ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১১ পৌষ ১৪৩১, ২৬ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৩ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

জাতীয়

দখলকৃত জমি উদ্ধারে ঝুপড়ি দোকানেই কাটে বৃদ্ধার দিন-রাত!

এস.এস শোহান, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৮১৫ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১৯, ২০২১
দখলকৃত জমি উদ্ধারে ঝুপড়ি দোকানেই কাটে বৃদ্ধার দিন-রাত!

বাগেরহাট: রোববার (১৯ ডিসেম্বর) দুপুর ১২টা। বাগেরহাট শহরের সাহাপাড়া মাধ্যমিক বিদ্যালয় সংলগ্ন সামনের সড়ক দিয়ে গোবদিয়া যাওয়ার পথে চোখ আটকে যায় পাশের একটি পরিত্যক্ত দোকানে।

মো. রুস্তম মল্লিকের দোকানে শুয়ে আছেন ষাটোর্ধ্ব এক বৃদ্ধা নারী। পরিত্যক্ত দোকানে বৃদ্ধ কেন! এমন কৌতুহল থেকে তার কাছে যাই। মলিন মুখে অপলক চোখে তাকিয়ে আছেন তিনি। পরিচয় জানতে চাইলে প্রথমে কিছুক্ষণ চুপ করে ছিলেন। এক পর্যায়ে বলেন, ‘জমি সংক্রান্ত কারণে ছোট ছেলে এখানে রেখে গেছে। কোথাও যাওয়ার জায়গা না থাকায় বাধ্য হয়ে এই দোকানে আছি’।

কথা বলে জানা যায়, পরিত্যক্ত দোকানে থাকা গোলেনুর বেগম (৬৩) ঝালকাঠি জেলার নলসিটি উপজেলার ভবানীপুর এলাকার বীর মুক্তিযোদ্ধা লতিফ মোল্লার স্ত্রী। জামাল ও মোস্তফা মোল্লা নামে দুই ছেলে ও এক মেয়ে নিয়ে বছর বিশেক আগে অভাবের তাড়নায় বাগেরহাটে আসেন। বাগেরহাট জেল খানায় রান্না-বান্নাসহ ধোঁয়া-মোছার কাজের পাশাপাশি মানুষের বাড়িতেও কাজ করতেন তিনি। বছর দশেক পরে অল্প অল্প করে জমানো টাকা দিয়ে বাগেরহাট সদর উপজেলার বাদেকাড়াপাড়া এলাকায় ৪ কাঠা জমি ক্রয় করেন তিনি। ক্রয়কৃত জমি কখনও ভোগ দখল করতে পারেননি অসহায় এই নারী। এর মধ্যে ছেলেরাও কাজের তাগিদে মাকে ছেড়ে বাপের ভিটায় গিয়ে উঠেছেন।  

নাড়ির টানে মা গোলেনুর বেগম সেখানে গেলেও, সেখানে ঠাঁই হয়নি অসহায় এই নারীর। শীত-বর্ষায় পরিত্যক্ত ঝুপড়ি দোকানেই কেটে যায় তার দিন-রাত। জীবনের এই পড়ন্ত বেলায় এসে যাকেই দেখেন নিজের জায়গা এনে দিতে বলেন, যাতে ছেলেদের কাছে ফিরতে পারেন।

স্থানীয় ও বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা খাবার, বস্ত্র, ৫-১০ টাকা দিয়ে সহায়তা করেন গোলেনুর বেগমকে। তাদের এই সামান্য সহায়তাতেই কোনোমতে বেঁচে আছেন তিনি।  

স্থানীয় আবুল কালাম আকন বাংলানিউজকে বলেন, ৭-৮ মাস ধরে গোলেনুর বেগম এই দোকানের মধ্যে থাকেন। আমরা এলাকাবাসী সাধ্য অনুযায়ী সহযোগীতা করি। শুনেছি তার বাদেকাড়াপাড়া এলাকায় একটি জমি আছে। কিন্তু জমিটি কারা যেন দখল করে নিয়েছে।

শহিদুল ইসলাম বলেন, বৃদ্ধা দাদীকে মাঝে মধ্যেই কাঁদতে দেখি। আমাদের তিনি বলেছেন, এখানে থাকতে খুব কষ্ট হয়। কখনো ছেলেদের কাছে যেতে চান আবার কখনো যাবেন না বলেন। তার একটি স্থায়ী থাকার জায়গা প্রয়োজন। এই অবস্থায় সরকারি ও সমাজের বিত্তবানদের প্রতি গোলেনুর বেগমকে সাহায্যের আবেদন জানান শহিদুল।

সাহাপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক সেলিনা সুলতানা বাংলানিউজকে বলেন, বৃদ্ধা নারী অনেকদিন ধরেই এখানে অসহায় অবস্থায় রয়েছেন। তার কোনো আত্মীয়-স্বজনকেও দেখিনি এখানে আসতে। তবে এই শীতে যদি একটু ভালো জায়গায় থাকার ব্যবস্থা না করা যায় তবে যে কোনো দুর্ঘটনা ঘটে যেতে পারে।

গোলেনুর বেগম বলেন, ছেলেরা বলেছে মা তুমি যেভাবে পারো জায়গা উদ্ধার করবা, তারপরে আমাগো খবর দিবা। আমরা এসে তোমারে নিয়ে যাবো। জায়গা উদ্ধার না করে আমি ফিরতে পারবো না বাবা।

এই দোকানে কেন থাকেন এমন প্রশ্নে গোলেনুর বেগম জানান, আমার ছোট ছেলেই আমাকে এখানে রেখে গেছে। আমার ছেলেরা খুব ভালো, কিছুদিন পরেই আমি ওদের কাছে চলে যাবো। ওরা আমারে খুব ভালোবাসে। আমার বৌমাও অনেক ভালো। আমাকে শুধু জমিটা উদ্ধার করে দেন আপনারা।

জমির বিষয়ে গোলেনুর বেগম বলেন, অনেক বছর আগে ৮০ হাজার টাকা দিয়ে এ আর খান নামে একজন মুহুরী ও স্থানীয় চান মিয়ার সহযোগীতায় একটি জমি কিনে ছিলাম। কিন্তু পরবর্তীকালে আমার জমিটি দখল করে নেয় প্রভাবশালীরা।

গোলেনুর বেগমের অভিযোগ অনুযায়ী বাদেকাড়াপাড়া এলাকায় অনেকের সঙ্গে কথা বলে তার জমি ক্রয়ের সত্যতা পাওয়া যায়। স্থানীয়রা জানান, কয়েক বছর আগে ৮০ হাজার টাকা দিয়ে এ আর খান নামে একজন মুহুরী ও স্থানীয় চান মিয়ার সহযোগীতায় একটি জমি ক্রয় করেন। কিন্তু পরবর্তীকালে তার জমি বেদখল হয়ে যায়।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক ব্যক্তি বাংলানিউজকে বলেন, এ আর খান সেই জমি অন্যত্র বিক্রি করে দিয়েছে। যেহেতু বেগম নিতান্তই অসহায় সেক্ষেত্রে তিনি ন্যায় বিচার পাবেন কিনা তা নিয়ে সন্দেহ থেকে যায়।

গোলেনুর বেগমের ছোট ছেলে জামাল মোল্লা বাংলানিউজকে বলেন, মায়ের সঙ্গে আমরা তিনভাই বোন বাগেরহাটে যাই। বাগেরহাটে কাজ না থাকায়, ঝালকাঠি এলাকায় চলে আসি। কিন্তু থেকে যায়, বাগেরহাটে। মা অনেক কষ্ট করে সেখানে একটি জমি কিনেছে, কিন্তু সেই জমিও দখল করে নিয়ে গেছে প্রভাবশালীরা।

জামাল মোল্লা আরও বলেন, আমি বাগেরহাটে রেখে আসিনি। জমির টানে তিনিই বাগেরহাটে গেছেন। তাছাড়া আমি খুব অসুস্থ, বাগেরহাট থেকে মা’কে গাড়িতে করে নিয়ে আসার মতো সামর্থ্যও আমার নেই। আপনারা আমার মাকে দেখে রেখেন।

বাগেরহাট সদর উপজেলা পরিষদের মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান রিজিয়া পারভীন বলেন, বাদেকাড়াপাড়া এলাকায় পরিদর্শন করে গোলেনুর বেগমের অভিযোগের সত্যতা পেয়েছি। আমরা চেষ্টা করব গোলেনুর বেগম তার প্রাপ্য জমি ফিরে পান।

বাগেরহাট সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মোহাম্মদ মোছাব্বেরুল ইসলাম বাংলানিউজকে বলেন, গোলেনুর বেগম নামে এক বৃদ্ধার অসহায়ত্বের খবর আমরা শুনেছি। আমরা তার বিষয়ে খোঁজ খবর নিবো। উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে গোলেনুর বেগমকে আইনের মধ্যে থেকে প্রয়োজনীয় সহায়তা দেওয়ার আশ্বাস দেন তিনি।

বাংলাদেশ সময়: ১৮০৯ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১৯, ২০২১
এনটি

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।