ঢাকা, শুক্রবার, ১৪ আষাঢ় ১৪৩১, ২৮ জুন ২০২৪, ২০ জিলহজ ১৪৪৫

জাতীয়

ভূমধ্যসাগর থেকে বেঁচে ফেরা সামিউলের কান্নাভেজা গল্প

হারুন-অর-রশীদ, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট   | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৭১৪ ঘণ্টা, মার্চ ১৬, ২০২২
ভূমধ্যসাগর থেকে বেঁচে ফেরা সামিউলের কান্নাভেজা গল্প

ফরিদপুর: নৌকায় করে সাগর পাড়ি দিয়ে স্বপ্নের দেশ ইতালিতে যাওয়ার পথে নিখোঁজ তিন বন্ধুর একজন সামিউল শেখ (২১)। ফিরে এসেছেন দেশে।

সাতদিনের কোয়ারেন্টিন শেষে তিনি এখন বাড়িতে। তার অপর দুই বন্ধু মইন ও নাজমুল সাগরে ডুবে মারা গেছেন। তাদের সঙ্গে আরো ২৯ জনের সলিল সমাধি হয়েছে ভূমধ্যসাগরে। সেই দুঃসহ স্মৃতি তাড়া করে ফিরছে তাকে।  

এদিকে, মানবপাচারের সঙ্গে জড়িত প্রধান দুই আসামি শওকত চৌধুরী (২৮) ও রাসেল মিয়া (২৪) এখনো লিবিয়াতে রয়েছেন। সম্পর্কে তারা মামাতো-ফুফাতো ভাই। থাকেন লিবিয়াতে। তাদের গ্রেফতার ও ফাঁসির দাবি জানিয়েছে ভুক্তভোগী পরিবারগুলো।

জানা যায়, চলিত বছরের ২২ জানুয়ারি ছোট নৌকায় ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইতালি যাওয়ার সময় ঠাণ্ডায় জমে মারা যান সাতজন। এর মাত্র পাচঁদিন পর ২৭ জানুয়ারি ৩৫ জনকে একইভাবে ইতালির উদ্দেশে এক ইঞ্জিনের একটি নৌকায় পাঠানো হয়। এরমধ্যে সামিউলসহ মাত্র সাতজন বেঁচে ফিরতে পেরেছেন।  

সামিউল শেখ ফরিদপুরের নগরকান্দা উপজেলার দক্ষিণ কাইচাইল গ্রামের ইউনুস শেখের ছেলে। তার দুই বন্ধু বাবুর কাইচাইল গ্রামের ফারুক মাতুব্বরের ছেলে মইন মাতুব্বর ফয়সাল (১৯) ও মাজেদ মিয়ার ছেলে নাজমুল মিয়াসহ (২২) তাদের তিনজনের পরিবার ৩০ লাখ টাকায় ইউরোপে পাঠাতে দালালের শরণাপন্ন হন। এরপর তাদের নিয়ে যাওয়া হয় মৃত্যুপুরীতে। গত বছরের ১৭ নভেম্বর মানবপাচারকারী চক্রের দালাল রাসেল ও শওকত ঢাকা থেকে প্লেনে করে তিন বন্ধুকে দুবাই নিয়ে যান। এরপর ১ ডিসেম্বর নিয়ে যান লিবিয়াতে। সেখানে নিয়ে প্রায় দুই মাস তাদের ঘরবন্দি করে রাখা হয়।  

সামিউল বাংলানিউজকে বলেন, যাদের মাধ্যমে আমরা গিয়েছিলাম তারা আমার আত্মীয় হতো। তাই ভাবিনি ওরা আমাদের জীবন নিয়ে খেলবে। কিন্তু লিবিয়ায় পৌঁছানোর পরে আমরা ওদের কাছে জিম্মি হয়ে যাই। বাইরে বের হতে চাইলে গুলি করার ভয় দেখাতো। বাইরে যুদ্ধ হচ্ছে বলতো আবার মালিকের সাতটি পিস্তল আছে, সেগুলো দিয়ে গুলি করে দিবে বলতো। ছোট ওই ঘরে ২০ জনের মতো ছিলাম। সারাদিনে খুবজু নামে একটি লম্বা বনরুটি দিতো। ১০০ গ্রামের মতো ওজন হবে। সেটি সকালে অর্ধেক ও দুপুরে অর্ধেক খেতাম। রাতে কখনো কখনো সামান্য ভাত দিতো। এরপর আমাদের নরসিংদীর মনির শীল নামে মানবপাচার চক্রের আরেক দালালের কাছে বিক্রি করে দেয়। মনির তাদের হাতবদল করে অলিদ নামে আরেক দালালের কাছে। প্রায় দুই মাস বন্দি থাকার পর ২৭ জানুয়ারি আমাদের লিবিয়ার জোয়ারা ঘাট থেকে ইতালির উদ্দেশে একটি স্পিডবোটে তোলা হয়।

আমাদের প্রথমে বলেছিল মালবাহী জাহাজে নেবে। লাইফ জ্যাকেট এবং শুকনা খাবার দিবে। কিন্তু যেই স্পিডবোটে তুলেছিল সেখানে ২০ জনের মতো লোক বসতে পারে। অথচ দুইজন চালকসহ ৩৭ জনকে ওই বোটে তোলা হয়। আমাদের ভয় দেখিয়ে বোটে উঠানো হয়। বাধ্য হয়ে সবাই বোটে উঠি। প্রায় আট ঘণ্টা চলার পর ঝড়ো বাতাসে স্পিডবোটটি উল্টে ২৯ জন সাগরের পানিতে ভেসে যায়।  

তখন স্পিডবোটের অন্য পাশ ধরে আমরা আটজন ভাসতে থাকি। এভাবে প্রায় দেড় থেকে দুই ঘণ্টা পর আমার বন্ধু নাজমুল ঢেউয়ের তোড়ে ছিটকে পড়ে। এরপর আমরা সাতজন সাড়ে ১১ ঘণ্টা ভাসতে থাকি। তখন একজনের একটি গেঞ্জি ছাড়া আমাদের শরীরে কোনো কাপড় ছিল না। এসময় দূরে একটি জাহাজ দেখে আমাদের একজন নরসিংদীর ফারুক একটি লাল গেঞ্জি উঁচু করে দেখাতে থাকে। জাহাজটি ছিল লিবিয়ার কোস্টগার্ডের। তারা আমাদের দেখতে পেয়ে জাহাজে তুলে বুট দিয়ে লাথি মারতে শুরু করে। তখন ওই জাহাজেই রাশেদুল নামে একজন মারা যান। তাকে লিবিয়ায় এনে দাফন করা হয়। ওই বোটে মিসরের ২ চালকসহ মোট ৩৭ জনের মধ্যে বেঁচে ফেরে মাত্র ৬ জন।  

সামিউল আরও জানায়, সাড়ে ১১ ঘণ্টা আমরা কিছুই না খেয়ে সমুদ্রে ভাসছিলাম। জাহাজে ওঠার পর আমাদের শারীরিক অবস্থা ছিল খুবই শোচনীয়। চোখের সামনে প্রাণের দুই বন্ধুকে হারিয়ে ফেলেছি।

এদিকে ফেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তাহে ফরিদপুরের সাংবাদিকেরা সামিউল ও তার বন্ধুদের নৌকায় সাগর পাড়ি দিয়ে ইতালি যাওয়ার খবর প্রকাশ করলে দূতাবাস এ ব্যাপারে তৎপরতা শুরু করে। ১৪ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ দূতাবাস ও আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থা (আইওএম) তাদের খুঁজে বের করে। এরপর ২ মার্চ নগরকান্দার সামিউল শেখ নরসিংদীর রায়পুরা উপজেলার হাসনাবাদ গ্রামের ইউসুফ মৃধা, একই জেলার নালিখা গ্রামের ইয়াসিন, বেলাব থানার ফারুক, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার জাকির ও মাদারীপুরের ইউনুসকে দেশে ফিরিয়ে আনে। সাতদিন কোয়ারেন্টিন শেষে ১০ মার্চ তারা বাড়িতে ফেরে।

অবৈধভাবে ভূমধ্যসাগর পাড়ির সঙ্গে জড়িত দালাল চক্রের মধ্যে দেশে আছেন দুইজন। আর লিবিয়ায় দুইজন। দেশের দুই দালাল হলেন নগরকান্দার কাইচাইল ইউনিয়নের ছোট নাওডুবি গ্রামের হান্নান মাতুব্বরের ছেলে শাহিন মাতুব্বর (৪১) ও মৃত শামসুদ্দিন মাতুব্বরের ছেলে ইলিয়াস মাতুব্বর (৩৯)। আর লিবিয়ার দুইজন হলেন ছোট নাওডুবি গ্রামের মৃত শামছুদ্দিন মাতুব্বরের ছেলে শওকত মাতুব্বর (২৫) ও চানু মাতুব্বরের ছেলে রাসেল মাতুব্বর (৩৫)। চার বছর ধরে তারা লিবিয়াতে থাকেন।

সামিউলের বাবা ইউনুস শেখ বাংলানিউজকে বলেন, সামিউল নগরকান্দা সরকারি কলেজে এইচএসসি পরীক্ষার্থী ছিলেন। বিদেশে যাওয়ায় তার পরীক্ষা দেওয়া হয়নি। পাশের গ্রামের শওকত মাতুব্বর ও রাসেল মাতুব্বর নামে দুইজন আমাদের দূর সম্পর্কের আত্মীয় হন। তারা লিবিয়ায় থাকেন। এর আগে, কয়েকজনকে এভাবে বিদেশে পাঠিয়েছেন। তাদের কথামতোই ৩০ লাখ টাকায় সামিউল, নাজমুল ও ফয়সালকে বিদেশে পাঠাই। এরমধ্যে ২০ লাখ টাকা দিয়েছি। ইতালি যেতে পারলে বাকি টাকা পরিশোধ করার কথা ছিল।

এদিকে ভূমধ্যসাগরে ভেসে যাওয়া নাজমুলের বড় ভাই সম্রাট মিয়া বাংলানিউজকে বলেন, আমার মা নাজমুলের খবর জেনে অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। বাবাও জ্ঞানহারা। মানবপাচারকারী ওই চক্রের সবাইকে গ্রেফতার করতে হবে। না হলে আরো অনেক পরিবার নিঃস্ব হয়ে যাবে। এভাবে মরবে।

সামিউলের মা সালমা বেগম বলেন, আমার ছেলে ফিরে এসেছে। কিন্তু ওর দুই বন্ধু এখনো ফিরে আসেনি। যারা ওদের এভাবে মারছে তাদের আমি ফাঁসি চাই।  

ফয়সালের বাবা ফারুক মাতুব্বর বলেন, আমার ছেলে দালালদের হাতে বিদেশে যেতে গিয়ে মারাই গেছে। আমার স্ত্রী একথা জেনে অসুস্থ হয়ে পড়েছে। আমিও অসুস্থ। শুনলাম এরই মধ্যে একজন আসামি জামিনে বেরিয়ে এসেছে। আমি ওদের ফাঁসি চাই।

এদিকে নিখোঁজদের মধ্যে একজন ফয়সাল মাতুব্বর মইনের বাবা ফারুক মাতুব্বর বাদি হয়ে গত ৫ ফেব্রুয়ারি নগরকান্দা থানায় ১০ জনকে আসামি করে মানবপাচার আইনে মামলা করেন। এরপর পুলিশ হান্নান মাতুব্বর ও তার ছেলে তুহিন মাতুব্বর নামে দুই আসামিকে গ্রেফতার করে। সন্দেহভাজন হিসেবে কাজল মাতুব্বর নামে আরো একজনকে গ্রেফতার করা হয়।  

মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা নগরকান্দা থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) পীযূষ কান্তি দে বাংলানিউজকে বলেন, এ ঘটনায় বেঁচে ফেরা সামিউল সোমবার (১৪ মার্চ) আদালতে জবানবন্দি দিয়েছেন।

নগরকান্দা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) হাবিল হোসেন বলেন, মামলাটির তদন্ত চলছে। আসামিদের মধ্যে প্রধান দুইজন শওকত ও রাসেল বর্তমানে বিদেশে রয়েছেন। তাদের গ্রেফতার করতে হলে ইন্টারপোল অথবা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সহায়তা নিতে হবে। এখন তাদের ব্যাপারে তথ্য যাচাই-বাছাই চলছে এভাবে আরো কতজনের সঙ্গে তারা প্রতারণা করেছে কিংবা বিদেশে নিয়েছে। তথ্য যাচাই শেষে তারা প্রতিবেদনসহ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে চিঠি পাঠাবেন।

সিনিয়র সহকারী পুলিশ সুপার (নগরকান্দা সার্কেল) মো. সুমিনূর রহমান বাংলানিউজকে বলেন, এ ব্যাপারে মামলা হয়েছে। পুলিশ তদন্ত করে চার্জশিট দেবে। এরপর তাদের নামে ওয়ারেন্ট ইস্যু হলে দূতাবাসের মাধ্যমে বিদেশে থাকা আসামিদের গ্রেফতারের উদ্যোগ নেয়া হবে।  

তিনি আরও বলেন, নাজমুল ও মইন মাতুব্বরের ব্যাপারে এখনো অফিসিয়ালি কোনো তথ্য জানা যায়নি। তাই তাদের ভাগ্যে আসলেই কী হয়েছে তা বলতে পারছিনা এখনই।

আরও পড়ুন:-
>>> নৌকায় ভেসে ইতালির পথে প্রাণ গেল ৭ বাংলাদেশির
>>> ৭ বাংলাদেশির মৃত্যুর ঘটনা অনুসন্ধানে রোম দূতাবাস

বাংলাদেশ সময়: ১৬৫০ ঘণ্টা, মার্চ ১৬, ২০২২
এনটি

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।