ঢাকা, রবিবার, ২৩ আষাঢ় ১৪৩১, ০৭ জুলাই ২০২৪, ২৯ জিলহজ ১৪৪৫

জাতীয়

নিজেই ছুরি কিনে গলায় চালান ডিবিসির বারী!

স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২১৩৫ ঘণ্টা, জুলাই ১৬, ২০২২
নিজেই ছুরি কিনে গলায় চালান ডিবিসির বারী!

ঢাকা: রাজধানীর নিকেতনের লেকপাড় থেকে ডিবিসি নিউজের প্রযোজক আব্দুল বারীর রক্তাক্ত মরদেহ উদ্ধারের ঘটনায় এক মাসের বেশি তদন্ত শেষে এটিকে আত্মহত্যা বলেই মনে করছে পুলিশ।

বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে তদন্তকারী সংস্থা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) জানিয়েছে, বারী নিজেই ছুরি কিনে আত্মহত্যা করেছেন।

এ অবস্থায় ফরেনসিক প্রতিবেদন এবং মেডিক্যাল রিপোর্টের অপেক্ষা করছেন তদন্ত সংশ্লিষ্টরা।

গত ৮ জুন লেকপাড় থেকে আব্দুল বারীর মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। তার পেটে এবং গলায় ধারালো ছুরির আঘাত ছিল, এমনকি রক্তাক্ত ছুরিও ঘটনাস্থল থেকে উদ্ধার করা হয়।

মরদেহ উদ্ধারের পর রহস্য উদঘাটনে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি), পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই), পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) এবং র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটেলিশন (র‌্যাব) যৌথভাবে তদন্ত শুরু করে।

মাসখানেকের বেশি সময় ধরে তদন্ত শেষে ডিবি নিশ্চিত হয়েছে বারীকে কেউ খুন করেনি। তিনি নিজেই গলায়-পেটে ছুরি চালিয়ে আত্মহত্যা করেছেন।

তদন্তে তার ব্যক্তি ও পেশাগত জীবন এবং মৃত্যুর আগের গতিবিধি বিশ্লেষণ করে ডিবি এ তথ্য জানায়।

ডিবি সংশ্লিষ্টরা জানান, বারীর মোবাইলের কল লিস্ট এবং এসএমএস লিস্ট চেক করে দেখা গেছে তিনি সাত থেকে দশ দিনে একবার মোবাইলে কথা বলতেন। এসএমএসেও তেমন কিছুই পাওয়া যায়নি, অপারেটরদের বিভিন্ন অফারের মেসেজ ছাড়া। তার কোনো ধরনের প্রেম, ভালোবাসা কিংবা পরকীয়ার মতো কোনো ঘটনাও পাওয়া যায়নি।

এমনকি কোনো মাদক কিংবা কোনো জঙ্গীবাদের সঙ্গে জড়িত হওয়া বা কোনো ব্যক্তির সঙ্গে দেনা-পাওনার হিসেব নিয়ে ঝামেলা- এমন কোনো প্রমাণও মিলেনি। সার্বিকভাবে মনে হয়েছে তিনি একজন সরল-সোজা নিভৃতচারী মানুষ ছিলেন, চরম নিঃসঙ্গ একজন মানুষ ছিলেন।

তদন্তের এ পর্যায়ে ডিবি মনে করছে, ব্যক্তিগত সমস্যা থেকে হীনমন্যতার কারণেই তিনি নিজের গলায় ছুরি চালিয়েছেন।

এদিকে, ডিবি পুলিশ বারীর কিছু শারীরিক সমস্যার প্রেসক্রিপশন হাতে পেয়েছে। তার চোখের সমস্যা ছিল। আত্মীয়রা ডিবিকে বলেছেন, প্রচণ্ড মাথা ব্যথায় তিনি হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ফেলতেন।

ডিবির গুলশান বিভাগের উপ-কমিশনার (ডিসি) মো. মশিউর রহমান বলেন, আমরা শুরু থেকে এই মৃত্যুকে হত্যাকাণ্ড হিসেবে মনে করে তদন্ত শুরু করি। এজন্য হত্যার মোটিভ উদঘাটনের চেষ্টা করেছিলাম। আমরা ভেবেছি হয়তো মার্ডার ফর গেইন, আবার কখনো ভেবেছি রিলেশনের কারণে, আবার কখনো ভেবেছি হয়তো মাদকাসক্তি থেকে কিংবা ছিনতাইকারীরা এমনটি করে থাকতে পারে।

কিন্তু তার মরদেহ উদ্ধারের সময় পকেটে থাকা মানিব্যাগে প্রায় ৯০০ টাকা এবং একটা ভিভো মোবাইল পাওয়া যায়। যে কোনো ছিনতাইকারীর জন্য এই ৯০০ টাকা এবং ১০-১৫ হাজার টাকার মোবাইল যথেষ্ট লাভের বিষয়, কিন্তু কেউ নেয়নি। এতে বুঝা যায় কেউ মার্ডার ফর গেইনের জন্য এটা করেনি।

তিনি আরও বলেন, ডিজিটালি এবং এনালগ পদ্ধতিতে তার ব্যক্তিগত এবং পেশাগত জীবন আমরা গভীরভাবে বিশ্লেষণ করে দেখেছি। এখানেও স্পষ্ট হয়, তার কোনো শত্রু নেই। আমরা দেখেছি কেউ তাকে ডিজিটালি অনুসরণ করেনি, আবার ফিজিক্যালিও অনুসরণ করেনি।

তার মহাখালীর বাসা থেকে নিকেতনের হাতিরঝিল লেকের ধারে আসার পথে কেউ তাকে অনুসরণ করেনি। শতাধিক সিসিটিভি ফুটেজে দেখা গেছে, তিনি একা একা উদ্দেশ্যহীনভাবে কখনো একই জায়গায় তিন-চারবার আসা যাওয়া করেছেন। এসব জায়গায় তাকে কেউ অনুসরণও করেনি।

এ সময় তিনি কখনো অন্ধকার গলিতে হেঁটেছেন, আবার কখনো হেঁটেছেন আলোকিত জায়গাতে। তাকে কেউ মারতে চাইলে অন্ধকার জায়গাতেই মেরে ফেলতে পারতো। এসব কিছু পর্যালোচনা এবং এ সংক্রান্ত সংশ্লিষ্ট একাধিক ব্যক্তিকে জিজ্ঞাসাবাদও করেছি। কিন্তু কেউ এর সঙ্গে জড়িত ছিল না।

পরে আমরা প্রায় কয়েকশ সিসিটিভি ফুটজে পরীক্ষা করেছি। তাতে আমরা দেখেতে পেয়েছি তিনি বাসা থেকে বের হওয়ার পর গলির একটা দোকান থেকে মিষ্টি খেয়েছেন। এরপর সেখান থেকে সামনে গিয়ে তিন-চারটা দোকান ঘুরে একটা দোকান থেকে ২০ টাকা দিয়ে ফল কাটার ছুরি কিনেছেন।

সেই ছুরি কেনার পর তিনি রাস্তা পার হয়ে গাউছুল আজম মসজিদে কিছু সময় কাটান। এরপর গুলশান লেক পাড় থেকে হেঁটে হেঁটে নিকেতনের লেকপাড়ে আসেন। এরপর যেখানে তার মরদেহ পড়েছিল, সেখানে সিসি ক্যামেরা না থাকায় বাকিটা স্পষ্ট হওয়া যায়নি। তবে আমাদের কাছে মনে হচ্ছে ব্যক্তিগত সমস্যা থেকে হীনমন্যতার কারণে তিনি নিজেই নিজের গলায় ছুরি চালিয়েছেন।

তিনি আরও বলেন, মৃত্যুর কিছুদিন আগে তিনি চাকরি ছেড়ে দেওয়ার নোটিশ দিয়েছিলেন এবং যে মেসে থাকতেন সেটাও ছেড়ে দেওয়ার নোটিশ দিয়েছিলেন। এসব কিছু থেকে মনে হচ্ছে তিনি ছিলেন খুবই হতাশাগ্রস্ত। এ কারণে আমরা মনে করি এটি হত্যা নয়, বরং সুইসাইড হতে পারে। কারণ ঘটনাস্থলে যে ছুরি পাওয়া গেছে সেটি তিনি নিজেই কিনেছেন- এমন প্রমাণ আমরা পেয়েছি।

তবে প্রাথমিকভাবে আমরা এটিকে সুইসাইড মনে করলেও এখনো ফরেনসিক রিপোর্টগুলো নিয়ে কাজ করছি। ফরেনসিক রিপোর্ট এবং মেডিক্যাল রিপোর্ট পেলে এটি আরও নিশ্চিত হওয়া যাবে বলেও জানান এই পুলিশ কর্মকর্তা।

প্রসঙ্গত গত ৮ জুন সকালে ছিন্নমূল কয়েকজন শিশু বারীর মরদেহ দেখতে পেয়ে পুলিশকে খবর দেয়। এরপর নিকেতন পুলিশ প্লাজার পার্শ্ববর্তী লেকপাড় থেকে তার মরদেহ উদ্ধার করা হয়। পরে এ ঘটনায় দায়ের করা মামলার তদন্তভার ডিবি পুলিশের কাছে হস্তান্তর করা হয়।

জানা গেছে, আবদুল বারী ডিবিসি নিউজের অনুষ্ঠান বিভাগের প্রযোজক ছিলেন। ৭ জুন সাপ্তাহিক ছুটি থাকায় তিনি অফিসে যাননি। তার গ্রামের বাড়ি সিরাজগঞ্জ সদরে। মহাখালীতে ব্যাচেলর হিসেবে একটি মেসে থাকতেন।

>>> আর পড়ুন: ডিবিসির প্রযোজক হত্যা: রহস্য উদঘাটনে সময় লাগবে

বাংলাদেশ সময়: ২১৩৫ ঘণ্টা, জুলাই ১৬, ২০২২
পিএম/এমএমজেড

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।