পশ্চিম বঙ্গের কলকাতা বন্দরের কাছে হুগলি নদীতে প্রচুর পরিমাণে পলি জমার কারণে ভারত ফারাক্কা বাঁধ নির্মাণের পরিকল্পনা করে। ১৯৫০—১৯৬০ দশকে নদীর তলদেশের জমা পলি বড় ধরনের সমস্যা তৈরি করায়, এই পলি ধুয়ে সরিয়ে দেওয়ার উদ্দেশ্যে ফারাক্কা নামক স্থানে গঙ্গা নদীর উপর বাঁধ তৈরি করে ভারত (বাঁধটি নির্মাণ কাজ শুরু হয় ১৯৬১ সালে, আর শেষ হয় ১৯৭৫ সালে)।
সোজা-কথা, এই বাঁধের প্রধান উদ্দেশ্য ছিল জলের অভাবে হারিয়ে যেতে বসা গঙ্গার শাখানদী ভাগীরথীকে পুনরায় গঙ্গার জলে ভরিয়ে তোলা। আর সে কাজটি করতে গিয়ে ভারত বাংলাদেশকে রীতিমত মরণ ফাঁদে ফেলেছে। যার কারণ বাংলাদেশের জনগণ তা সহজভাবে মেনে নিতে পারেনি। ফারাক্কার প্রভাবে বরেন্দ্র অঞ্চল মরুকরণের দিকে ধাবিত হচ্ছে।
ফারাক্কা বাঁধের ইস্যু বাংলাদেশে দীর্ঘদিন চাপা থাকলেও পুনরায় ২০১৬ সালে আলোচনায় এসেছে বিহারের মুখ্যমন্ত্রী ‘নীতিশ কুমার’—এর দাবির পরিপ্রেক্ষিতে। বাঁধটি যে বাংলাদেশ তথা বিহার প্রদেশের জন্যে হুমকি, সেটি স্পষ্ট হয়েছে বিহারের মুখ্যমন্ত্রীর বক্তব্যে।
দেরিতে হলেও তিনি উপলব্ধি করেতে পেরেছেন ফারাক্কা বাঁধের কুফলের বিষয়টি। অযাচিতভাবে নদী শাসন যে সুফল বয়ে আনে না, তার প্রমাণ দেওয়ার চেষ্টা করেছেন তিনি। ভারতের প্রধানমন্ত্রী ‘নরেন্দ্র মোদি’র সঙ্গে তিনি সাক্ষাত করে ফারাক্কার বাঁধ স্থায়ীভাবে সরিয়ে দেওয়ার দাবি রেখেছিলেন। তিনি আরও জানিয়েছেন, ফারাক্কা বাঁধের কারণে গঙ্গায় বিপুল পরিমাণ পলি জমেছে, যার ফলে বিহার প্রতি বছর বন্যায় তলিয়ে যাচ্ছে। যদিও তিনি বাংলাদেশের ক্ষতির দিকটি তুলে ধরেননি রাজনৈতিক কারণে, তবে আমাদের তা আর বুঝতে বাকি থাকেনি। তাই বিহারের মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে আমরাও একমত না হয়ে পারিনি; ফারাক্কা বাঁধের কারণে শুধু বিহারই নয়, বাংলাদেশও বন্যায় তলিয়ে যাচ্ছে প্রতিবছর। শুকনো মৌসুমে পর্যাপ্ত পানি বাংলাদেশের নদ-নদীতে প্রবাহিত না হওয়ায় নদীগুলো শুকিয়ে চৌচির হয়ে পড়ছে এবং তারই প্রভাবে বাংলাদেশের বরেন্দ্র অঞ্চল মরুকরণের দিকে ধাবিত হচ্ছে।
শুধু বিহারের মুখ্যমন্ত্রীই নন, ভারতের আমজনতার মুখে মুখেও কথাটি প্রচারিত হচ্ছে। হালে ভারতের নামকরা সংরক্ষণ অ্যাক্টিভিস্ট ও নর্মদা নদী বাঁচাও আন্দোলনের নেত্রী ‘মেধা পাটকর’ সংবাদ মাধ্যম বিবিসি বাংলাকে বলেছেন, ‘একটা বাঁধের প্রভাব যদি খুব ধ্বংসাত্মক হয়, তাহলে সেটা ডিকমিশন করা প্রয়োজন। এরকম অসংখ্য নজির বিশ্বে রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রেও শতাধিক ড্যাম ভেঙ্গে দিয়ে নদীর স্বাভাবিক প্রবাহ ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছে। ’
ফারাক্কা বাঁধ নিয়ে প্রতিবাদ শুধু এখনই নয়, তৎকালীন ভারতীয় বিশেষজ্ঞরা অভিমত প্রকাশ করেছিলেন, ‘গঙ্গা বা পদ্মার মত বিশাল নদীর গতি বাঁধ দিয়ে বিঘ্নিত করলে নদীর উজান এবং ভাটি উভয় অঞ্চলে প্রাকৃতিক ভারসাম্য মারাত্মকভাবে নষ্ট হতে পারে। ’ তখনকার নেতিবাচক অভিমত ভারত সরকার তোয়ক্কা না করেই গঙ্গার ওপরে ফারাক্কা অঞ্চলে বিশাল বাঁধটি নির্মাণ করে। যার কুফলে বাংলাদেশ ও ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, বিহার রাজ্যে ব্যাপক পরিবেশ বিপর্যয় ডেকে এনেছে। বাস্তুতন্ত্রে আঘাত হেনেছে। পরিবেশের ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেছে। বাংলাদেশের বরেন্দ্র অঞ্চল মরুকরণের দিকে ধাবিত হয়েছে, অন্যদিকে জলস্তর নিচে নেমে গেছে। পাশাপাশি অত্র অঞ্চলের তাপমাত্রা বৃদ্ধি পেয়ে ৪২-৪২ ডিগ্রি সেলসিয়াসে পৌঁছেছে।
ফারাক্কা বাঁধের কুফল নিয়ে আরো কিছু বলার থাকলেও তা আমরা বলতে পারছি না বন্ধু রাষ্ট্রের অজুহাতে। ভারত যে আমাদের বন্ধু রাষ্ট্র সেটা ওই দেশটিকে স্মরণ করিয়ে দিতে চেষ্টা করছি লেখাটার মাধ্যমে। বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধে ভারতের আন্তরিক সহযোগিতার কথা আমরা ভুলতে পারিনি আজও, পারা উচিতও নয়।
এমনকি যেকোনো কাজেই এ দেশের মানুষ ভারতে যান। কিংবা স্বাস্থ্যসংক্রান্ত কোন জটিলতায় পড়লেও সর্বপ্রথম ভারতে যাওয়ার কথা মনে করেন। স্বাধীনতার ৫২ বছর পেরিয়ে গেলেও বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষ পাকিস্তানকে ঘৃণার দৃষ্টি নিয়েই দেখেন এখনো। যা আরও প্রবল হচ্ছে হাল আমলে। বিশেষ করে তরুণ প্রজন্ম ‘৭১—এর চেতনা বুকে লুফে নিয়ে পাকিস্তানের প্রতি প্রচণ্ড বিদ্বেষী হয়ে উঠেছেন। যা মানতে পারছেন না পাকিস্তানপন্থি বা ভারত বিদ্বেষীরা। সেই তারাই এখন তরুণদের বাগে আনতে বোঝাচ্ছেন ফারাক্কা বাঁধের কুফলের কথা। যাতে করে কিছু তরুণ ভারত সম্পর্কে নেতিবাচক ধারণা পাচ্ছেন। যা আমাদের কাম্য নয়, আমরা চাই একটি বন্ধু রাষ্ট্র সম্পর্কে যেন জনমনে নেতিবাচক ধারণার সৃষ্টি না হয়। ভারত যেন তা বুঝতে সক্ষম হয়। সেই বিষয়টি পর্যালোচনা করে ভারত সরকার যেন ফারাক্কা বাঁধের বিষয়ে নমনীয় হয়, সেই দাবিটুকু রাখছি আমরা। সোজাকথা আমরা দাবি রাখছি ভারত সরকার বাঁধটি স্থায়ীভাবে সরিয়ে ফেলুক। তাতে করে বাংলাদেশের মানুষের হৃদয়ে স্থায়ী আসন পাবে ভারত। তাহলেই সার্থক হবে দু’দেশের বন্ধুত্বের বন্ধন এবং মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সহায়তার বিষয়টিও স্মরণে আসবে শ্রদ্ধার সঙ্গে। সেই আবদার নিয়ে আমরা দাবি রাখছি ছিটমহলের মতো যেন ফারাক্কা বাঁধেরও সমাধান করতে সক্ষম হয় ভারত তথা পশ্চিমবঙ্গ সরকার। ভারত সরকারের কাছে আমাদের এটিই দাবি থাকবে।
আরেকটি দাবিও আছে আমাদের, প্রস্তাবিত টিপাইমুখ বাঁধ নিমার্ণ নিয়ে। সেটি যদি ভারত বাস্তবায়ন পরিকল্পনা স্থায়ীভাবে বাতিল করে দেয়, তাহলে বাংলাদেশের জনসাধারণের কাছে ভারতের ভাবমূর্তি বাড়বে বৈ কমবে না। তিস্তার জল নিয়েও তদ্রুপ; বেশ টানাপোড়েন চলছে ইতোমধ্যে। তিস্তার জল বন্টনে বাংলাদেশের নায্য হিস্যা মিটিয়ে দিলে ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক আরও সুদৃঢ় হতো, পাশাপাশি ভারতের প্রতি বাংলাদেশের আস্থাও বেড়ে যেত।
লেখক: কথাসাহিত্যিক, পরিবেশ ও জলবায়ু বিষয়ক কলামিস্ট
বাংলাদেশ সময়: ১২৪৮ ঘণ্টা, জুন ২৪, ২০২৩
এসআইএস