ঢাকা, শনিবার, ২১ বৈশাখ ১৪৩১, ০৪ মে ২০২৪, ২৪ শাওয়াল ১৪৪৫

জাতীয়

বন্যা থেকে বাঁচতে নদীরক্ষাসহ ৬ দফা দাবি বাপার

স্টাফ করেসপন্ডেন্ট  | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৪৫৬ ঘণ্টা, জুন ২১, ২০২২
বন্যা থেকে বাঁচতে নদীরক্ষাসহ ৬ দফা দাবি বাপার ছবি: বাংলানিউজ

ঢাকা: জলবায়ুর বৈশ্বিক পরিবর্তনে অতিবৃষ্টি, উজানের আন্তঃদেশীয় নদীগুলোর ওপর ভারতের একতরফা নিয়ন্ত্রণ এবং অবব্যস্থাপনার কারণে দেশের অভ্যন্তরীণ নদ-নদী, খাল-বিল ও হাওর ভরাট হয়ে যাওয়ায় ঘন ঘন বন্যা হচ্ছে। এমনটাই মনে করছে বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা)।

মঙ্গলবার (২১ জুন) ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে বাপার আয়োজনে ‘আকস্মিক বন্যায় সিলেটে মানবিক বিপর্যয়: কারণ ও করণীয়’ শীর্ষক আলোচনা সভায় বক্তারা এ অভিমত তুলে ধরেন।  

অনুষ্ঠানে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন বেনের বৈশ্বিক সমন্বয়ক, বাপার কেন্দ্রীয় সদস্য ও যুক্তরাষ্ট্রের লক হ্যাভের বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. মো. খালেকুজ্জামান।

লিখিত বক্তব্যে বলা হয়, বিগত তিন মাসে সিলেট এবং সুনামগঞ্জসহ হাওরের বিভিন্ন অঞ্চল তিনবার আকস্মিক বন্যায় ঝাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। জুন মাসের মাঝামাঝি শুরু হওয়া বন্যায় সিলেট ও সুনামগঞ্জ জেলা শহরসহ প্রায় ৮০ শতাংশ এলাকা পানিতে তলিয়ে গেছে বলে জানা গেছে।

হাওরের উজানে অবস্থিত ভারতের মেঘালয় এবং আসামে গত দশ দিনে রেকর্ড পরিমাণ বৃষ্টিপাতের খবর পাওয়া গেছে। শুধু জুন মাসেই মেঘালয়ের চেরাপুঞ্জিতে রেকর্ড ৪০৮১ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়েছে। একই সময়ে রেকর্ড পরিমাণ বৃষ্টি হয়েছে সুনামগঞ্জেও। যেহেতু বিরামহীনভাবে এই বৃষ্টিপাতের ঘটনা ঘটেছে, তাই মেঘনা অববাহিকা অঞ্চলের মাটি পানিতে পরিপূর্ণ হয়ে থাকার কারণে সমস্ত বৃষ্টির পানি ভূ-উপরিস্থিত প্রবাহে রূপান্তরিত হয়ে নদী-নালা-খাল-বিল প্লাবিত করে বন্যার সৃষ্টি করেছে।

এর আগেও ২০১৭, ২০১৮ এবং ২০১৯ সালেও হাওরের বিভিন্ন অংশে বন্যা হয়েছিল। উপরোক্ত তথ্য থেকে একটি জিনিস স্পষ্ট হয়েছে যে, অধুনাকালে বন্যার মাত্রা, তীব্রতা এবং স্থায়িত্বকাল বেড়ে গিয়েছে। বৃষ্টিপাতের পরিমাণ বেড়ে যাওয়ার বিষয়টি স্পষ্টতই জলবায়ু পরিবর্তনের প্রাক্কালনের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ।

বন্যার কারণ হিসেবে বৈশ্বিক, আন্তঃদেশীয় এবং অভ্যন্তরীণ কয়েকটি কারণকে দায়ী করে বক্তারা বলেন, বৈশ্বিক কারণ জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে সম্পর্কিত। বৈশ্বিক উষ্ণায়নের কারণে আমাদের অঞ্চলে বর্ষাকালে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ এবং বন্যার মাত্রা যে বেড়ে যাবে তা বিজ্ঞানীরা আগেই প্রাক্কলন করেছিলেন।

আন্তঃদেশীয় কারণ হিসাবে তারা বলেন, উজানের দেশ ভারত একতরফাভাবে মেঘনা অববাহিকার প্রত্যেকটি নদীর পানিপ্রবাহ নিয়ন্ত্রণ, বনাঞ্চল উজার করা এবং কয়লা ও অন্যান্য খনিজ পদার্থ উত্তোলনের মাধ্যমে প্রচুর পলি এবং রাসায়নিক দূষণ সৃষ্টি করার কথা উল্লেখযোগ্য।

মেঘনা অববাহিকার ৫৭% এলাকাই ভারতে অবস্থিত। মেঘনা অববাহিকায় ১৬টি আন্তঃদেশীয় নদী প্রবাহমান, কিন্তু এর একটির জন্যেও পানি ব্যবস্থাপনা যৌথভাবে করার জন্য কোনো চুক্তি নেই। যৌথ নদী কমিশনের তালিকাবদ্ধ এই ১৬ আন্তঃনদীর বাইরেও আরও ৩০টির মত ছোট ছোট আন্তঃদেশীয় নদী-নালা এবং খাল রয়েছে। শুকনা মৌসুমে ভারত সেচ ও পানিবিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য নদীর পানি ধরে রেখে ইচ্ছানুযায়ী ছাড়ে।

অন্যদিকে, বর্ষাকালে উজানের সমস্ত বাঁধ এবং জলাধারের গেইট খুলে দিয়ে ভাটিতে অবস্থিত হাওর অঞ্চলে বন্যার তীব্রতা বাড়াতে সহায়তা করে।

বাংলাদেশের অভ্যন্তরে মেঘনা অববাহিকার ৪৩% এলাকায় অবস্থিত, কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে বিগত সাত দশক ধরে বেষ্টনী বা কর্ডনভিত্তিক ভুল পানি নীতিমালা বাস্তবায়নের মাধ্যমে দেশের নদী, জলাশয় এবং হাওরের ব্যাপক ক্ষতি সাধন করা হয়েছে। উজানে মেঘনা নদীর প্রস্থচ্ছেদ অনেক বেশি। উজানের পানি ব্রিজের নিচে এসে বাধাগ্রস্ত হয়ে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি করে বলে প্রতীয়মান হয়।

উপরোক্ত অব্যবস্থাপনার কারণে বন্যার নিয়ন্ত্রণ কিংবা প্রশমন না হয়ে বরং বন্যাজনিত ক্ষয়-ক্ষতির পরিমাণ ক্রমান্বয়ে বেড়েই চলেছে। অপরিকল্পিত নগরায়ণ, বালু উত্তোলন, প্লাবনভূমি দখলের মাধ্যমে নন-নদীর প্রবাহ ধারণ ক্ষমতা কমিয়ে আনা হয়েছে, যার ফলশ্রুতিতে বন্যার প্রকোপ বেড়েই চলেছে।

বন্যা থেকে পরিত্রাণের উপায় প্রসঙ্গে বাপা নেতৃবৃন্দ ৬ দফা দাবি পেশ করেন। এগুলো হলো—

• নদীর প্রতি আমাদের দৃষ্টিভঙ্গী পরিবর্তন করতে হবে। বাংলাদেশের কৃষ্টি, শিল্প, সাহিত্য, সভ্যতা, এবং ব-দ্বীপ গঠনে নদীর ভূমিকা হৃদয়ঙ্গম করে নদী ব্যবস্থাপনা নির্ধারণ করতে হবে।

• নদীর প্রাকৃতিক কার্যপ্রক্রিয়া আমলে নিয়ে নদীর প্লাবনভূমি নদী প্রবাহের জন্য বরাদ্দ রেখে, উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের নামে নদীর ধ্বংস প্রক্রিয়া রহিত করে, জলবায়ু প্রবর্তনহেতু সৃষ্ট বাড়তি প্রবাহ ধারণের সক্ষমতা বাড়ানোর লক্ষ্যে নদী বক্ষ থেকে বাড়তি পলি ক্রমান্বয়ে ড্রেজিংয়ের মাধ্যমে সরাতে হবে।

• নদীর স্বাভাবিক গতি ফিরিয়ে আনতে হবে।

• প্রত্যেকটি নদীর উৎস থেকে মুখ পর্যন্ত অববাহিকাভিত্তিক সমন্বিত পানি-পলি ব্যবস্থাপনার লক্ষ্যে সমস্ত অংশীজনের স্বার্থরক্ষাকারী দীর্ঘমেয়াদী চুক্তি সম্পাদন করতে হবে।

• জাতিসংঘের পানি প্রবাহ আইন কার্যকর করে, সেই আইনের আলোকে চুক্তি করতে হবে এবং গ্যারান্টি ক্লজসহ সেই চুক্তির বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে হবে।

• সমস্ত আন্তঃদেশীয় নদীর পানি-পলি অবস্থাপনাকে রাষ্ট্রীয় কূটনীতির কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত করতে হবে। ‘নদী বাঁচলেই বাংলাদেশ বাঁচবে’ এই সত্যটি সবার হৃদয়ে ধারণ করতে হবে এবং সেই মোতাবেক সমস্ত কর্মকাণ্ড পরিচালনা করতে হবে।

সংবাদ সম্মেলনে অনলাইনে যুক্ত ছিলেন বাপার সহ-সভাপতি ও বেনের প্রতিষ্ঠাতা ড. নজরুল ইসলাম, নির্বাহী সহ-সভাপতি ডা. মো. আব্দুল মতিনসহ সংগঠনের অন্যান্য নেতৃবৃন্দ।

বাংলাদেশ সময়: ১৩২৭ ঘন্টা, ২১ জুন, ২০২২
এমকে/এসএ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।