ঢাকা, শুক্রবার, ৯ মাঘ ১৪৩১, ২৪ জানুয়ারি ২০২৫, ২৩ রজব ১৪৪৬

জাতীয়

সচিব পরিচয়ে অঢেল সম্পদের মালিক!

স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৬৩৬ ঘণ্টা, অক্টোবর ৯, ২০২১
সচিব পরিচয়ে অঢেল সম্পদের মালিক!

ঢাকা: আব্দুল কাদের মাঝির শিক্ষাগত যোগ্যতা দশম শ্রেণি পর্যন্ত। কিন্তু প্রতারণামূলকভাবে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের আইডি কার্ড বানিয়ে, ভিজিটিং কার্ড ছাপিয়ে, গাড়িতে স্টিকার ও ফ্ল্যাগস্ট্যান্ড লাগিয়ে নিজেকে জাহির করেন তিনি অতিরিক্ত সচিব আব্দুল কাদের চৌধুরী ওরফে চৌধুরী সাহেব।

 

রাজধানীর গুলশানের জব্বার টাওয়ারে ছয় হাজার স্কয়ার ফিটের একটি কার্যালয় রয়েছে তার। এছাড়া কারওয়ান বাজারে তার রয়েছে আরেকটি কার্যালয়। তিনি মিরপুর ৬ নম্বর সেক্টরে বসবাস করেন। গুলশান ও মিরপুরে তার একাধিক ফ্ল্যাটও রয়েছে। গাজীপুরে নয় তলা বিশিষ্ট একটি বাড়ি ও গাজীপুরের পূবাইলে একটি বাগান বাড়ি রয়েছে তার।

ঢাকায় আব্দুল কাদের অতিরিক্ত সচিব সেজে কোটি টাকার বেশি মূল্যের গাড়িতে চড়েন। গাড়ির সামনে-পেছনে কাঁচে লাগানো বাংলাদেশ সচিবালয় স্টিকার এবং ফ্ল্যাগস্ট্যান্ড।

অঢেল সম্পত্তির মালিক ভূঁইফোড় আব্দুল কাদেরের বৈধ কোনো আয় নেই। বিভিন্ন মানুষকে কোটি টাকার ব্যাংক লোন পাইয়ে দেওয়া ও মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন কাজের ওয়ার্ক অর্ডার পাইয়ে দেওয়ার মাধ্যমে প্রতারণা করে আসছিলেন তিনি। মূলত দীর্ঘ ১৪ বছর ধরেই এসব প্রতারণা, ধাপ্পাবাজি, চাপাবাজি করে অঢেল সম্পত্তির মালিক হয়েছেন এই প্রতারক।

সম্প্রতি ভুক্তভোগীদের অভিযোগের ভিত্তিতে রাজধানীর কারওয়ান বাজার, মিরপুর এবং গুলশানে ধারাবাহিক অভিযান চালিয়ে প্রতারক আবদুল কাদের মাঝি ওরফে চৌধুরী ও তার দ্বিতীয় স্ত্রী শারমিন চৌধুরী ছোঁয়াসহ দুই সহযোগীকে গ্রেফতার করে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) গোয়েন্দা (ডিবি) বিভাগের উত্তর বিভাগ। গ্রেফতার দুই সহযোগী হলেন- আব্দুল কাদেরের সততা প্রপার্টিজের ম্যানেজার শহিদুল আলম এবং অফিস সহায়ক আনিসুর রহমান।


অভিযানে আব্দুল কাদেরের মিরপুরের বাসা থেকে মন্ত্রণালয়ের স্টিকার যুক্ত প্রাডো গাড়ি ও অতিরিক্ত সচিবের ভুয়া আইডি কার্ড, ভিজিটিং কার্ড এবং তার কোমরে থাকা একটি অবৈধ বিদেশি পিস্তল, একটি ম্যাগজিন ও এক রাউন্ড গুলি জব্দ করা হয়।

শনিবার (৯ অক্টোবর) দুপুরে ডিএমপি মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানান ডিবির অতিরিক্ত কমিশনার এ কে এম আফিজ আক্তার।

তিনি বলেন, আব্দুল কাদের গুলশান এক নম্বরের জব্বার টাওয়ারের প্রায় ছয় হাজার স্কয়ার ফিট আয়তনের একটি অফিসে বসতেন। স্টিকার যুক্ত গাড়িতে করে তিনি প্রায় সচিবালয়ে ঢুকতেন। অতিরিক্ত সচিব পরিচয়ে মানুষদের সঙ্গে প্রতারণা করে অঢেল সম্পদের মালিক হয়েছেন তিনি।


তিনি বলেন, খোঁজ নিয়ে আমরা জানতে পারি। মিরপুর ৬ নম্বরে বসবাস করতেন তিনি।

গুলশানের অফিস ছাড়াও তার কারওয়ান বাজারে অফিস রয়েছে। এছাড়া গুলশান ও মিরপুরে একাধিক ফ্ল্যাট রয়েছে তার। গাজীপুরের বোর্ডবাজারে নবম তলা বিশিষ্ট বাড়ি কিনেছেন ও গাজীপুরের পূবাইলে আট বিঘা জমিতে রয়েছে তার বাগানবাড়ি।

ডাচ বাংলা ব্যাংক, মার্কেন্টাইল ব্যাংক, আইএফআইসি ব্যাংক, সোনালী ব্যাংক ও সিটি ব্যাংকসহ আরও কয়েকটি ব্যাংকে অ্যাকাউন্ট রয়েছে তার। এসব অ্যাকাউন্টে লাখ লাখ টাকাও রয়েছে।


তিনি আরও বলেন, ঠিকাদার জি কে শামীম গ্রেফতার হওয়ার আগে প্রতারক আব্দুল কাদের গানম্যান নিয়ে চলাফেরা করতেন। এখন গানম্যান নিয়ে চলাফেরা করা অসুবিধাজনক হওয়ায় তিনি নিজেই অস্ত্র এবং ওয়াকি টকি নিয়ে চলেন বলে প্রাথমিকভাবে জানিয়েছেন।

আব্দুল কাদেরের প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে রয়েছে- ঢাকা ট্রেড করপোরেশন, জমিদার ট্রেডিং, সামীন এন্টারপ্রাইজ, চৌধুরী গ্রুপ, হিউম্যান ইমপ্রুভমেন্ট ফাউন্ডেশন, সততা প্রোপার্টিজ, ডানা লজিস্টিকস ও ডানা মটর্স ইত্যাদি।

প্রতারক আব্দুল কাদের বড় রকমের প্রতারণা করেন হিউম্যান ইমপ্রুভমেন্ট ফাউন্ডেশনের ‘একটি বাড়ি একটি খামার প্রকল্পের’ মাধ্যমে। ২০০৪-২০০৬ সালে দেশের শত, শত মানুষের কাছ থেকে সরকারি অনুদানে বাড়ি এবং খামার তৈরির নামে হাতিয়ে নিয়েছে কোটি কোটি টাকা।

প্রতারণার কৌশল:

হাফিজ আক্তার বলেন, বিভিন্ন ব্যাংক থেকে ২০ কোটি তদুর্ধ টাকার লোন পাইয়ে দেওয়ার নামে প্রতারণা। এক্ষেত্রে তার মার্কেটিংয়ের লোকজন বিভিন্ন ঠিকাদার এবং ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে গিয়ে অ্যাডভার্টাইজমেন্ট করতেন। সম্ভাব্য মক্কেলদের কাছ থেকে প্রথমেই প্রতারক আব্দুল কাদের ৫০ হাজার টাকা কনসালটেন্সি ফি নিতেন। প্রোফাইল বানানোর জন্য নিতেন দুই থেকে ১০ লাখ টাকা। ২০ কোটি বা তদুর্ধ অঙ্কের লোন পাইয়ে দিতে ডাউনপেমেন্ট হিসেবে ৫ থেকে ১০ শতাংশ হারে টাকা নিতেন মক্কেলদের কাছ থেকে। পরবর্তীতে কাউকে লোন করিয়ে দিতে না পারলেও হাতিয়ে নেওয়া লাখ লাখ টাকার অংশবিশেষ দিয়ে ঋণ হিসেবে দিতেন।

এদিকে, বাংলাদেশ সেনাবাহিনী, সরকার পরিচালিত বিভিন্ন প্রজেক্টের শত শত কোটি টাকার ঠিকাদারি পেয়েছেন বলে ভুয়া কাগজপত্র তৈরি করতেন কাদের এবং সেগুলোর বিপরীতে বিভিন্ন ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের কাছে ওয়ার্ক অর্ডার বিক্রি করতেন। তাছাড়া ঠিকাদারদের কাছ থেকে বড় অঙ্কের টাকা জামানত রেখে দিতো যেগুলো দিয়ে আবার তিনি প্রতারণা করতেন।



তার আরও কৌশল হলো- তিনি বিভিন্ন সরকারি ব্যাংকে চাকরি দেওয়ার নাম করে বিপুল সংখ্যক মানুষের কাছ থেকে টাকা-পয়সা হাতিয়ে নিয়েছেন।

এছাড়াও সততা প্রপার্টিজের নামে তিনি জমি এবং স্থাপনা ক্রয় করার জন্য নামে মাত্র কিছু টাকা বায়না দিয়ে চুক্তি সম্পাদন করে যেগুলো দিয়ে পরবর্তীতে মানুষকে নানাভাবে হয়রানি করে টাকা আদায় করে থাকেন। এই কাজগুলো করার জন্য আব্দুল কাদের নিজেকে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে দায়িত্ব পালন শেষে বর্তমানে অতিরিক্ত সচিব জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় হিসেবে পরিচয় দেন। তিনি গর্ব করে বলেন বিভিন্ন বাহিনী এবং প্রশাসনের বিভিন্ন স্তরে তার সহকর্মী, বন্ধু এবং অনুজরা কর্মরত থাকায় কেউ তার কিছু করতে পারবেন না।

তিনি বলেন, প্রতারক আব্দুল কাদের নিজেকে ধনকুবের প্রিন্স মুসা বিন শমসেরের নিয়োগ প্রাপ্ত লিগ্যাল অ্যাডভাইজার হিসেবে দাবি করেন। এ পরিচয় দিয়ে টাকা পয়সা কোনো ব্যাপার না বলে চাকরিপ্রার্থী ও ব্যবসায়ী এবং ঠিকাদারদের সঙ্গে প্রতারণা করতেন।

আব্দুল কাদের ও তার স্ত্রী এবং সাঙ্গোপাঙ্গোদের নামে পল্লবী থানায় অস্ত্র মামলা, তেজগাঁও থানায় প্রতারণার মামলা হয়েছে। এর আগেও তার বিরুদ্ধে পাসপোর্ট জালিয়াতি, বিভিন্ন প্রতারণার, ব্যাংকে নিয়োগ বিষয়ে কমপক্ষে অর্ধ ডজন মামলা দায়ের হয়েছিল। গ্রেফতার চার আসামি রিমান্ডে রয়েছেন। তাদের জিজ্ঞাসাবাদ চলছে বলেও জানান অতিরিক্ত কমিশনার হাফিজ আক্তার।

বাংলাদেশ সময়: ১৬৩৬ ঘণ্টা, অক্টোবর ০৯, ২০২১
এসজেএ/আরআইএস

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।