২৪.
মহাবিরক্ত কণ্ঠে ফোন করেছে এনামুল:
-কি হয়েছে তোর? বলেছি না আমাকে না বলে কোথাও যাবি না!
আমি চুপ করে রইলাম। জানি, আমার গতিবিধি এনামুলের জানা।
এনামুলের রাগ যেন কমছেই না। সে বললো:
-আস্ত একটা দিন তুই ঢাকা শহরে ছিলি না। রাত-বিরাতে পার্কে-মাঠে-নির্জন জায়গায় আজেবাজে লোকের সঙ্গে পড়ে আছিস। দেশের অবস্থা জানিস না?
আমি সোজাসুজি জানতে চাই:
-কেন? কি হয়েছে?
এখনও রেগে আছে সে। রাগত স্বরেই বললো:
-আবার কি হয়েছে? আইন-শৃঙ্খলার বারোটা বেজেছে। এখানে এখন পাঁচ শ’ টাকায় মানুষ খুন করা যায়।
কারা আইন-শৃঙ্খলার বারোটা বাজাতে কল-কাঠি নাড়ছে, সেটা ইচ্ছে করেই জানতে চাইলাম না। স্পষ্ট গলায় বললাম:
-আমাকে খুন করবে কে? কেন করবে? আমার তো এসব বিষয়ে চিন্তার কিছু নেই।
আমার সরাসরি কথায় এনামুল থমকে গেল। ওর ঢোক গেলার অস্পষ্ট শব্দ পেলাম। সে এবার গলা নামিয়ে বললো:
-নেশা-ভাঙের জন্য টাকার জন্য মাদকাসক্তরা যে কাউকে পেলেই আজকাল ছিনতাই করে। কিছু না পেলে রাগে মেরেই ফেলে। থাক সে কথা। আবার কোথাও গেলে আমাকে বলে যাবি? কেমন?
আমি ওকে শান্ত করার জন্য কথা আর না বাড়িয়ে বাধ্য ছাত্রের মতো বলি:
-আচ্ছা।
এনামুল কিছুটা শান্ত হয়েছে বোধ হয়। বেশ নর্ম্যালি জিজ্ঞেস করলো:
-তা সামনে কোথায় যাওয়ার পরিকল্পনা তোর?
আমি ধীরে ধীরে বললাম:
-সীমান্তে। বর্ডার এলাকায়।
ক্ষেপে উঠতে সময় লাগল না এনামুলের। আবার রাগত স্বরে বললো:
-সীমান্তে মানে? যুদ্ধ করবি? কার সঙ্গে লড়াই করবি? ওখানে তো যুদ্ধ চলছে না?
ওর ব্যাঙ্গাত্মক উক্তিতে কান না-দিয়ে আমি বলি:
-প্রকাশ্য কোনও যুদ্ধ চলছে না বটে, নীরব যুদ্ধ চলছে।
আমার কথা সে বুঝতে পারে নি। জানতে চাইলো:
-তার মানে?
আমি ব্যাখ্যা করে বলি:
-এই যে নানা ধরনের মাদক, অস্ত্র আসছে। নারী-শিশু পাচার হচ্ছে। চোরাই মাল এসে দেশের অর্থনীতি তছনছ করে দিচ্ছে। শিল্পায়ন হতে পারছে না। কর্মসংস্থান নস্যাৎ হচ্ছে। তরুণ সমাজ, বেকার, হতাশ ও নেশাগ্রস্ত হচ্ছে। সন্ত্রাস-রক্তপাত-অস্ত্র সমাজ-সংসার ভাসিয়ে দিচ্ছে-এটা যুদ্ধ না? এটা যুদ্ধের চেয়েও বড়।
সে দাঁত কটমটিয়ে বললো:
-কারা করছে এসব?
আমি স্পষ্ট বলে দিলাম:
-তুই, আমি, সবাই। যারা বাধা দিচ্ছি না, তারা সবাই যুদ্ধ করছি নিজের বিরুদ্ধে।
আবার ব্যাঙ্গের ছাপ এনামুলের গলায়। সে বললো:
-তুই কি যুদ্ধাপরাধের নতুন সংজ্ঞা দিচ্ছিস নাকি?
আমি ওর তরল কথায় কান না দিয়ে সিরিয়াসলি বলি:
-না। পরিস্থিতির ভয়াবহতা ব্যাখ্যা করছি মাত্র। তোকে বুঝাতে চেষ্টা করছি, কেন আমার সীমান্তে যাওয়া দরকার।
এবার এনামুল জানতে চাইলো:
-তুই গিয়ে কি করবি? কি করতে পারবি?
আমি উদাস কণ্ঠে বলি:
-জানি না।
এনামুল আমাকে জ্ঞান দানের স্টাইলে বললো:
-তোরা, মাস্টারদের নিয়ে এই হলো বিপদ। সমস্যা নিয়ে চিৎকার করবে, এটা-ওটা ধরে টানাটানি করবে, একে-ওকে দোষ দেবে, সমাধানের বেলা লবডঙ্কা। কাঁচকলাও করতে পারে না।
অপমান গায়ে মাখার সময় নয় এখন। এনামুল আমাকে উত্তেজিত করে বেপথু করতে চাইছে। আমার লক্ষ্যে পৌঁছুতে সে নানাভাবে বিঘ্ন সৃষ্টি করবেই। আমাকে নিয়ে তার যদি কোনও ভয়ই না থাকে, তাহলে কোথায় যাই, কি করি, কার সঙ্গে কথা বলি, এসব নিয়ে ওর অত মাথা ব্যথা কেন? ছায়ার মতো আমার কাজকে অনুসরণ করছে কেন সে?
এনামুল এবার বেশ নরম গলায় বললো:
-আসলে তুই কি চাস, আমি ঠিক বুঝতে পারছি না। উপন্যাস লিখতে চাইলে এতো ছুটাছুটি কেন? গবেষণা করতে চাইলে ভার্সিটির লাইব্রেরিতে পড়ে থাক। তুই গোয়েন্দাদের মতো কি ইনভেস্টিগেশন করছিস, বল তো?
আমি নির্লিপ্ত গলায় বলি:
-কিছু না। যদি কিছু পাই, তোকে জানাবো সবচেয়ে আগে।
এনামুল আমার কথায় আমল দিল না। বললো:
-হেঁয়ালী করিস না। কাজের সময় হেঁয়ালী আমার একদম ভালো লাগে না। তুই নিজেও বিপদে পড়বি, আমাদেরকেও ফেলবি।
এনামুলের সঙ্গে তর্ক করা বৃথা। ওর লাইন আর আমার লাইন সম্পূর্ণ পৃথক। ও যা আড়াল করতে চায়, আমি সেটা প্রকাশ করতে চাচ্ছি। দ্বন্দ্ব অনিবার্য। স্বার্থ কাউকে রেয়াত দেয় না। না আমাকে, না এনামুলকে। আমার স্বার্থ আমার কাছে যেমন জরুরি, এনামুলের স্বার্থও তার কাছে তেমনই গুরুত্বপূর্ণ। ওকে দোষ দিয়ে লাভ নেই। সে তার স্বার্থের দিকে, বিশ্বাসের পথে এগুবেই। আমিও আমার দিকে যাবোই। আমরা লড়াই চালাতে পারি নিজ নিজ স্বার্থ রক্ষার্থে। কিংবা শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান বজায় রেখে যার যার পথে স্বার্থটাকে হাসিল করতে পারি। জানি, যে পথেই যাই না কেন, স্বার্থের দ্বন্দ্ব-সংঘাত হবেই। লড়াইটাও গোপন বা অপ্রত্যক্ষ থাকবে না। আমি আগ বাড়িয়ে লড়াইটাকে এখনই সামনে আনার পক্ষে নই। কখনও কখনও কৌশলগত পশ্চাৎপদসরণ মানে পরাজয় নয়। আমি অনেক ভেবে এনামুলকে বলেই ফেলি:
-ঠিক আছে, তুই কি চাস, বল?
অবাক করা শান্ত গলায় এনামুল সঙ্গে সঙ্গে বলল:
-দোস্ত মাইন্ড করিস না। সমাজের হাজার জটিলতা, ক্ষমতার যোগ-বিয়োগ, সম্পদের লাভ-ক্ষতি, ন্যায়-অন্যায়ের আড়াল-আবডাল তৈরি করে তবেই আমি আজকের এই সুস্থির ও সম্মানের জায়গায় এসেছি। এই অর্জনের পিছনে বহু কালো দাগ আগে, অপরাধ আছে, পাপের ময়লা আছে। আমরা মতো এমন কুৎসিত হাজার হাজার মানুষ ধন-সম্পদ-ক্ষমতার সৌধ বানিয়ে সবার মাথার উপর বসে আছে। সমাজ, রাজনীতি, অর্থনীতি চালাচ্ছে। ওরা কেউ চাইবে না সুখের সৌধ ভেঙে যাক, সম্মান ধুলায় লুটাক। নিজেকে রক্ষা করার স্বার্থে, নিজের প্রতিপক্ষ ও বিপদকে হটাতে তারা যা কিছু করতে প্রস্তুত। এখানে ন্যায়-অন্যায়বোধের কোনও জায়গা নেই। নিজের ইন্টারেস্টই আসল। তুই এই দুষ্টচক্রে আঘাত করিস না। টিকতে পারবি না। শেষ হয়ে যাবি।
আমিও একই রকম শান্ত কণ্ঠে বলি:
-তোকে ধন্যবাদ। মহাধান্ধাবাজ হলেও তুই তোর মনের কথাটা শেষ পর্যন্ত অকপটে বলেই দিলি। আচ্ছা, তুই কি আমাকে ভয় দেখাচ্ছিস?
কোনওই উত্তেজনা দেখালো না এনামুল। আগের মতো শান্ত গলায় বললো:
-তোকে ভয় দেখাবো কি রে! তুই ভয় পাওয়ার লোকই না। যার কিছু হারানোর ভয় থাকে, তাকে ভয় দেখানো যায়। তুই তো যে কোনও সময় সব কিছু ত্যাগ করতে পারিস। নীতির প্রশ্নে তুই বাবা-মা-পরিবার-পরিজন, কাউকেই পরোয়া করিস না। আমার চেয়ে ভালো তোকে আর কে জানে!
আমি এনামুলের মনোভাব জানতে প্রশ্ন করি:
-তাহলে?
সে বললো:
-আমি তোর জন্য চিন্তা করছি। কখনও এমন সময় আসে যে মানুষ কিছু করার ক্ষমতা হারায়। কিংবা প্রচণ্ড অপছন্দের কাজ করতে বাধ্য হয়। আমি তোকে নিয়ে এমন ভয়ানক বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়তে চাই না।
ওর আন্তরিকতাকে মূল্য দিয়ে আমি বলি:
-বল, আমাকে কি করতে হবে?
মনে হলো খুশি হয়েছে সে। খুশি খুশি গলায় বললো:
-মাই গুড ফ্রেন্ড! চুপচুপ থাক আর আরাম করে দিন কাটা। কি লাগবে আমাকে শুধু একবার বল। সব হাজির করে দিচ্ছি। লেখালেখি কর। লেজার ট্রিপে ঘুরে ফিরে দেখ পুরো দেশ। কোনও অসুবিধা নেই। আন্ডার ওয়ার্ল্ডের অপরাধ জগত, ড্রাগস, আমর্স ব্যবসা নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করিস না। এই লাইনে টোকাই সাপ্লাইয়ার থেকে উচ্চ ক্ষমতাবান পর্যন্ত বহুজন সরাসরি জড়িত। একজনকে টান দিলে সবাই এসে যাবে। স্বার্থের সুতায় সবাই বাধা। আর শোন। এখানে সবাই মামার মতো নয়। বাগে পেলে তোকে ছাড়বে না।
আমি অবাক হয়ে বলি:
-মামার কথা তুই জানলি কি করে?
এনামুল বিজ্ঞের হাসি হেসে বললো:
-জানি জানি। মামাগিরি করতে করতেই তো ‘বড়মামা’ হয়ে এ পর্যন্ত এসেছি। সব মামাই প্রমোশন পেয়েছে। শুধু শফি মামাটা যেখানে ছিল সেখানেই আটকে আছে। বেচারা একটা আস্ত বাউল। আধুনিক লালন সাঁই বাবা! তোর কপাল ভালো যে ওর হাতে পড়েছিলি। ঢাকা শহরের কয়েক শ’ মামার মধ্যে অন্য কারও আস্তানায় চলে গেলে আর ফিরে আসতে হতো না।
আমি প্রসঙ্গ বদলে বলি:
-ঠিক আছে। আমি তোর কথাই মানছি। আমার কাজ যতটুকু হয়েছে, তাতেই আমার প্রজেক্ট শেষ করে ফেলবো। তবে আমার একটি শর্ত আছে।
অনেকক্ষণ পর এনামুলের শান্ত গলার বদলে অবাক স্বর শোনা গেল:
-শর্ত? এখানে শর্তের কথা আসছে কেন?
আমি ব্যাখ্যা করে বলি:
-ঠিক শর্ত না। আমার ইচ্ছে বলতে পারিস। ফাঁসির আসামি দড়িতে ঝোঁলার আছে শেষ ইচ্ছা প্রকাশ করে না? সে রকম ধরে নে।
এনামুল অস্থির হয়ে জানতে চায়:
-আহা এত কথার দরকার কি? বল কি চাস?
আমি স্পষ্ট গলায় বলি:
-আমি সীমান্তে যাবোই। এরপর আর কোথাও যাওয়ার কথা বলব না।
আমার কথায় এনামুল চুপ মেরে গেলো। মনে হলো, সে যেন ফোন লাইনেই নেই। ওর শ্বাস-প্রশ্বাসের আঁচ পর্যন্ত পাওয়া যাচ্ছে না। অখণ্ড নীরবতা ফোনে। পাক্কা তিন মিনিট পর এনামুল শব্দ করলো:
-ঠিক আছে। তবে আমারও একটি শর্ত আছে!
আমি বিস্ময় চেপে রাখতে না পেরে জানতে চাই:
-কি শর্ত তোর?
আমাকে বাকরুদ্ধ ও স্তব্ধ করে দিয়ে এনামুল বলল:
-আমিও তোর সঙ্গে যাবো।
বাংলাদেশ সময়: ১০১০ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ১৮, ২০১৭
জেডএম/