মানুষের ৪৫ লাখ বছরের ইতিহাসে অধিকাংশ সময়ই কেটেছে টিকে থাকার জন্য বিবর্তন আর নানা কৌশল আবিষ্কার করে। যদিও মানব বা হোমো প্রজাতিতে রূপান্তরের অল্পদিনের মধ্যেই পৃথিবীর নেতৃত্ব দখলে নিতে পেরেছে, কিন্তু প্রতিকূল পরিবেশ ও জলবায়ু আর হিংস্র প্রাণী এমনকি স্বজাতিদের বিরুদ্ধে লড়তে হয়েছে।
আর এ প্রয়োজন থেকেই পাথরের অস্ত্র তৈরি ও ব্যবহার শুরু করে প্রাগৈতিহাসিক মানুষেরা।
আফ্রিকা মহাদেশের বিভিন্ন স্থানে পাওয়া জীবাশ্ম পরীক্ষা করে বিজ্ঞানীরা জানাচ্ছেন, প্রস্তর যুগে মানুষের প্রজাতি হোমো স্যাপিয়েন্সের অন্তত চার/পাঁচ প্রজাতি আগের পূর্বপুরুষ অ্যানামেনসিস্ বা কেনিঅ্যানথ্রোপাস প্লেটিওপস্রা পাথর ছোঁড়া বা সরবরাহ শুরু করে, যারই ধারাবাহিকতায় অস্ত্রের ব্যবহার শুরু হয়।
আজ থেকে সে সময়ের ব্যবধান কিন্তু কম নয়, পাক্কা ৩৫ লাখ বছর!
বিজ্ঞানীরা আরও জানান, আধুনিক হোমো স্যাপিয়েন্সদের সমসাময়িক বিলুপ্ত মানব হোমো নিয়ান্ডারথ্যালেন্সিস বা নিয়ানডার্থালদের সময়ে অস্ত্রের ব্যাপক উন্নতি হয়। আদি পূর্বপুরুষদের অস্ত্রগুলোকে অ্যাকুইলিয়ান (হাতে ব্যবহার্য কুড়াল জাতীয়), নিয়ানডার্থালদের অস্ত্রগুলোকে মুস্টিয়ারিয়ান এবং আধুনিক মানুষদের অস্ত্রগুলোকে লেভালয়িস বলা হয়।
লক্ষ্যণীয় যে, বিবর্তনের ধারায় আসা মানুষের বিভিন্ন প্রজাতি ও তাদের ব্যবহৃত অস্ত্রশস্ত্রের অধিকাংশ জীবাশ্ম আবিষ্কৃত হয়েছে ৪৫ লাখ বছর আগে সৃষ্ট (বর্তমানে মৃত) তুরকানা হ্রদ থেকে। উত্তর কেনিয়ার মরুভূমি হ্রদ তুরকানা যেন এক প্রাগৈতিহাসিক মানবহ্রদ, যেটি মানব প্রজাতির সমগ্র বিবর্তনের ইতিহাস ধারণ করে আছে।
তুরকানায় আবিষ্কৃত ৩২ লাখ বছর বয়সী হোমো অস্ট্রালোপিথেকাস অ্যাফারেনসিস্কেই (ডাকনাম লুসি) এর আগে অস্ত্রের প্রথম ব্যবহারকারী বলে ধারণা করা হচ্ছিল। কিন্তু ১৯৯০ সালে লুসি প্রজাতির পূর্বপুরুষ অস্ট্রালোপিথেকাস অ্যানামেনসিস্ আবিষ্কৃত হয়, যারা ৪০ লাখ বছর আগে থেকেই বেঁচে ছিল। কয়েক বছর পরে, হ্রদের পশ্চিমে আরেকটি নতুন প্রজাতি কেনিঅ্যানথ্রোপাস প্লেটিওপস্ বা ‘সমতল মুখবিশিষ্ট মানুষ’ আবিষ্কৃত হয়, যারা ৩৫ লাখ বছর আগে লুসি প্রজাতির অন্য সদস্যদের সঙ্গেই বসবাস করতো। ২০১৫ সালের গ্রীষ্মে গবেষকরা প্রাচীনতম পাথর সরঞ্জাম ও অস্ত্র আবিষ্কারের কথা ঘোষণা করেন। গবেষণা করে জানা যায়, সেগুলো ৩৩ লাখ বছর আগের এবং কেবল হোমো প্রজাতির পাথর সরঞ্জাম হতে পারে বলে ধারণা করা হয়েছিল। কিন্তু পরে বোঝা যায়, সরঞ্জামগুলো কোনো পরিচিত হোমো জীবাশ্মের চেয়ে পুরনো ছিল, যা অ্যাফারেনসিস্ বা প্লেটিওপসের মতো পুরনো প্রজাতির হতে পারে।
গবেষণায় আরও জানা গেছে, অ্যাকুইলিয়ান নামে পরিচিত অস্ত্রগুলো পুরোপুরি আধুনিক মানুষ হোমো স্যাপিয়েন্স তৈরি করেনি, আদি আধুনিক (অন্তর্বর্তীকালীন) হোমো স্যাপিয়েন্সের আইডিয়াল্টু বা হেরতোম্যান করেনি, প্রোটো- নিয়ানডার্থাল প্রজাতিরাও করেনি। সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য যে, তুরকানায়ই পাওয়া হোমো ইরেক্টাস বা এটা হোমো ইরগাস্টার (কখনও কখনও বলা হয় আদি হোমো ইরেক্টাস) ও তার স্বজাতিরা প্রায় একচেটিয়াভাবে অ্যাকুইলিয়ানের কৌশল ব্যবহার করে, তারাও এর উদ্ভাবক নয়। পরবর্তীতে সংশ্লিষ্ট প্রজাতি হোমো হাইডেলবার্গেনসিস (নিয়ানডার্থাল ও হোমো স্যাপিয়েন্সের সাধারণ পূর্বপুরুষ) প্রজাতিতে এটি ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়। তারাও তৈরি না করায় অ্যানামেনসিস্ ও প্লেটিওপস্দেরকেই এ আবিষ্কারের কৃতিত্ব দেন গবেষকরা।
অবশ্য ২০১১ সালে তুরকানা হ্রদ থেকেই নিকটতম হাতে ব্যবহার্য কুড়াল হিসেবে পরিচিত অ্যাকুইলিয়ান আবিষ্কৃত হয়। ১৭ লাখ ৬০ হাজার বছরের পুরনো এবং সম্ভবত হোমো ইরেক্টাসদের তৈরি এ অস্ত্রটিও মানোন্নিত বলে প্রমাণিত হয়েছে।
এর পরের ধাপে প্রথমবারের মতো দুই ধরনের অস্ত্র বানায় নিয়ানডার্থালরা। শিকারের জন্য অনেক ভারি বর্শা ব্যবহার করতো তারা। বর্শা নিক্ষেপ না করে তারা কাছ থেকে সজোরে শিকারের দেহে ঢুকিয়ে দিতো। এমন ভারি বর্শা দিয়ে কাছ থেকে শিকারের মতো দৈহিক শক্তিও তাদের ছিল। অপেক্ষাকৃত হালকা অস্ত্র তৈরি করতেও শিখেছিল তারা। কাঠের আগায় ধারালো পাথর বেঁধে সেটি নিক্ষেপকের মাধ্যমে ২০-৪০ মিটার দূরত্বে ছুড়তে পারতো।
বাংলাদেশ সময়: ০২৫০ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১৫, ২০১৬
এইচএ/এএসআর