কুমিল্লা: আনন্দপুর। কুমিল্লার বুড়িচংয়ের ভারত সীমান্তবর্তী একটি গ্রাম।
আনন্দপুর ও আশপাশের গ্রামের তিন শতাধিক পরিবার যুক্ত ছিল এই শিল্পের সঙ্গে। গ্রামজুড়ে ছিল উৎসবের আমেজ। দূর-দূরান্তের মানুষ ভিড় করতেন এসব গ্রামে। বাঁশের তৈরি জিনিসপত্র বিক্রির ধুম পড়ে যেত। অর্থনৈতিক স্বচ্ছলতা ছিল বেশ।
সময়ের বিবর্তনে আনন্দপুরের সেই আনন্দঘন আবহ ম্লান হয়ে গেছে। পর্যাপ্ত চাহিদা থাকলেও দক্ষ জনশক্তি ও প্রযুক্তির অভাবে এ শিল্পের উৎপাদন কমে গেছে। বর্তমানে মাত্র ১১টি পরিবার যুক্ত আছে এই শিল্পের সঙ্গে। তাদের মধ্যে একজন শাহ্ জামাল। তিনি কুমিল্লা আর্টস অ্যান্ড ক্রাফটসের স্বত্ত্বাধিকারী। তার প্রয়াত বাবা বীর মুক্তিযোদ্ধা আবুল হাসেমের হাত ধরেই বুড়িচংয়ে এ শিল্প বিস্তার লাভ করে। এই শিল্পকে বাঁচাতে শাহ্ জামাল সংগ্রাম করছেন। তিনি আবারও ইউরোপ-আমেরিকায় ছড়িয়ে দিতে চান তার বাঁশের শো-পিস।
শাহ্ জামালের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, রঙতুলি দিয়ে বাড়ির উঠোনে শুকাতে দেওয়া ওয়ালমেটে আল্পনা আঁকছেন তিনি। পাশে কাজ করছেন তার ভাই আবুল কালাম ও সাইফুল ইসলাম, প্রতিবেশী ডালিয়া এবং আরও একজন। কলমদানি আর ফুলদানি তৈরি করতে বাঁশ ছোট টুকরো করে কাটা হয়েছে। আগুন দিয়ে বাঁশে সেঁক দেওয়া হচ্ছে। সেই বাঁশ ঘষে পরিষ্কার করা হয়। তার ওপরে নানা রঙের ডিজাইন। হাত দিয়ে সব যত্ন সহকারে করা হচ্ছে। মাটির ঘরে বেতবোনার মেশিন। পাশে উৎপাদিত টেবিল ল্যাম্প, ফুলদানি, কলমদানি, ওয়ালমেট, ক্যালেন্ডার, দরজা-জানালার পর্দার সারি।
শাহ্ জামালের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, এমন ৫২টি পণ্য উৎপাদন করে আলপনা করেন তিনি। মাসে তার ৩০ থেকে ৫০ হাজার টাকা আয় হয়। কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব শিল্প পুরস্কার-২০২০ পান তিনি।
তবে দুঃখের অন্ত নেই তার। শাহ্ জামাল জানান, আমার স্বপ্ন ছিল এ শিল্পে বড় অবদান রাখা ও নতুন নতুন কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা। কুমিল্লায় প্রয়োজনীয় কাঁচামালের অভাব নেই। কিন্তু দক্ষ জনশক্তি তৈরির জন্য কোনো প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা যাচ্ছে না। সময়ের দাবিতে প্রযুক্তির ব্যবহার মানুষকে অনেক দূর এগিয়ে নিয়েছে। পুঁজি ও পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে প্রযুক্তি থেকে অনেক পিছিয়ে পড়েছি। যার কারণে উৎপাদনও বেশ কমে গেছে।
শাহ্ জামাল আরও জানান, বাজারে বাঁশের তৈরি শো-পিসের ব্যাপক চাহিদা। ওই হারে উৎপাদন করার মতো প্রযুক্তি, দক্ষ জনশক্তি ও উৎপাদিত পণ্য বিক্রি করার জায়গার সঙ্কট আছে। যার কারণে লাভের ভাগীদার হয়ে যাচ্ছে মধ্যস্বত্বভোগীরা।
জানা যায়, ১৯৮৬ সালে এসএসসি শেষে আবুল হাসেমের ছেলে শাহ্ জামাল কুমিল্লা বিসিক থেকে কমার্শিয়াল আর্টের ওপর তিন বছরের কোর্স শেষ করে বাবার পেশায় পা বাড়ান। আত্মকর্মসংস্থান ও দারিদ্র্য বিমোচন প্রকল্পের আওতায় তিনি আনন্দপুর হাজিবাড়ির পৈতৃক ভিটায় গড়ে তোলেন কুমিল্লা আর্টস অ্যান্ড ক্রাফটস্ নামক প্রতিষ্ঠান। প্রতিষ্ঠান গড়ার উদ্দেশ্য ছিল কুটির শিল্পজাত দ্রব্যাদি তৈরি, প্রশিক্ষণ ও বিক্রয়। প্রথম দিকে বেশ সফল ছিলেন তিনি। ব্র্যাক ও বিসিকের সহায়তায় তিনশ নারী-পুরুষকে প্রশিক্ষণ দেন তিনি। বিদেশি পর্যটক ও সংস্থাগুলোর আসা-যাওয়া চলছিল নিয়মিত। চীন, জাপান, কলম্বিয়া, থাইল্যান্ড, আমেরিকা ও ফ্রান্সের প্রতিনিধি দল সফর করেন শাহ্ জামালের প্রতিষ্ঠানে।
ব্যবসা ভালোই চলছিল। কাঁচামালের সঙ্কট নেই, থেমে নেই উৎপাদনও। বিক্রিতেও কখনো ভাটা পড়েনি। কিন্তু বাঁধ সাধে প্রযুক্তি। মেশিনারি ও প্লাস্টিকের পণ্যের সঙ্গে পাল্লা দিতে না পেরে পিছিয়ে পড়ে যান তিনি ও তার সহকর্মীরা। এদিকে তারা নিজেরাও উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করার মতো আর্থিক সঙ্গতি অর্জন করতে পারেননি। জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় এ পেশা ছাড়তে শুরু করেন অনেকেই।
এ বিষয়ে কুমিল্লার অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) মো. শাহাদাত হোসেন বলেন, 'কুটির শিল্পী মো. শাহ্ জামালকে ব্যক্তিগতভাবে চিনি। তিনি পরিশ্রমী উদ্যোক্তা। তার কাজকে এগিয়ে নিতে আমরা সহযোগিতা করবো।
কুমিল্লা ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশনের ( বিসিক) উপ-মহাব্যবস্থাপক মুনতাসীর মামুন জানান, 'রাঙামাটিতে বাঁশ-বেত নিয়ে কাজ করা কুটির শিল্পীদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা আছে। তাছাড়া সরকারও নতুন নতুন বিষয় নিয়ে কাজ করছে। শাহ্ জামালদের ব্যবসা এগিয়ে নিতে বিসিক থেকে যে যে সুবিধা দেওয়া যায় তার ব্যবস্থা করতে কাজ করা হবে।
জানা যায়, ১৯৫৫ সালের পূর্ব থেকে কুমিল্লা কারাগারে কুটির শিল্পের পণ্য তৈরি হতো। শাহ্ জামালের বাবা আবুল হাসেম ফটোগ্রাফি নিয়ে ব্যস্ত থাকতেন। সেসময় কুমিল্লা কারাগারে চাকরি করা মহিউদ্দিন নামে এক ব্যক্তি আবুল হাসেমকে পরামর্শ দেন বাঁশের তৈরি পণ্য তৈরি করার জন্য। ফটোগ্রাফার আবুল হাসেমের আর্টের হাত ভালো ছিল। তিনি মহিউদ্দিনের প্রস্তাব লুফে নেন। নিজের গ্রাম আনন্দপুরে এ শিল্পের উৎপাদন শুরু করেন তিনি। ধীরে ধীরে তা প্রসার লাভ করে। বুড়িচংয়ের জঙ্গল বাড়ি, খাড়েরা, ছোট হরিপুর ও ছয়গ্রামের মানুষজন জড়িয়ে পড়েন এই পেশায়। স্বাধীনতা পরবর্তীতে নব্বই দশক পর্যন্ত বেশ দাপুটে অবস্থায় ছিল বাঁশ-বেত শিল্প। পরবর্তীতে প্লাস্টিকের পণ্যে বাজার সয়লাব হয়ে যায়। লাভ ও উৎপাদনের সঙ্গে সামঞ্জস্য না থাকায় বিমুখ হয়ে পড়েন কুটির শিল্পীরা।
বাংলাদেশ সময়: ১৮৪৫ ঘণ্টা, মার্চ ১৮, ২০২২
আরএ