ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১১ পৌষ ১৪৩১, ২৬ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৩ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

জাতীয়

সেনা-নৌ-বিমান বাহিনীকে একসঙ্গে কাজ করার আহ্বান

স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১১৫২ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২০, ২০২১
সেনা-নৌ-বিমান বাহিনীকে একসঙ্গে কাজ করার আহ্বান

ঢাকা: মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বলীয়ান হয়ে দেশের সার্বভৌমত্ব ও নিরাপত্তা রক্ষায় সেনা ও বিমান বাহিনীর সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে নৌবাহিনীর সদস্যদের কাজ করার আহ্বান জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

সোমবার (২০ ডিসেম্বর) বাংলাদেশ নৌবাহিনীর ‘মিডশিপম্যান ২০১৯ আলফা’ ও ‘ডিইও ২০২১ ব্রাভো’ ব্যাচের শীতকালীন রাষ্ট্রপতি কুচকাওয়াজ অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে শেখ হাসিনা এ আহ্বান জানান।

চট্টগ্রামে বাংলাদেশ নেভাল একাডেমিতে আয়োজিত এ অনুষ্ঠানে সরকারি বাসভবন গণভবন থেকে প্রধানমন্ত্রী ভার্চ্যুয়ালি অংশগ্রহণ করেন।

শেখ হাসিনা বলেন, প্রশিক্ষণ শেষে আজ তোমরা ৪৪ জন প্রশিক্ষণার্থী বাংলাদেশ নৌবাহিনীর কমিশন্ড অফিসার হিসেবে কর্মজীবনে প্রবেশ করতে যাচ্ছ। কর্মজীবনে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বলীয়ান হয়ে দেশ মাতৃকার সার্বভৌমত্ব ও নিরাপত্তা রক্ষার্থে তোমরা নিরলসভাবে কাজ করে যাবে বলে আমার বিশ্বাস। তোমাদের মনে রাখতে হবে যে, কঠোর প্রশিক্ষণ তোমরা শেষ করলে তা তোমাদের উৎকর্ষ অর্জনের সূচনা মাত্র। সততা, সঠিক নেতৃত্ব ও আত্মত্যাগের মন্ত্রে বলীয়ান হয়ে সেনা ও বিমান বাহিনীর সদস্যদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে দেশের প্রয়োজনে তোমাদের সদাপ্রস্তুত থাকতে হবে। আমি আশা করবো দেশপ্রেম, শৃঙ্খলাবোধ ও কর্তব্যনিষ্ঠা তোমাদের অধিনস্তদেরও একইভাবে দেশের প্রয়োজনে আত্মনিবেদনে অনুপ্রাণিত করবে।

নৌবাহিনী গড়ে তোলার ক্ষেত্রে বঙ্গবন্ধুর পদক্ষেপের কথা তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব বাংলাদেশের ভূ-রাজনৈতিক ও আর্থ-সামাজিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেশের জলসীমার সার্বভৌমত্ব রক্ষা এবং সমুদ্র সম্পদের গুরুত্ব অনুধাবন করে ঐতিহাসিক ৬ দফায় নৌবাহিনী সদর দপ্তর চট্টগ্রামে স্থানান্তরের দাবি জানিয়েছিলেন। তিনি অনুধাবন করেছিলেন বাংলাদেশের বিশাল সমুদ্র অঞ্চলের সার্বভৌমত্ব রক্ষা এবং সমুদ্রভিত্তিক শক্তিশালী অর্থনীতি গঠনের জন্য শক্তিশালী নৌবাহিনীর কোনো বিকল্প নেই। তাই তিনি স্বাধীনতার পর একটা দক্ষ, শক্তিশালী, আধুনিক ও প্রযুক্তি নির্ভর নৌবাহিনী গড়ে তোলার লক্ষ্যে যুগোস্লাভিয়া ও ভারত থেকে পাঁচটি আধুনিক রণতরী সংগ্রহ করেন এবং ১৯৭৪ সালের ১০ ডিসেম্বর বাংলাদেশ নৌবাহিনীকে নেভাল এনসাইন প্রদান করেন। একইসঙ্গে তিনি নৌবাহিনীর বৃহত্তম প্রশিক্ষণ ঘাঁটি বানৌজা ঈশাখাঁসহ ৩টি ঘাঁটি এবং ৩টি জাহাজ কমিশনিং করেন। এদিনেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব বানৌজা সুরমায় প্রথম নৌবাহিনীর মহড়া পরিদর্শন করেন। জাতির পিতার প্রচেষ্টায় যুক্তরাজ্য থেকে যুদ্ধজাহাজ সংগ্রহের প্রক্রিয়া শুরু হয়। জাতির পিতা ১৯৭৪ সালে ‘টেরিটোরিয়াল ওয়াটারস অ্যান্ড মেরিটাইম জোনস অ্যাক্ট’ প্রণয়ন করেন, যা ছিল বাংলাদেশের সমুদ্র নীতির ভিত্তি। এরই ধারাবাহিকতায় ইতোমধ্যেই প্রতিবেশী দেশসমূহের সঙ্গে আমাদের সমুদ্রসীমা সুনির্দিষ্টকরণ সম্ভব হয়েছে এবং ১ লাখ ১৮ হাজার ৮১৩ বর্গকিলোমিটার বিশাল সমুদ্র এলাকায় আমাদের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব একটা পেশাদার, উন্নত সশস্ত্র বাহিনী গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন এবং সেই লক্ষ্যে ১৯৭৪ সালে তিনি একটা প্রতিরক্ষা নীতিমালা প্রণয়ন করেন। দুর্ভাগ্য, সব প্রতিবন্ধকতা মোকাবিলা করে জাতির পিতা যখন একটি শোষণ-বঞ্চনামুক্ত অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক সোনার বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্য নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছিলেন, ঠিক তখনই স্বাধীনতাবিরোধী অপশক্তি ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের কালরাতে তাকে পরিবারের বেশির ভাগ সদস্যসহ নির্মমভাবে হত্যা করে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে হত্যার পর থেমে যায় বাংলাদেশের উন্নয়ন-অগ্রযাত্রা।

শেখ হাসিনা বলেন, দীর্ঘ ২১ বছর পর ১৯৯৬ সালে জনগণের রায়ে রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব পেয়ে আওয়ামী লীগ সরকার নৌবাহিনীর আধুনিকায়নে নানামুখী পদক্ষেপ গ্রহণ করে। সে সময় আমরা বিভিন্ন অবকাঠামোগত উন্নয়ন, যুদ্ধজাহাজ সংগ্রহ এবং বিদ্যমান জাহাজসমূহের অপারেশনাল সক্ষমতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে কাজ করি। ২০০৯ সালে সরকার গঠনের পর থেকে আমরা জাতির পিতার প্রণীত প্রতিরক্ষা নীতির আলোকে ‘ফোর্সেস গোল-২০৩০’ প্রণয়ন করে এর বাস্তবায়ন শুরু করি। নৌবাহিনীকে একটি যুগোপযোগী ও আঞ্চলিক শক্তিশালী বাহিনী হিসেবে গড়ে তোলার জন্য আমাদের সরকার বিভিন্ন অবকাঠামোগত উন্নয়ন, নৌ বহরে যুদ্ধজাহাজ সংযোজন এবং বিদ্যমান জাহাজসমূহের অপারেশনাল সক্ষমতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে বান্তবমুখী পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করছে। ইতোমধ্যেই আমরা বাংলাদেশ নৌবাহিনীতে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক অত্যাধুনিক যুদ্ধজাহাজ, হেলিকপ্টার, মেরিটাইম প্যাট্রোল এয়ারক্রাফট এবং সাবমেরিনসহ আধুনিক যুদ্ধ সরঞ্জাম ও প্রযুক্তি সংযোজিত করেছি। আমরা গর্বের সঙ্গে বলতে চাই যে, ২০১৭ সালে নৌ বহরে ‘বানৌজা নবযাত্রা’ এবং ‘বানৌজা জয়যাত্রা’ নামক দুটি সাবমেরিন সংযোজনের মাধ্যমে বাংলাদেশ নৌবাহিনীকে একটি সত্যিকারের পূর্ণাঙ্গ ত্রিমাত্রিক নৌবাহিনী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হয়েছি। এর ফলে প্রাকৃতিক সম্পদে পরিপূর্ণ আমাদের বিশাল সমুদ্রের নিরাপত্তা বিধানের পাশাপাশি মানব পাচার ও চোরাচালান রোধ, জেলেদের নিরাপত্তা বিধান, বাণিজ্যিক জাহাজের নিরাপদ যাতায়াত নিশ্চিতকরণে নৌবাহিনীকে আরও বলিষ্ট ভূমিকা রাখতে সক্ষম হবে বলে আমি মনে করি। বাংলাদেশ নৌবাহিনীর সক্ষমতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে ভবিষ্যতে আরও অধিক উন্নত জাহাজ এবং আধুনিক যুদ্ধ সরঞ্জাম ও প্রযুক্তি সংযোজনের পরিকল্পনা আমাদের রয়েছে। সাবমেরিন ও যুদ্ধ জাহাজসমূহকে পোতাশ্রয়ে নিরাপদ জেটি সুবিধা প্রদানের লক্ষ্যে কক্সবাজারের পেকুয়াতে আধুনিক বেসিন সুবিধা সম্বলিত স্থায়ী সাবমেরিন ঘাঁটি ‘বানৌজা শেখ হাসিনা’ নির্মাণের কাজ চলমান রয়েছে। এছাড়া বাংলাদেশের দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলে উপকূলবর্তী এলাকায় নৌবাহিনীর জাহাজসমূহের অপারেশানাল ও যোগাযোগ সুবিধা বৃদ্ধির জন্য ‘শের-ই-বাংলা ঘাঁটি’র নির্মাণ কার্যক্রম অনেক দূর এগিয়েছে।

তিনি বলেন, গত নভেম্বর ২০২১ জার্মানি থেকে নতুন একটি এমপিএ বাংলাদেশ নৌবাহিনীর এভিয়েশন উইং এ যুক্ত হয়েছে এবং অপরটি আগামী মে ২০২২ যুক্ত হবে। হেলিকপ্টার এবং এমপিএ পরিচালনা ও রক্ষণাবেক্ষণের জন্য আধুনিক সব সুবিধা সম্বলিত দ্বিতীয় হ্যাঙ্গারের নির্মাণকাজও চলমান রয়েছে। বাংলাদেশ নৌবাহিনীর ব্যবস্থাপনায় পরিচালিত খুলনা শিপইয়ার্ড লিমিটেড ইতোমধ্যে প্যাট্রোল ক্রাফট ও লার্জ প্যাট্রোল ক্রাফট নির্মাণের সক্ষমতা অর্জন করেছে। এছাড়া বাংলাদেশ নৌবাহিনী পরিচালিত চট্টগ্রাম ড্রাইডক লিমিটেডে আধুনিক যুদ্ধ জাহাজ নির্মাণের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছে, যার মাধ্যমে বাংলাদেশ নৌবাহিনী ‘ক্রেতা নৌবাহিনী’ থেকে ‘নির্মাতা নৌবাহিনী’ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হবে বলে আমার বিশ্বাস। নতুন নতুন জাহাজ এবং সমরাস্ত্র সংযোজনের পাশাপাশি এসব অত্যাধুনিক প্রযুক্তির সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিত করার লক্ষ্যে বাংলাদেশ নৌবাহিনীর সাংগঠনিক কাঠামো বৃদ্ধি এবং সময়োপযোগী করার ক্ষেত্রেও আমাদের সরকার কাজ করছে। এরই ধারাবাহিকতায় সম্প্রতি নৌ প্রশাসনিক কর্তৃপক্ষ ঢাকার পদনাম পরিবর্তন করে ‘কমান্ডার ঢাকা নৌ অঞ্চল’ করা হয়েছে এবং একইসঙ্গে পদবি কমডোর থেকে রিয়ার অ্যাডমিরালে উন্নীত করা হয়েছে।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, সশস্ত্র বাহিনীর উন্নয়নের পাশাপাশি দেশের অর্থনৈতিক এবং আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে আমাদের সরকার নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে। দেশের তরুণ প্রজন্মের মধ্য থেকে উন্নত প্রশিক্ষণের মাধ্যমে সামরিক বাহিনীর জন্য যোগ্য নেতৃত্ব গড়ে তোলার লক্ষ্যে যুগোপযোগী একাডেমি প্রতিষ্ঠা ছিল জাতির পিতার স্বপ্ন। তার সেই স্বপ্ন বাস্তবায়নের লক্ষ্যে ২০১৮ সালে আধুনিক সুযোগ-সুবিধা সম্বলিত ‘বঙ্গবন্ধু কমপ্লেক্স’ উদ্বোধন করা হয়ছে। এ কমপ্লেক্সের মাধ্যমে নেভাল একাডেমিতে প্রশিক্ষণ সুবিধা আজ বহুগুণে বৃদ্ধি পেয়ে আন্তর্জাতিক মানে উন্নীত হয়েছে। ক্লাসরুম, ল্যাবরেটরিতে প্রশিক্ষণের পাশাপাশি ইতোমধ্যে একাডেমিতে স্মল আর্মস ফায়ারিং, মোটর ড্রাইভিং এবং ব্রিজ সিমুলেটর স্থাপনের কার্যক্রম গ্রহণ করা হয়েছে। এ বর্ধিত সুযোগ-সুবিধা কাজে লাগিয়ে একাডেমি থেকে প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত নৌ কর্মকর্তারা অধিকতর আত্মবিশ্বাসী হয়ে নেতৃত্বদানের মাধ্যমে নৌবাহিনীকে এগিয়ে নিয়ে যাবে বলে আমার দৃঢ় বিশ্বাস।  

আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে নৌবাহিনীর ভূমিকার কথা তুলে ধরে শেখ হাসিনা বলেন, নৌবাহিনী আজ শুধু দেশেই নয়, আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলেও অত্যন্ত সুশৃঙ্খল, দক্ষ ও পেশাদার বাহিনী হিসেবে মর্যাদা লাভ করেছে। জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনসহ সব ক্ষেত্রে তাদের আত্মত্যাগ ও কর্তব্যনিষ্ঠা বাংলাদেশের জন্য বয়ে এনেছে বিরল সম্মান ও মর্যাদা, যা বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের ভাবমূর্তিও অত্যন্ত উজ্জ্বল করেছে। করোনা মহামারির সময় বাংলাদেশ নৌবাহিনীসহ আমাদের সশস্ত্র বাহিনী অত্যন্ত আন্তরিকতার সঙ্গে মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছে। এজন্য আমি সবাইকে ধন্যবাদ জানাই।

বাংলাদেশ সময়: ১১৪৭ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২০, ২০২১ 
এসকে/আরবি

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।