছে। আমরা এর থেকে পরিত্রাণ চাই। রাজনৈতিকভাবে কোনো পরিচয় ও পদবী না থাকলেও সবখানে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের নাম ভাঙিয়ে চলতেন জাপানি হান্নান। জাতির পিতা, প্রধানমন্ত্রীসহ সরকারের উচ্চ পর্যায়ের নেতাদেরর ছবির সঙ্গে নিজের ছবিটি জুড়ে দিয়ে বাড়ির সামনে একটি সাইনবোর্ডে ঝুলিয়ে রেখেছেন। লাইসেন্স করা একটি শর্টগান ও একটি পিস্তল ও কয়েখজন সাঙ্গোপাঙ্গ নিয়ে দানবের মত ঘোরাঘুরি করতেন এলাকায়। পান থেকে চুন খসলেই সঙ্গে থাকা অস্ত্র বের করে সাধারণ মানুষকে ভয়ভীতি দেখানো ছিলো জাপানি হান্নানের নিত্য দিনের কাজ। শুধু তাই নয়, এলাকায় চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, মাদকের কারবারসহ নানা অপকর্মেই সরাসরি জড়িত রয়েছেন আমিনুল ইসলাম হান্নান ওরফে জাপানি হান্নান ওরফে সাইনবোর্ড হান্নান।
অপকর্মের মাধ্যমে ধীরে ধীরে এলাকায় নিজের আধিপত্য ও প্রভাব বিস্তার করে জাপানি হান্নান। নিজ জেলা চাঁদপুরের সঙ্গে মিল রেখে দক্ষিণখানের আইনুসবাগ এলাকার নাম পরিবর্তন করে চাঁদনগর নামকরণ করেন তিনি। কেউ এই নাম না লিখলে বা ব্যবহার না করলে হুমকি-ধামকি দিতেন তিনি। আইনুসবাগ (চাঁদনগর) এলাকায় জমি কেনা, বাড়ি নির্মাণ, কিনবা বিদ্যুৎ, গ্যাস ও পানিরসহ দোকান নির্মাণ করতে চায় তবে সেখানেই চাঁদা দাবি করতেন জাপানি হান্নান। চাঁদা না দিলে তার সাঙ্গোপাঙ্গ দিয়ে বাধা দেওয়াসহ মারধর ও অস্ত্র দেখিয়ে হত্যার হুমকি দিতেন ওই হান্নান।
যা ঘটে ছিলো:
ভুক্তভোগী আব্দুর রশিদের চাচাতো ভাই মাহমুদুল হাসান সুজন বাংলানিউজকে বলেন, দক্ষিণখান আইনুসবাগ এলাকায় জাপানি হান্নানের বাড়ি থেকে তিন’শ গজ দূরে আমাদের জমিতে গত এক সপ্তাহ ধরে বাউন্ডারির কাজ চলছে। সেখানে বালু ফেলা হয়। এই বালু ফেলাকে কেন্দ্র করে জাপানি হান্নান ১ লাখ টাকা চাঁদা দাবি করেন। আমরা দিতে রাজি হইনি। এই কারণে আমাদের জায়গা থেকে বালু চুরি করে সরিয়ে নেয় জাপানি হান্নানসহ তার লোকজন। এই নিয়ে (বুধবার, ২৪ মার্চ) সকালে আমার ভাই ও বোনদের মারধর করে হান্নান বাহিনী।
কেন মারধর করলো? এই বিষয়টি জানতে ও জিজ্ঞাসা করতেই আমার চাচা হাজী আব্দুস সাত্তার, চাচাতো ভাই আব্দুর রশিদ, সোহলে ও আমিসহ হান্নানের কাছে গিয়েছিলাম। বিষয়টি দক্ষিণখান থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে অবগত করা হয়েছিলো। সঙ্গে প্রশাসনের লোকও (পুলিশ) ছিলো। আমরা যখন হান্নানের বাড়ির সামনে যাই, তখন জাপানি হান্নান তার শর্টগান বের করে বাড়িরে গেটের ভেতর থেকে আমার চাচাতো ভাই সোহেল ও আব্দুর রশিদকে লক্ষ্য করে গুলি চালায়। এতে সোহেল সরে গেলেও রশিদের মাথায় গুলি লাগে। সঙ্গে সঙ্গে রশিদ ভাই মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। আমরা ভাইকে ধরতে যাবো, এমন সময় হান্নান আরও ফায়ার (গুলি চালায়)। ঘটনাস্থলেই আমার চাচাতো ভাই আব্দুর রশিদ মারা যান। এরপর স্থানীয়রা ও আমরা হান্নানসহ তার বাহিনীকে ঘিরে ফেলি। যাতে পালাতে না পারে। পরে পুলিশ তাদের নিরস্ত্র করে গ্রেফতার করে।
বাংলাদেশ সময়: ১৬৪৮ ঘণ্টা মার্চ ২৫, ২০২১
এসজেএ/এএটি