৩৬ লাখ ৬০ হাজার বছর আগের অস্ট্রালোপিথেকাস প্রজাতির মানবরা আমাদের প্রথম ও আদি পূর্বপুরুষ। আর ১৯ লাখ বছর আগে উদ্ভুত ইরেক্টাস আমাদের সরাসরি পূর্বপুরুষ, যাদের থেকে স্যাপিয়েন্সরা বিবর্তিত হয়েছে।
কেননা, এখন পর্যন্ত হোমো নালেদি প্রজাতির সঠিক বয়স নির্ণিত না হলেও পর্যালোচনা করে বিজ্ঞানীরা জানান, প্রায় ৩০ লাখ থেকে ২৫ লাখ বছর আগে তাদের বিচরণ ছিল দক্ষিণ আফ্রিকার গুহায়।
২০১৩ সালে দেশটির রাইজিং স্টার গভীর গুহাশ্রেণীর মধ্যে মানুষের এই পূর্বপুরুষ প্রজাতিটিকে আবিষ্কার করেন দক্ষিণ আফ্রিকার জোহানেসবার্গের ইউনিভার্সিটি অব উইটওয়াটারসর্যান্ডের বিজ্ঞানীরা। জোহানেসবার্গ থেকে ৫০ কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের খুবই দুর্গম ওই গুহাশ্রেণীর ভেতরের এক জায়গায় একইসঙ্গে ১৫ দেহের প্রায় দেড় হাজার পূর্ণাঙ্গ কঙ্কাল প্রায় অক্ষত অবস্থায় পান তারা।
জীবাশ্মগুলো আবিষ্কারের পর থেকে গত তিন বছর ধরে গবেষণা করে চলেছেন বিজ্ঞানীরা। এখন পর্যন্ত পাওয়া তথ্য-প্রমাণে বিজ্ঞানীদের মন্তব্য, মানুষের সঙ্গে সব ধরনের বৈশিষ্ট্যে অদ্ভুত মিল থাকা এ হোমিনিনরা বিবর্তনের গাছে একটি নতুন শাখা যোগ করেছে। এরা ইরেক্টাস ছাড়াও সমসাময়িক নিয়ান্ডারথাল এবং আমাদের স্যাপিয়েন্সদের মাঝের একটি প্রজাতি বলেও ধারণা তাদের।
এসব জীবাশ্ম আবিষ্কার মানুষের বিবর্তন সম্পর্কিত ইতিহাস ও জ্ঞানকে অনেক সমৃদ্ধ করছে বলেও জানান বিজ্ঞানীরা।
বিজ্ঞানীরা আরও জানান, নালেদিদের হাত ও পায়ের গড়নের সঙ্গেও আধুনিক মানুষ স্যাপিয়েন্স বা আদি আধুনিক ইরেক্টাসদের অনেক মিল পাওয়া গেছে। প্রাপ্তবয়স্কদের উচ্চতা ও ওজন ছিল প্রায় যথাক্রমে চার ফুট ১০ ইঞ্চি থেকে পাঁচ ফুট ও ১০০ থেকে ১১০ পাউন্ড, যা আমাদের ও ইরেক্টাসদের গড় উচ্চতার কাছাকাছি। আবার তাদের ধড় ও কাঁধের গড়ন অস্ট্রালোপিথেকাসসহ পুরনো প্রজাতিগুলোর সঙ্গে বেশি মিলে যায়। এমন ছোট কাঁধ নির্দেশ করে যে, তারা কোনো গাছ, পাহাড় বা উঁচু স্থানে উঠতে পারদর্শী ছিল।
হোমিনিনদের মধ্যে প্রাচীনতম লুসি বা অস্ট্রালোপিথেকাসরা গড়ে ৩ ফুট ৮ ইঞ্চি থেকে চার ফুট উচ্চতা ও ৬০ থেকে ৬৫ পাউন্ড ওজনের হতো। তবে নালেদিদের মস্তিষ্কের আকার ছিল অনেক ছোট, মাত্র ২৭ থেকে ৩৪ ঘনইঞ্চি, যা অস্ট্রালোপিথেকাসদের সঙ্গে বেশি মিলে যাচ্ছে।
এসব দেখে ধারণা করা হচ্ছে, এরা প্রজাতি হিসেবে আমাদের কাছাকাছি ছিল। আর তারা অস্ট্রালোপিথেকাসদের পরের এবং আমাদেরসহ ইরেক্টাস-ইরগ্যাস্টার ও সমসাময়িক নিয়ান্ডারথালদের আগের ধাপ হিসেবে নালেদিরা বিজ্ঞানীদের কাছে বিবেচিত হবে- এটিই ছিল স্বাভাবিক।
কিন্তু বেশ কিছু বৈশিষ্ট্যের কারণে বিজ্ঞানীরা এটি বলতেও বাধ্য হচ্ছেন যে, প্রাগৈতিহাসিক এ মানবেরা আমাদের আধুনিক এবং আমাদের সরাসরি পূর্বপুরুষ, এমনকি আদি আধুনিক কোনো গোত্রেরও সদস্য নয়।
তবে সবচেয়ে বিষ্ময়কর যেসব সাদৃশ্যের প্রমাণ পেয়েছেন বিজ্ঞানীরা, তার একটি হচ্ছে, কেউ মারা গেলে একটি নির্দিষ্ট গুহায় কবর দেওয়া হতো, অর্থাৎ, সেটি ছিল তাদের কবরস্থান। আবার এমন অন্ধকার ও দুর্গম গুহায় আলো নিয়ে ঢুকেছিল হোমো নালেদিরা। তাইতো মনে করা হচ্ছে, আগুন আবিষ্কার ও নিয়ন্ত্রণেও আনতে পেরেছিল তারা।
গুহায় ঢোকার মুখ বা দরজা ছিল মাত্র একটাই, তাও আবার মাত্র ১২ মিটার চওড়া। ভেতরে এতোগুলো কঙ্কাল দেখেই বিজ্ঞানীরা বলছেন, গুহাটি নালেদিদের কবরস্থান বা সৎকারের জায়গা। গোত্রের সদস্যরা মারা গেলে তাদেরকে এখানে কবর দেওয়া হতো।
কিন্তু হোমো নালেদিরা ইরেক্টাস-ইরগ্যাস্টার, এমনকি আমাদের মতো অভিবাসনকারী মানব গোত্র ছিল না। তাই তারা পাথর-আগুনের ব্যবহার বা সৎকার প্রথা অন্য কারো কাছ থেকে পায়নি, এটি এখন নিশ্চিত। আবার এতোদিনকার ধারণা ছিল, এসবের সূচনা ঘটেছে আরও অনেক পরে থেকে (প্রাথমিক প্লেইস্টোসিন সময়ে আদি আধুনিক প্রজাতির মানুষদের থেকে)।
সবকিছু বিচার-বিবেচনা করে জীবাশ্মবিদরা বলছেন, আরও ব্যাপক-বিস্তৃত গবেষণা গত অর্ধ শতাব্দীর মধ্যে সবচেয়ে বড় জীবাশ্ম আবিষ্কারের এ ঘটনা মানুষের বিবর্তন বোঝার ক্ষেত্রে যুগান্তকারী ভূমিকা রাখবে।
হতে পারে, এটি বিবর্তনের মিসিং লিঙ্ক পূরণ করবে।
বাংলাদেশ সময়: ০৪৩৭ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১১, ২০১৭
এএসআর