পৃথিবীর কোনো শহর শুধু অবকাঠামো নির্মাণ করে যানজট নিয়ন্ত্রণ করতে পারেনি। যানজট নিয়ন্ত্রণের জন্য গুরুত্বপূর্ণ হলো নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে কাজ করা।
আমি মনে করি, যোগাযোগ খাতের সংস্কারের ক্ষেত্রে প্রথমেই প্রয়োজন পরিকল্পনা কমিশনের সক্ষমতা তৈরি করা, যেখানে অত্যন্ত যোগ্যতাসম্পন্ন পেশাদার পরিকল্পনাবিদরা থাকবেন। থাকবে যেকোনো প্রকল্পের চুলচেরা বিশ্লেষণের সক্ষমতা এবং সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা করার পূর্ব অভিজ্ঞতা। একই সঙ্গে জাতীয়ভাবে গুরুত্বপূর্ণ সব অবকাঠামো প্রকল্প বাস্তবায়নের সময়কাল বাস্তবসম্মত হওয়া উচিত। অবকাঠামোর কর্মক্ষমতা সর্বাধিক করার জন্য পরিচালনক্ষমতা বাড়াতে হবে।
নির্মাণ পদ্ধতি পরিবর্তিত জলবায়ুসহিঞ্চু না হওয়ায় এবং নির্মাণসামগ্রীর গুণগত মান ঠিক না থাকায় ব্যয়বহুল মহাসড়কও দ্রুত নষ্ট হয়ে যাওয়ার নজির রয়েছে। অপ্রয়োজনীয় রাজনৈতিক প্রকল্প নেওয়া, যথাসময়ে প্রকল্প শেষ না করা এবং সড়ক নির্মাণে বরাদ্দ থাকলেও রক্ষণাবেক্ষণে আলাদা কোনো বরাদ্দ না থাকা অন্যতম সমস্যা। পাশাপাশি রাজনৈতিক প্রভাব, ঠিকাদারের সক্ষমতার ঘাটতি এবং প্রকল্প বাস্তবায়নকারী সংস্থাগুলোর শক্তিশালী পর্যবেক্ষণ না থাকায় সড়ক নির্মাণ ও রক্ষণাবেক্ষণে তুলনামূলকভাবে বেশি খরচ হয় এবং সময়ও বেশি লাগে।
যানজট নিরসনে শুধু উড়ালপথ নির্মাণ করা হয়, কিন্তু গ্রেড-সেপারেটেড ইন্টারচেঞ্জ তৈরি করা হয় না। এতে উড়ালপথগুলোর ওঠানামার পথেই ব্যাপক যানজটের সৃষ্টি হয়। এই দুষ্টচক্রের হাত থেকে বের হয়ে আসতে শক্ত হাতে মোকাবেলা করতে হবে। অন্যদিকে মাল্টিমোডাল ইন্টেলিজেন্ট ট্রান্সপোর্ট সিস্টেম, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, স্বয়ংক্রিয় ইলেকট্রনিক টোল কালেকশন সিস্টেম, স্ট্রাকচারাল হেলথ মনিটরিং, ওভারলোড নিয়ন্ত্রণ, অনুমোদনহীন যানবাহনের প্রবেশ নিয়ন্ত্রণ ইত্যাদি উন্নত প্রযুক্তি যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে প্রকল্পে সংযুক্ত করতে হবে। অবকাঠামোর গুণমান ক্রমাগত বাড়াতে হবে।
অবকাঠামো এমন হতে হবে, যেখানে নিরাপত্তা, টেকসই সমাধান এবং স্ব-প্রবর্তিত নিয়ন্ত্রণের মেলবন্ধন ঘটে। বিজ্ঞানসম্মত যানজট পূর্বাভাস দেওয়ার জন্য সেন্ট্রাল ট্রাফিক ম্যানেজমেন্ট সিস্টেমের ব্যবস্থা চালু করতে হবে। এক্সপ্রেসওয়ে নেটওয়ার্ক তৈরির ক্ষেত্রে বর্তমানে অবস্থিত চলমান সড়ক নেটওয়ার্কে হস্তক্ষেপ না করে নতুন সম্পূর্ণ প্রবেশ নিয়ন্ত্রিত ও বাধাহীন ইন্টারচেঞ্জ সংবলিত টেকসই উচ্চগতির আর্টেরিয়াল কনফিগারেশনের এক্সপ্রেসওয়ে তৈরির দিকে মনোযোগ দেওয়া উচিত। এ ক্ষেত্রে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের গোল্ডেন কোয়াড্রিল্যাটারাল নেটওয়ার্ক একটি উত্তম উদাহরণ।
অন্যদিকে ক্রমাগত রেল দুর্ঘটনা দীর্ঘদিন ধরে রেলকে অবহেলা করার ফসল। দক্ষ জনবল ও আধুনিক যন্ত্রপাতি সংকটের পাশাপাশি সিগন্যালিং সিস্টেমের অসামঞ্জস্য অবস্থা মূলত এর জন্য দায়ী। কোনো দুর্ঘটনা ঘটলে রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ নিয়মমাফিক তদন্ত কমিটি করে, কমিটি প্রতিবেদনও জমা দেয়; কিন্তু সেই প্রতিবেদনে কী আছে, জনগণ জানতে পারে না। এসব দুর্ঘটনার জন্য কাউকে শাস্তি পেতে দেখা যায় না। এই ধারাই চলে আসছে বহু বছর ধরে, যেটা থেকে আমাদের বেরিয়ে আসতে হবে। রেললাইন বাড়ালেও অনেক ট্রেনের ইঞ্জিন-বগি এখনো পুরনো। বেশ কিছু লোকোমোটিভ আছে, যেগুলোর আয়ুষ্কাল ফুরিয়ে গেছে। রেল নেটওয়ার্কের একেক জায়গায় একেক রকম সিগন্যালিং সিস্টেম বিদ্যমান।
কোথাও কম্পিউটারভিত্তিক ইন্টারলকিং সিস্টেম, কোথাও ম্যানুয়াল ইন্টারলকিং সিস্টেম এবং কোথাও ব্রিটিশ আমলের ইন্টারলকিং সিস্টেম কার্যকর আছে। এগুলো রেলওয়ে পরিচালনাকে ঝুঁকিপূর্ণ করে তুলছে। এ কারণে আমরা দেখি, কখনো কখনো দুই ট্রেন একই লাইনে এসে পড়েছে। আমি মনে করি, রেল নেটওয়ার্ক টেকসই করতে হলে কেন্দ্রীয় লোকোমোটিভ কারখানা, ক্যারেজ ও ওয়াগন ওয়ার্কশপগুলো পুনরায় জীবিত, আধুনিক ও যুগোপযোগী করতে হবে। নতুন রোলিং স্টকসমূহ (লোকোমোটিভ, ক্যারেজ, ওয়াগন) নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণসহ দক্ষ টেকনিশিয়ান নিয়োগ ও আধুনিক যন্ত্রপাতি সরবরাহ করতে হবে।
নিয়োগ করা টেকনিশিয়ানদের নিয়মিতভাবে দেশে-বিদেশে আধুনিক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। পাশাপাশি নতুন রেলওয়ে নেটওয়ার্কে যুক্ত হওয়া আধুনিক স্টেশনগুলোর সুষ্ঠু পরিচালনার জন্য স্মার্ট জনবল নিয়োগ দিতে হবে। স্মার্ট হিউম্যান রিসোর্স উইথ লট অব নলেজ ও জবাবদিহি নিশ্চিত করা গেলে অতি দ্রুত দেশের রেল পরিচালনা ও ব্যবস্থাপনা স্বর্ণযুগে প্রবেশ করবে। মাকড়সার জালের মতো মেট্রো লাইন পুরো নগরীতে ছড়িয়ে পড়লে যাত্রীদের যাতায়াতের সুবিধার পাশাপাশি মাল্টিমোডাল হাব ঘিরে রেলের আয়ের একটি বড় সুযোগ তৈরি হবে।
সারা বিশ্বে বেশির ভাগ পণ্য পরিবহন নৌপথে করা হলেও দেশের চিত্রটা ভিন্ন। পণ্য পরিবহনের জন্য নৌপথ হচ্ছে সবচেয়ে সাশ্রয়ী। কিন্তু নৌপথের সঙ্গে সড়কের যে পরিমাণ সংযোগ বাড়ানোর দরকার ছিল, সেটা আমরা করিনি। শুধু নদী ড্রেজিং করে পণ্য পরিবহন করা যাবে না। আমাদের নৌ নেটওয়ার্ক এবং সমন্বিত নেটওয়ার্ক নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। বেশির ভাগ নৌযানে নেই পর্যাপ্ত নিরাপত্তাব্যবস্থা, মানা হচ্ছে না নিরাপত্তা নীতিমালাও।
এ ছাড়া নিরাপত্তা সরঞ্জামের ব্যবহার সম্পর্কেও প্রশিক্ষণ বা ধারণা নেই লঞ্চকর্মীদের। দিনের পর দিন এভাবেই যাত্রী নিয়ে ঝুঁকিপূর্ণভাবে চলাচল করছে তারা। এ জন্য দেশে নৌপথে প্রতিনিয়ত পণ্য ও যাত্রী পরিবহন কমছে। নৌপথে চলাচল করা অনেক লঞ্চ বা ফেরির নেই কোনো ফিটনেস। ছোট নৌযানের বড় সমস্যা হলো নিবন্ধন নেই। ফলে আনুষ্ঠানিকভাবে এসব যানের ফিটনেস নিয়ে কথা বলার সুযোগ থাকে না। সবার আগে এসব যান নিবন্ধনের আওতায় আনতে হবে। তখনই কেবল আধুনিকায়নসহ প্রযুক্তিনির্ভর এবং নিয়ন্ত্রিত চলাচলের আওতায় আনা সম্ভব হবে।
আমরা যখন অবকাঠামো নির্মাণ করি, বিশেষ করে ফ্লাইওভার, সড়ক ও এক্সপ্রেসওয়ে, তখন আমরা প্রায়ই ভূমি ব্যবহারের বিষয়কে অবহেলা করি। ভূমি ব্যবহারের বিষয়কে আমরা যদি নিয়ন্ত্রণ করতে না পারি, তাহলে দেখা যায় বেশ ভালো সড়কও চার-পাঁচ বছর পর ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে ওঠে। ভূমি ব্যবহার নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে শক্ত কোনো নীতি না থাকাও এর অন্যতম কারণ। এ ক্ষেত্রে অধিগ্রহণকৃত অতিরিক্ত জায়গা রাস্তার মাঝে রেখে দুই পাশের সীমানা ঘেঁষে সড়ক তৈরি করা ফলপ্রসূ। সে ক্ষেত্রে ভেতরের অব্যবহৃত জায়গা প্রশস্ত সড়ক বিভাজক হিসেবে কাজ করায় মুখোমুখি দুর্ঘটনার ঝুঁকি অনেকাংশেই কমিয়ে দেয় এবং প্রাকৃতিক ড্রেনেজ হিসেবে কাজ করার কারণে সড়কের ওপর পানি জমাট বেঁধে সড়কের কাঠামোগত ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কাও থাকে না।
আমি আরো মনে করি, রাস্তার পাশাপাশি সম্ভাবনাময় রেল ও নৌপথকেও সমান গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করে সব যাতায়াতব্যবস্থাকে একটি একক জাতীয় মাস্টারপ্ল্যানের আওতায় নিয়ে আসতে হবে। পরিশেষে বলব, টেকসই যোগাযোগব্যবস্থা এবং স্বল্প ব্যয়ে রক্ষণাবেক্ষণের লক্ষ্যে প্রয়োজন প্রচুর গবেষণার। সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের অধীনে সড়ক গবেষণা ল্যাবরেটরি থাকলেও সেখানে রয়েছে নিয়মিত ও যোগ্য গবেষকের অভাব।
তাই টেকসই সড়ক অবকাঠামোর জন্য সক্ষম গবেষক নিয়োগ এবং নিয়মিত গবেষণার লক্ষ্যে সব প্রকল্প থেকে ১-২ শতাংশ অর্থ অন্যান্য উন্নত দেশের মতো এই খাতে বরাদ্দ রাখতে হবে। অন্যদিকে রেলে অভিন্ন ও আধুনিক সিগন্যাল সিষ্টেম চালুর পাশাপাশি রেল পরিচালনায় দক্ষতা বাড়ানোর জন্য রেল ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে দক্ষ ও স্মার্ট জনবল তৈরি এবং রেলের অবকাঠামো প্রকল্প থেকে অর্থ বরাদ্দের মাধ্যমে গবেষণা সচল রাখতে হবে।
মো. হাদিউজ্জামান, যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ ও অধ্যাপক, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট)
বাংলাদেশ সময়: ০৯৪৯ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১৩, ২০২৫
আরএইচ