টাঙ্গাইল: টাঙ্গাইলে ২৮ লাখ টাকা বিভিন্ন কর্তাব্যক্তিকে মাসোহারা দিয়ে অবৈধ বালুর ঘাট ‘বৈধ’ করা হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে ঘাট মালিকদের বিরুদ্ধে।
জেলার সবচেয়ে বড় বালুর ঘাট হচ্ছে ভূঞাপুর উপজেলার গোবিন্দাসী এলাকায়।
গোবিন্দাসী এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, প্রায় চার কিলোমিটার এলাকা জুড়ে মাসুদ মেম্বার, ভাবি (ভাবির ঘাট নামে পরিচিত), নুহু মেম্বার, পাভেল, দুলাল চকদারসহ ১৮টি বালুর ঘাট রয়েছে এখানে। এর মধ্যে প্রতিদিন সকাল ৬টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত পর্যায়ক্রমে তিনটি করে বালুর ঘাট চালু রাখা হয়। প্রতিদিন তিনটি ঘাট থেকে প্রায় ৭০০/৮০০ ট্রাক বালু বিক্রি হয়ে থাকে। আর এসব ট্রাক থেকে বালুর মূল্য ছাড়াও অতিরিক্ত দুইশ’ টাকা করে আদায় করা হয়। আর প্রতিদিনের আদায়কৃত অতিরিক্ত টাকা একজনের কাছে জমা রাখা হয়। মাস শেষে জমানো সেই টাকা থেকে ২৮ লাখ টাকা স্থানীয় প্রশাসন, রাজনৈতিক নেতাসহ বিভিন্ন উচ্চ পর্যায়ের ব্যক্তিদের মধ্যে বন্টন করা হয় বলে অভিযোগ রয়েছে। অভিযোগ রয়েছে, আর এ বন্টনের তদারকি করেন বালুর ঘাটের মালিক মুস্তাফিজুর রহমান পাভেল ও মাসুদ মেম্বার।
জানা যায়, রহমান মাস্টার ও সাবেক চেয়ারম্যান আমিনুলের গোবিন্দাসী মাছ বাজার ঘাট বালুর ঘাট, মাটিকাটা, পাটিতাপাড়া, কোনাবাড়ি, চিতুলিয়াপাড়া, ভালকুটিয়ায় দুলাল হোসেন চকদার, আব্দুর রাজ্জাক এবং কালাম মেম্বারসহ আরো তিনজনের ঘাট, পুনর্বাসন এলাকায় আব্দুল মতিনের দুইটি, ভাবির ঘাট, সিরাজকান্দিতে মাসুদ মেম্বার ও পাভেলসহ চারটি।
ট্রাকচালক মোকাদ্দেস মিয়া জানান, আগে বালুর দাম ট্রাক প্রতি তিন হাজার ৮০০ টাকা নেওয়া হতো। কিন্তু বর্তমানে অতিরিক্ত আরো দুইশ টাকা নেওয়া হচ্ছে। তবে এ টাকার ভাগ ট্রাকমালিক সমিতি, শ্রমিক সমিতি, মালিক-শ্রমিক ঐক্য পরিষদ পেলেও অন্য কেউ পাচ্ছেন কি না, তা তিনি জানেন না।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে বালুর ঘাটের এক মালিক জানান, তারা এ বালু সিরাজগঞ্জের সরকারি ইজারাকৃত ঘাট থেকে কিনে এনে এখান থেকে বিক্রি করেন। কিন্তু বর্ষা মৌসুম শেষ হওয়ার পর অতিরিক্ত লাভের আশায় এখান থেকে (গোবিন্দাসী) বালু উত্তোলন করে কিনে আনা সিরাজগঞ্জের বালুর সঙ্গে মিশিয়ে বিক্রি করা হয়। তবে সিরাজগঞ্জ থেকে কিনে আনা এবং এখান থেকে উত্তোলনকৃত বালু একই, কোনো পার্থক্য নেই। শুধু খরচ বাঁচানোর জন্য এ পদ্ধতি। আর এ কারণেই দীর্ঘ কয়েক বছর ধরে হওয়া এ বালুর ঘাট থেকে প্রতিমাসেই মাসোহারা দিতে হয়। তা না হলে প্রশাসন মাঝে মধ্যে অভিযান চালিয়ে বন্ধ করে দেয় এবং ঘাটে যাদের পায়, তাদের জরিমানা বা কারাদণ্ড দেয়। আবার রাজনৈতিক প্রভাব তো আছেই। আগে প্রতিমাসে ১৮টি বালুর ঘাট থেকে ১১ লাখ টাকা মাসোহারা দিতে হতো। কিন্তু বর্তমানে তা বাড়িয়ে ২৮ লাখ টাকা দেওয়া হয়। তাই সেই টাকা ওঠানোর জন্য বালুর দামের সঙ্গে ট্রাক প্রতি ২০০ টাকা করে অতিরিক্ত রাখা হয়। এছাড়া বালুর দামও সিএফটি প্রতি ৪০ পয়সা করে বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে।
গোবিন্দাসী এলাকার প্রবীণ ব্যক্তি আলী আহসান মিয়া জানান, ক্ষমতার দাপট দেখিয়ে যমুনা সংলগ্ন গোবিন্দাসীতে প্রথমে দুই/তিনটি বালুর ঘাট স্থাপন করা হয়। আস্তে আস্তে ঘাটের সংখ্যা বাড়তে থাকে। সেই সঙ্গে বাড়ে সহিংসতা। এ বালুর ঘাট পরিচালনা নিয়ে কয়েক বছরে বেশ কয়েকটি হত্যার ঘটনাও ঘটেছে। ঘাট মালিকরা নামে মাত্র দামে ওপার থেকে (সিরাজগঞ্জ) বালু কিনে আনেন। এছাড়া বেশিরভাগ বালু গোবিন্দাসী এলাকা থেকেই উত্তোলন করা হয়। ফলে প্রতি বর্ষা মৌসুমে ভূঞাপুর উপজেলার শুধু গোবিন্দাসী এলাকায় নদী ভাঙন বেশি দেখা দেয়। বালু উত্তোলনে বাধা দিলেই রাতে দেওয়া হয় হত্যার হুমকি। তারপরও তিনি কয়েকবার প্রতিবাদ করেছেন, কিন্তু কোনো লাভ হয়নি। তাই বাধ্য হয়ে এখন শুধু চেয়ে চেয়ে দেখে যাচ্ছেন।
ঘাট মালিক দুলাল হোসেন চকদার জানান, আগে ১৮টি ঘাট ছিল, কিন্তু বর্তমানে ১৪টি বালুর ঘাট চালু রয়েছে। আর এসব ঘাটে প্রতি ট্রাক থেকে যে অতিরিক্ত টাকা নেওয়া হয়, সেটা মালিক ও শ্রমিক সমিতি (ট্রাক) নিয়ে থাকে। তবে ২৮ লাখ টাকার মাসোহারার বিষয়টি নিয়ে তিনি কথা বলতে অপারগতা প্রকাশ করেন।
তবে আরেক ঘাট মালিক মাসুদ মেম্বার জানান, আগে প্রতিমাসে ১১ লাখ টাকা সম্মানি (মাসোহারা) দিতে হতো কিন্তু বর্তমানে সেটি ২৮ লাখ টাকা দিতে হয়। কিন্তু কোথায় কোথায় দেওয়া হয়, সেটি বলতে নারাজ তিনি।
টাঙ্গাইল জেলা ট্রাক শ্রমিক সমিতির সভাপতি কোরবান আলী জানান, তারা কোনো বালুর ঘাটের ট্রাক থেকে টাকা নেন না। তবে তারা মাঝে মধ্যে সেখানে গিয়ে ঘাট মালিকদের খোঁজ করেন।
এ বিষয়ে ভূঞাপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ইশরাত জাহান বাংলানিউজকে জানান, মাঝে মধ্যে ভ্রম্যমাণ আদালত পরিচালনা করে ঘাট বন্ধ করার পাশাপাশি জরিমানা বা কারাদণ্ড দেওয়া হয়। কিন্তু পরে আবার তারা শুরু করেন। তবে ভূঞাপুরে বালুর ঘাট নিয়ে মামলা চলছে। তাই এটি সরকারিভাবে ইজারা দেওয়া হয়নি। তবে ঘাট মালিকরা নাকি সিরাজগঞ্জ ও সড়িয়াকান্দি থেকে বালু কিনে এখানে এনে বিক্রি করেন।
টাঙ্গাইলের জেলা প্রশাসক ড. মো. আতাউল গনি বাংলানিউজকে জানান, ভূঞাপুরে ইজারাকৃত কোনো বালু মহাল বা বালুর ঘাট নেই। তবে কেউ যদি অবৈধভাবে বালু উত্তোলন করে থাকে তাহলে র্যাব দিয়ে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
তিনি জানান, বালুর ঘাট থেকে তার দপ্তর এবং উপজেলা প্রশাসন কোনো অনৈতিক সুবিধা নেয় না।
বাংলাদেশ সময়: ২২১২ ঘণ্টা, নভেম্বর ১, ২০২১
এসআই