ঢাকা, রবিবার, ৪ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১, ১৯ মে ২০২৪, ১০ জিলকদ ১৪৪৫

জাতীয়

৪০ বছরে স্ত্রীসহ এসএসসি পরীক্ষা দিচ্ছেন গুরুদাপুরের কাউন্সিলর

মো. মামুনুর রশীদ, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১০২৫ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ১৭, ২০২২
৪০ বছরে স্ত্রীসহ এসএসসি পরীক্ষা দিচ্ছেন গুরুদাপুরের কাউন্সিলর

নাটোর: শিক্ষার কোনো বয়স-কাল লাগে না, নেই কোনো ধরা-বাধা নিয়মকানুন। কেবল ইচ্ছাশক্তি, মনোবল আর একটু প্রচেষ্টা এবং ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র স্বপ্নই তা একদিন আসল গন্তব্যে পৌঁছে দেবে।

আর সেই লক্ষ্য নিয়ে নিজেদের শিক্ষার আলোয় আলোকিত করতে পড়াশুনার পথ বেছে নিয়েছেন নাটোরের গুরুদাপুর উপজেলার ফজলুর রহমান-মর্জিনা বেগম নামে এক দম্পতি।

সময়কালে তারা নিজেদের শিক্ষিত মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে পারেননি বলে আজ তাদের চোখে-মুখে একটাই স্বপ্ন নিজেরা শিক্ষিত মানুষ হবেন আর শিক্ষার আলোয় আলোকিত করবেন। আর সেই শিক্ষা অর্জনে ভর্তি হয়েছে স্কুলে, শেষ পর্যন্ত এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষাতেও অংশগ্রহণ করেছেন তারা।

ইতোমধ্যে গত বৃহস্পতিবার (১৫ সেপ্টেম্বর) অনুষ্ঠিত প্রথম পরীক্ষাও বেশ ভালো দিয়েছেন তারা। এবার অন্য পরীক্ষাগুলো যাতে ভালো দিতে পারেন, সেজন্য প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। এক সঙ্গে বসে তারা পরীক্ষার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। শিক্ষার যে বয়স লাগে না তা আরও একবার প্রমাণ করলেন তারা।

গুরুদাসপুর পৌরসভার ৩ নম্বর ওর্য়াডের খামার খামারনাচঁকৈড় মহল্লার সাবেক পৌর কাউন্সিলর মো. ফজলুর রহমান (৪০) ও তার স্ত্রী মোছা. মর্জিনা বেগম (৩০) এবারের এসএসসি পরীক্ষায় এক সঙ্গে অংশ নিচ্ছেন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম থেকে শুরু করে বিভিন্ন গণমাধ্যমেও ওঠে আসে তাদের পরীক্ষার বিষয় বস্তু নিয়ে নানা গল্প গাঁথা।

৪০ বছর বয়সে এসে পড়াশুনার আগ্রহ দেখে এখন অনেকেই উৎসাহ বোধ করছেন পড়ালেখায়। তারা এখন অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত হতে পারেন বলে মন্তব্য করছেন অনেকে। ফজলুর রহমান ওই মহল্লার মৃত আসাদ আলী মোল্লার ছেলে ও তার স্ত্রী একই এলাকার মৃত-মজিবর রহমানের মেয়ে।

স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, স্বামী-স্ত্রী দুইজনই একই প্রতিষ্ঠান বিয়াঘাট কারিগরি কমার্স কলেজের ভোকেশনাল শাখার ২০২২ সালের শিক্ষার্থী। স্বামী ফজলুর রহমানের বয়স ৪০ আর স্ত্রী মর্জিনা বেগমের বয়স ৩০ বছর। তাদের সংসারে রয়েছে এক ছেলে ও এক মেয়ে সন্তান। তারা পরামর্শ  করে এক সঙ্গে ২০২০ সালে বিয়াঘাট কারিগরি কমার্স কলেজে নবম শ্রেণিতে ভর্তি হন।

নিয়মিতভাবে স্কুলে গিয়ে ক্লাস করতে না পারলেও বাড়িতে বসেই তারা ছেলে-মেয়েদের সঙ্গে নিয়ে পড়াশুনা করতেন। এ নিয়ে পরিবারের লোকজন সন্তোষ প্রকাশ করলেও প্রতিবেশীদের অনেকে ঠাট্টা-বিদ্রুপ করতেন। এরপরও তারা থেমে যাননি। স্বামী সংসারের কাজকর্ম আর স্ত্রী গৃহস্থালীর কাজ শেষে রীতিমত পড়াশুনা চালিয়ে গেছেন। এখন এসএসসি পরীক্ষায় অংশ নিচ্ছেন। ভালো ফলাফল হলে তারা পড়াশুনা চালিয়ে যাবেন বলে জানা গেছে।

পরীক্ষার্থী ফজলুর রহমান বাংলানিউজকে বলেন, তাদের স্বামী-স্ত্রীর বয়সের ব্যবধান ১০ বছর। তার বয়স ৪০ আর স্ত্রীর বয়স ৩০ বছর। দীর্ঘ ৫ বছর জনপ্রতিনিধি হিসেবে কাজ করতে গিয়ে নানা প্রতিবন্ধকতার শিকার হয়েছি। লেখাপড়া তেমন একটা জানা ছিল না বলে পদে পদে ঠোকর খেয়েছি। বুঝতে শিখেছি লেখাপড়া জানাটা মানুষের জীবনের জন্য সবচেয়ে বড় একটা অধ্যায়।

তাই সিদ্ধান্ত নিয়েছি পড়ালেখা করার, সঙ্গে ছেলে-মেয়েকেও উচ্চ শিক্ষিত করে গড়ে তোলা। সুযোগ হলে নিজেও উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত হবেন এবং স্ত্রীকেও করবেন। একসময় আমার ছেলে মেয়ে বড় হয়ে তারা গর্ববোধ করবে তাদের বাবা মাও শিক্ষিত।

তিনি বলেন, পড়ালেখার কোনো বয়স লাগে না। তিনি পড়ালেখা করছেন, পরীক্ষাও দিচ্ছেন। প্রথম পরীক্ষা বেশ ভালো হয়েছে, আশা করছি অন্যগুলোও ভালো হবে। সেরকমই প্রস্তুতি নিয়েছি। তিনি আরও বলেন, তার মত বয়সী যারা আছেন লেখাপড়া জানেন না, আসুন আমরা পড়াশুনা করি, অন্যকেও উৎসাহিত করি।

স্ত্রী মর্জিনা বেগম বাংলানিউজকে বলেন, ২০০৯ সালে আমি পড়াশুনা বাদ দিয়েছিলাম। এর মধ্যে বিয়ে হয়েছে দুইটি সন্তান হয়েছে। তারাও পড়ালেখা করছে। তাদের উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত করাই আমাদের লক্ষ্য। এরমধ্যে আমার স্বামীও নতুন করে পড়াশুনার আগ্রহ প্রকাশ করে, সঙ্গে আমাকেও পড়ালেখায় উৎসাহিত করেন।

শেষ পর্যন্ত আমার স্বামীর আগ্রহে দুইজন পরামর্শ করে নতুন করে পড়াশোনা শুরু করেছি। দুইজন এক সঙ্গে বাড়িতে পড়াশুনা করে আবার এক সঙ্গে পরীক্ষা দিচ্ছি। আমার খুব ভালো লাগছে। আমরা আরও অনেক পড়াশুনা করতে চাই। দেখিয়ে দিতে চাই ইচ্ছা আর মনোবল বড় শক্তি। ইচ্ছে করলেই সব বয়সে পড়াশুনা করা যায়, তাতে সংসার জীবনে কোনো প্রতিবন্ধকতা নেই।

এ প্রসঙ্গে ফজলুর রহমানের মা ফুলোয়ারা বেগম বলেন, আমার বাড়িতে ছেলে ও ছেলের বউয়ের সঙ্গে যখন নাতি-নাতনিও পড়তে বসে তখন দেখতে আমার খুব ভালো লাগে। শুধু তাই নয় আমারও তখন পড়তে ইচ্ছে করে। যে ছেলেকে সময়মত পড়াশুনা করাতে পারিনি, এখন সেই ছেলে চলার পথে বাধা-বিপত্তি উপলব্ধি করে পড়াশুনা করছে, এটা বড় আনন্দের ব্যাপার। আমি তাদের জন্য সব সময় দোয়া করি। তারা স্বামী-স্ত্রী, নাতি-নাতনি যেন অনেক দূর এগিয়ে যেতে পারে।

গুরুদাসপুর পৌরসভার মেয়র মো. শাহনেওয়াজ বাংলানিউজকে বলেন, সাবেক কাউন্সিলর ফজলুর রহমান পড়াশুনা করছেন শুনে বেশ লাগছে। সঙ্গে তার স্ত্রীকেও পড়াশুনা করাচ্ছেন এটা অত্যন্ত প্রশংসার দাবিদার। ফজলুর-মর্জিনা দম্পতির মত দেশের আরও দম্পতি উচ্চ শিক্ষা গ্রহণ করুক এবং দেশ ও সমাজকে বদলে দিক এটাই প্রত্যাশা করি।

গুরুদাসপুর উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসার মো. ওয়াহিদুজ্জামান বাংলানিউজকে বলেন, এই বয়সে এসেও তাদের পড়াশোনার প্রতি যে আগ্রহ দেখছি তা অত্যন্ত প্রশংসনীয়। আশা করছি ফজলুর রহমান-মর্জিনা দম্পতির মত আরও অনেকে এগিয়ে আসবে পড়াশুনার দিকে। তারা অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত স্থাপন করবে। তারা যদি পড়াশুনা করতে চায়, সেক্ষেত্রে শিক্ষা বিভাগ থেকে সব রকম সহযোগিতা করা হবে।

বাংলাদেশ সময়: ১০২৪ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ১৭, ২০২২
আরএ 

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।