১৭.
অন্তরা পাগলের মতো গাড়ি ড্রাইভ করছে। মহাখালী, বনানী ছাড়িয়ে সে এখন উদভ্রান্তের গতিতে উত্তরার কাছাকাছি।
উত্তরা পেরিয়ে সে গাজীপুর চৌরাস্তা দিয়ে সোজা আরও উত্তরে চলেছে। ময়মনসিংহ রোড। এখনই ভাওয়ালের বন শুরু হবে। রাতের অন্ধকারের সঙ্গে বনানীর জমাট কান্না মিশে গুমোট হয়ে আছে পরিবেশ। দৈত্যের চোখের মতো মাঝে মাঝে জ্বলছে বিপরীত দিক থেকে আসা গাড়ির হেডলাইট। আলোর ঝাপটায় চিকচিক করছে অন্তরার চোখের অশ্রু। সে জানে, পরিপূর্ণ কান্না সে কাঁদতে পারবে না। তার কান্না হয় না। কান্না তার মনে বাসা বেঁধে থাকে। বের হতে চায় না। ভাইয়ার কথা মনে পড়ছে। বেচারা। কতটুকু জানে সে মানুষের মন। যন্ত্র। তবু সব জেনে গেল। জানুক। একদিন সবাই সব কিছু জানবে। মায়ের বয়স হয়েছে। তাঁকে আড়াল করা যায়। খারাপ দিকগুলো ভাবার চিন্তাও তাঁর নেই। শুধু ভাবে, মেয়ের মন খারাপ কিংবা শরীর ভালো নেই। ব্যস! এ পর্যন্তই। আমার জগতে আসার ক্ষমতা তাঁর নেই। আমি আমার নিজের একান্ত জগতে কাউকে আসতে দেবো না। অন্তরার খুব ইচ্ছে হয়, সেই একান্ত জগতে কেউ তাকে আলতো ভাবে ডাকুক। কাছে নিয়ে রাখুক। হাতে হাত ধরুক। তার সব কিছু নিয়ে যাক। সব কিছু দিয়ে যাক। কিন্তু তার জীবনে এমন কিছুই হয় না। অন্তরা প্রবলভাবে প্রত্যাশা করে, কেউ তাকে গুনগুনিয়ে বলুক:
তোমার জন্যে তোমার জন্যে তোমার জন্যে হে মেয়ে
আসে সমুদ্র আসে অরণ্য আমার মধ্যে যে ধেয়ে
আসে তটরেখা আসে দিগন্ত আবর্তে আসে সে গেয়ে
বৈশাখ আনে বর্ষাকে আনে কে চেয়ে
আকাশ বৃক্ষ মেঝমল্লারে যায় যে ছেয়ে
তোমার জন্যে তোমার জন্যে তোমার জন্যে হে মেয়ে...।
ফুঁপিয়ে কেঁদে ফেলে অন্তরা। পড়াশোনা, ক্যারিয়ার সব ব্যর্থ মনে হয় তার কাছে। ক্ষোভে, অভিমানে ভাইয়ার চেহারা বার বার ভেসে উঠে।
রাজেন্দ্রপুর চৌরাস্তার পর পরই অন্তরা গাড়ি ডানের একটি গলি পথে ঘুরিয়ে দিল। ইট বিছানো প্রাইভেট রাস্তা। কিছুক্ষণ পর রাস্তাটি শেষ হয়েছে দেয়াল-ঘেরা একটি বাংলো বাড়িতে। গাড়ি দেখেই দারোয়ান গেট খুলে দিল। চেনা গাড়ি। বাড়ির এক পাশে পার্কিং করে অন্তরা সোজা ভেতরে চলে গেল। কেউ তাকে বাধা দিল না। যেন এটা তার নিজের বাড়ি।
বিশাল ড্রয়িং রুমের জ্বলজ্বলে আলোতে সোফায় আরামে গা এলিয়ে বসে আছে এনামুল। সঙ্গে রোকসানা। পাশের সোফায় মিসেস খোন্দকার। অন্য পাশে মলি আর তার আন্টি। এনামুল তার আরেক পাশে অন্তরাকে আদুরে গলায় ডেকে বসালো:
-আয়! আয়! তোর জন্যেই সবাই বসে আছি।
বসতে বসতে বললো অন্তরা:
-হঠাৎ জরুরি কি হলো? সবাইকে ছুটে আসতে হয়েছে কেন?
এনামুল সুস্থির কণ্ঠে উত্তর দেয়:
-বলছি বলছি। মাত্র এলি, একটু দম নিয়ে নে।
এনামুল বেল টিপলো। চিকেন ফ্রাই, স্ন্যাক্স, গ্লাস, বোতল সামনের টেবিলে রেখে বেয়ারা চলে গেল।
যদিও খেতে খেতে হালকা চালে কথা হওয়ার পরিবেশ নেই, তবু ব্যবস্থার কমতি নেই। সকলের মুখ উদ্বিগ্ন ও গম্ভীর। গুরুত্বপূর্ণ কিছুর জন্য অপেক্ষমাণ। উৎকণ্ঠার অবসান হলো এনামুলের ভারী ও জড়ানো কন্ঠে। সরাসরি অন্তরার দিকে তাকিয়ে সাপের মতো হিসহিসে গলার বললো
-সমস্যা তোর ভাইয়া ওরফে আমার বন্ধুকে নিয়ে?
এক মুর্হূত দেরি না করে পাল্টা জানতে চায় অন্তরা:
-কেন, আবার কি হলো?
এনামুল জানায়:
-হয় নি। তবে হতে পারে।
অন্তরা তীব্র কণ্ঠে পাল্টা জানতে চায়:
-মানে?
এবার এনামুল সকলকে উদ্দেশ্য করে বললো:
-সে যেভাবে গোয়েন্দা কুকুরের মতো লেগেছে, তাতে সব কিছু বের না করে ছাড়বে বলে মনে হয় না।
এ পর্যন্ত বলে থামল এনামুল। তারপর সবার চেহারা নিরীক্ষণ করে এপাশ-ওপাশ দেখে বলল:
-ও যে সব জায়গায় হানা দিচ্ছে এবং যে সব প্রশ্ন করছে, তাতে আমাদের ব্যবসার সিক্রেট আউট হয়ে যাবে। একবার যদি সব জেনে যায়, ব্যবসা তো যাবেই, মান-ইজ্জত-জানও চলে যাবে। আমার একার নয়। উপরের কর্তা থেকে তোমাদেরও।
এই কথায় একটু নড়েচড়ে বসলেন মিসেস খোন্দকার। সবার চেয়ে বেশি বিমর্ষ দেখাচ্ছে তাকে।
এনামুল কথা না থামিয়ে বলল:
-সীমান্ত ও এয়ারপোর্ট থেকে বিভিন্ন ধরনের ড্রাগস সংগ্রহের নেটওয়ার্ক এবং সেগুলো দেশে ছড়িয়ে দেওয়ার সাপ্লাই লাইন সম্পর্কে সে যদি জেনে যায়, তাহলে বিরাট কেলেঙ্কারী হবে। উপরের মহলের রাজনীতি, প্রশাসনের যারা আমাদের প্রটেকশন দেয়, তাদের কথাও ফাঁস হয়ে যাবে। সবাই তখন আমার উপর হামলে পড়বে। কেউ ছাড়বে না আমাকে।
এবার মুখ খুললো রোকসানা:
-আমরা তো যথেষ্ট সতর্ক আছি?
এনামুল হাসল:
-তা আছি। বাংলাদেশের ভেতরে কোনও সমস্যা নেই। প্রেস-মিডিয়া, পুলিশ-প্রশাসন কিচ্ছু করতে পারবে না আমাদের। তারা আমাদেরই অংশ। কিন্তু বন্ধু ব্যাটা বিদেশে সব তথ্য নিয়ে প্রচার করে দিলে তখন কি হবে? সেটা ভেবে দেখেছো?
রোকসানা আর কথা বাড়ালো না।
মলি-আন্টি মিহি গলায় বললেন:
-তাকে জালে জড়িয়ে রাখলেই তো হয়। আমাদের ছকের বাইরে যেতে পারবে না।
হাত দিয়ে মাছি তাড়ানোর ঢঙ্গে তাকে থামিয়ে দিল এনামুল:
-চেন না। তাকে চেন না। প্রলোভনে পড়ার পাত্র নয় সে। বড়ই কঠিন মাল। নীতিবাদে একদম ঠাঁসা। চেষ্টা করে দেখতে পারো। বিশেষ সুবিধা করতে পারবে না। আর ছকের কথা বলছো? আমি তাকে যে মোবাইল ব্যবহার করতে দিয়েছি, তাতে গোপনে ডিভাইস ফিট করা আছে। সে কোথায় যায়, কখন যায়, সব আমি মনিটর করতে পারি। বসে বসে যদি কল্পনার ফানুস উড়িয়ে গল্প ফেঁদে যেতো, আমি আপত্তি করতাম না। কিন্তু সে শেকড়ের দিকে যাচ্ছে।
এবার মিসেস খোন্দকার মনে হলো টলে উঠলেন। তার বিমর্ষ ভাব সঘন হলো। তার সঙ্গে যে এপার্টমেন্টের পার্কিং-এ কথা হয়েছে এটা কি এনামুল স্যার জেনে গেছেন? জিব দিয়ে ঠোঁট ভেজালেন ভদ্রমহিলা।
মলি কথা বলায় প্রসঙ্গ অন্য দিকে চলে গেল:
-আমি চেষ্টা করে দেখেছি। ভদ্রলোক খুবই স্ট্রং। নার্ভ বেশ শক্ত। বড় বেশি যান্ত্রিক। তাকে উত্তেজিত করা বা ইমোশনালি বাগে আনা অসম্ভব।
কেউ লক্ষ্য করলো না অন্তরা আগুনে চোখে মলির দিকে তাকিয়ে আছে। অন্তরা অবশ্য দ্রুতই চোখ সরিয়ে নিল। মনে মনে হেসে উঠল সে। বেচারী মলি।
এনামুল এবার গমগমে গলায় বললো:
-আমি তোমাদের সঙ্গে পরিস্থিতি পর্যালোচনা করার জন্য জরুরি ডেকেছি। এসব কথা অফিসে বসে প্রকাশ্যে আলোচনা করা যায় না। যার যেমন দায়িত্ব সেটা আরও সাবধানে পালন করবে। উপরের মহলে ভেট পাঠানো, গোপন সূত্র থেকে মাল আনা, সেগুলো বিভিন্ন পয়েন্টে সাপ্লাই করা ইত্যাদি আরও সতর্কতার সঙ্গে করতে হবে। আমাদের সব এজেন্টকে বলে দেবে অচেনা কারও কাছে মুখ না খুলতে। আর সবাই ওকে ওয়াচে রাখবে। যাতে আমাদের মধ্যেই ঘুরপাক খেয়ে একটা আবছা ধারণা নিয়ে সে চলে যায়। নীল নেশার জগত সম্পর্কে নীলাভ রহস্যময় কল্পনা করে সে উপন্যাস লিখুক। পুরস্কার পাক। হুমায়ূন আহমেদ মরে গেছে। সে জায়গা সে দখল করুক। বিষণ্নতায় ভরা প্রেমকথা বিক্রি করে সে টাকা কামাক। আমার কোনও আপত্তি নেই। প্রকৃত অবস্থার চিত্রটি যেন সে কোনও ভাবেই আঁচ করতে না পারে। সেটাই আমার নির্দেশ। উপর থেকেও আমি এমন ইন্সস্ট্রাকশন পেয়েছি। ওকে।
তার মানে মিটিং শেষ। যা বলার বলে দেওয়া হয়েছে। এবার তোমাদের কাজের পালা। এনামুল আর রোকসানা ছাড়া অন্যরা বের হয়ে গেল। ঘর ছেড়ে আসার আগে অন্তরা দেখল এক কোণে ঘাপটি মেরে বসে আছে সাংবাদিক ফরমানউল্লাহ। সে একটি কথাও বলে নি। সে যে উপস্থিত ছিল, সেটা পর্যন্ত জানান দেয় নি।
মাঝরাতের দিকে গাড়ি চালিয়ে বাসায় ফিরতে ফিরতে অন্তরার মনে হলো সে একটা কাঁচের দরজা। হ্যাঁ, সামান্য কাঁচের দরজাই তো আমি। আর কিছু না। আদ্যোপান্ত, উপর-নীচে কাঁচের দরজা। দরজায় বড় করে লিখা ‘ঠেলুন’, ‘টানুন’। আমি আর আমার নিয়ন্ত্রণে নেই। অদৃশ্য সুতায় টানছে; ঠেলছে। শুধু কিছুটা জায়গায় মারকারি পেপার লাগানো। সে জায়গাটা দেখা যাচ্ছে না। যারা লাগিয়েছে, তারা খুলে দিলে সব শেষ। খান খান করে ভেঙে যাবে আমার সমস্ত অস্তিত্ব। ‘মা’ উপন্যাস সম্পর্কে দস্তোয়েভস্কির উক্তি মনে পড়ছে। ‘কেবল বিপ্লবী সংগ্রামী মানুষই তার সমস্ত আবিলতা, পাশবিকতা ও স্বার্থপরতা থেকে নিজের ভিতরটাকে শুদ্ধ রাখতে পারে। ’ আমি কি দিয়ে নিজে শোধরাবো। যেখানে চলে এসেছি, সেখান থেকে মুক্তি নেই। উদ্ধার নেই। নীল উড়ালে অদৃশ্য গন্তব্যের পথে কেবলই ভেসে থাকা।
অন্তরার খুব ইচ্ছে হয় ভাইয়াকে জোর করে কানাডায় পাঠিয়ে দিতে। নিদেন পক্ষে সাবধান করা তো যায়। সে ফোনটা হাতে নিল। ভাইয়ার নম্বরগুলো টিপলো। সেকি! হাত কাঁপছে কেন? অন্তরা প্রবল ভয়ে ফোন রেখে দিল।
ঠিক সেই সময়ে অন্তরার নয়, অন্য কারো হাতের স্পর্শে আমার ফোন শব্দ করে জেগে উঠেছে। কেউ একজন মনে হয় এসএমএস করেছে। বার বার বিট দিচ্ছে। এই মধ্যরাতে কার এসএমএস? ক্ষুদে বার্তায় মাত্র তিনটি শব্দ: ‘এসওএস’। নীচে একটি নোট: ‘মুছে ফেলুন: আর’।
আমার ঠোঁটে হালকা হাসির রেখা অস্পষ্ট বিদ্যুৎ চমকের মতো ঝলক দিয়ে মিলিয়ে গেল। তাহলে যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে। রণাঙ্গণে প্রবল বিপদের মধ্যে ‘এসওএস’ বার্তা পাঠানো হয়। এই যুদ্ধে আমি জিতবোই। কারণ গোপন বার্তাটা এসেছে শত্রুপক্ষের কাছ থেকে। সেখানেও আমার মিত্র আছে। একটা ভালো লাগার সুরভী মাখা বাতাস ছুঁয়ে গেল আমাকে। একাকিত্ব, নিঃসঙ্গতা, না-পারার বেদনাবহ চাপটি মনে হচ্ছে কেটে যাচ্ছে। আমি তাহলে একা নই! সংগোপনে হলেও আমার সঙ্গে কেউ একজন আছে। কে সে? আমি উন্মুখ অপেক্ষা করে আছি: তার সঙ্গে দেখা হবে একরাশ পলাশ ফুলের মধ্যে। আগুনের অনেক স্ফুলিঙ্গে। চলবে।
বাংলাদেশ সময়: ১৩১০ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ১০, ২০১৭
জেডএম