সভ্যতার ঊষালগ্ন থেকেই মানব প্রজাতি ও অন্য প্রাণীদের বিবর্তনেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে ডুমুর গাছ।
ফিকাস বা অশ্বত্থ মহাজাতির অন্তর্ভূক্ত ডুমুর গাছের ৭৫০টির বেশি প্রজাতি রয়েছে।
পাকা ডুমুর সারা বছর পাওয়া যায়। প্রকৃতপক্ষে, ডুমুর ফল অন্য কোনো ফলের চেয়ে বন্যপ্রাণীদের অনেক প্রজাতিকে বেশি টিকিয়ে রেখেছে। কেননা, পৃথিবীর সকল পাখির এক-দশমাংশ বা ১ হাজার ২০০ এর বেশি প্রজাতি, প্রায় সব ফল-বাদুড় এবং কয়েক ডজন স্তন্যপায়ী প্রাণী ডুমুর খেয়ে তাদের বীজ ছড়িয়ে দেয়। বাস্তুবিদরা তাই ডুমুরকে প্রাণীদের ‘প্রধান খাদ্য সংস্থানকারী’ ফল হিসেবে উল্লেখ করেন।
এ পাকা ডুমুর আমাদের প্রাগৈতিহাসিক পূর্বপুরুষ মানব প্রজাতিগুলোকে বাঁচিয়ে রাখতে সহায়তা করেছিল। উচ্চ শক্তিসম্পন্ন ডুমুর তাদের বড় মস্তিস্কের বিকাশও ঘটায়।
অন্য একটি তত্ত্বে বলা হয়েছে, নরম, মিষ্টি ও শক্তি সমৃদ্ধ ডুমুর আমাদের হাতকে হাতিয়ার হিসেবে বিবর্তিত করেছে। প্রথম মানুষেরা ডুমুর থেকে উপকৃত হলে তাদের বংশধররাও এটি আয়ত্ত করে। যদিও অশ্বত্থ প্রজাতির ঘরকুনো উদ্ভিদগুলো থেকে কয়েক হাজার বছর আগে প্রথম শক্তি আহরণ শুরু করে মানুষ।
এর বীজ পাখি ও স্তন্যপায়ী প্রাণীরা পরিবহন করে দূর-দূরান্তে ছড়িয়ে দিলেও অন্য গাছ ডুমুরের চেয়ে উচ্চ হয়। পরিবর্তে তার পাতা-ডালপালা ওপরের দিকে বন শামিয়ানা হিসেবে বাড়তে শুরু করে। উচ্চ শক্তি সম্পন্ন ডুমুরের চারার প্রাণশক্তির জন্য যে আলোর প্রয়োজন, তারা সংগ্রহ করে। তারা পুরু খেঁচর শিকড় সমৃদ্ধ ও অরণ্যময় হয়ে ওঠে। একটি জীবন্ত জাল তাদের আশ্রয় দানকারী গাছকে বেধে ফেলে। উচ্চ শক্তির ডুমুর এভাবে এমনকি দৈত্যাকার গাছগুলোকে মেরে ফেলেও নিজেরা টিকে থাকতে পারে।
ছোট পোকা-মাকড়দের ডুমুরে প্রবেশ ও বের হতে দেখেছেন বিজ্ঞানীরা। তাদের এ ঘটনা জীববিজ্ঞানের সবচেয়ে অভূতপূর্ব হতে পারে। বিজ্ঞানীরা উপলব্ধি করেছেন, প্রতিটি ফিকাস প্রজাতির নিজস্ব পরাগ বহনকারী বোলতা রয়েছে, যার সহায়তায় ২০০০ বছরের বেশি সময় টিকে থাকতে পারে তারা। একইভাবে, প্রতিটি ডুমুর গাছের বোলতা প্রজাতি শুধুমাত্র তার অংশীদার ডুমুরের ফুলে তার ডিম পাড়তে পারে।
এ সম্পর্ক ৮০ মিলিয়ন বছর আগে ডুমুরের উদ্ভবকাল থেকে শুরু হয়েছে। ফিকাস প্রজাতির ডুমুর বছরজুড়ে ফল উৎপাদন নিশ্চিত করতে তাদের পরাগ বহনকারী টেকসই বোলতা উৎপাদনেও সহায়ক হয়। না হলে ফলাহারী পশু-প্রাণীদের সারা বছরের জন্য খাদ্য খুঁজে পেতে দুর্দান্ত সংগ্রাম করতে হতো।
দীর্ঘদিন আগে ডুমুর মিশরীয় কৃষির একটি প্রধান অবলম্বন ছিল। কৃষকরা ডুমুরের উৎপাদন, সম্প্রসারণ এমনকি বিবর্তনের মাধ্যমে তাদের খাদ্য ও ফসলকে সমৃদ্ধ করে। প্রাচীন ওই মিশরীয়রা ফিকাস সাইকোমোরাস নামের একটি প্রজাতির চাষাবাদ শুরু করে, যার পরাগ বহনকারী বোলতা স্থানীয়ভাবে বিলুপ্ত ছিল। ফলে এ প্রজাতির পাকা ডুমুর দুর্লভ ছিল। কিন্তু প্রতিভাবান কৃষকরা একটি ফলকের সঙ্গে গভীর ক্ষত তৈরির মাধ্যমে দ্বারা এর ডুমুর পাকাতে সক্ষম হয়। এমনকি প্রশিক্ষিত বানরের সহায়তায় এ গাছকে নতুনভাবে বিকশিত ও বিবর্তিত করে।
ব্রিটিশ জীববিজ্ঞানী আলফ্রেড রাসেল ওয়ালেস মালয় দ্বীপপুঞ্জ জুড়ে আট বছরব্যাপী একের পর এক দীর্ঘ দুঃসাহসিক অভিযান চালান। তিনি শক্তিসম্পন্ন ডুমুরকে ‘বনের সবচেয়ে অসাধারণ গাছ’ হিসেবে অভিহিত করেছেন। ডুমুরের টিকে থাকার প্রাণশক্তি তাকেও অস্তিত্বের সংগ্রামে অনুপ্রাণিত করেছে। এ প্রজাতির ডুমুরকে প্রাকৃতিক নির্বাচনের মাধ্যমে চার্লস ডারউইনের বিবর্তন তত্ত্বকে স্বাধীনভাবে বিকশিত ও প্রমাণিত করেন তিনি।
কিন্তু এই ইউরোপীয় অভিযাত্রীর সমুদ্রপথ ভ্রমণের অনেক আগে থেকেই শক্তিমত্তার ডুমুর মানুষের মন ও হৃদয় জয় করে বসে ছিল।
বাংলাদেশ সময়: ০১০২ ঘণ্টা, জানুয়ারি ২৩, ২০১৭
এএসআর