বাংলাদেশ সাংবাদিকতার জন্য একটি ঝুঁকিপূর্ণ ভূখণ্ডে পরিণত হয়েছে। এই দেশে পেশা হিসেবে সাংবাদিকতা শুধু ঝুঁকিপূর্ণই নয়, বিপদেও পরিপূর্ণ।
জাতিসংঘের মতে, সাংবাদিকতা বিশ্বের সবচেয়ে বিপজ্জনক পেশাগুলোর মধ্যে একটি। কী ঘটছে, তা অনুসন্ধান করতে এবং প্রতিবেদন তৈরি করতে সাংবাদিকেরা বিভিন্ন স্থানে যান। দুর্ভাগ্যবশত, এই পেশা নিজেই কখনো কখনো অপহরণ, হামলা, এমনকি হত্যার গল্প হয়ে ওঠে।
১৯৯২ সাল থেকে সাংবাদিক হত্যা এবং সাংবাদিকের ওপর হামলা বাংলাদেশে একটি গুরুতর বিষয় হয়ে উঠেছে। রেকর্ড অনুযায়ী, ২০০৪ সাল থেকে বাংলাদেশে সাংবাদিকদের ওপর নিপীড়ন বেড়েছে।
সাংবাদিকদের অধিকারের পক্ষে কাজ করা নিউইয়র্ক-ভিত্তিক আন্তর্জাতিক সংস্থা কমিটি টু প্রোটেক্ট জার্নালিস্টসের (সিপিজে) বিবৃতিতে বলা হয়েছে, বাংলাদেশকে সাংবাদিকদের জন্য একটি উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ দেশ হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
সিপিজের তথ্য অনুসারে, ১৯৯২ সাল থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশে মোট ৩৪ জন সাংবাদিক নিহত হয়েছেন। গেল ১৫ জুন জামালপুরে পরিকল্পিতভাবে বাংলানিউজটোয়েন্টিফোরের স্থানীয় সংবাদদাতাকে হত্যা করা হয়। এই নিয়ে সাংবাদিক হত্যার সংখ্যা ৩৫-এ গিয়ে দাঁড়ায়।
নিহত ৩৫ জন সাংবাদিক পরিবারের সদস্যদের হাহাকার আজ দেশবাসীর কানে কড়া নাড়ছে। সাংবাদিকতা একটি মহৎ পেশা যেখানে অর্থের মোহ শুধু একটি স্বপ্ন মাত্র। নিহত সাংবাদিকদের হয়তো অর্থের মোহ ছিল না। কিংবা তারা খুনিদের সঙ্গে কোন প্রকার আপসে না যাওয়ার জন্য যথেষ্ট নির্ভীক ছিলেন, যে কারণে তাদের এই সুন্দর পৃথিবী তাদের ছেড়ে যেতে হয়েছিল।
বাংলাদেশে সাংবাদিক হত্যা মিশন শুরু হয়েছিল মোহাম্মদ কামরুজ্জামানকে দিয়ে। তিনি ছিলেন নীলফামারী-ভিত্তিক সাংবাদিক। তিনি 'নীল সাগর' নামে একটি স্থানীয় পত্রিকার রিপোর্টার ছিলেন। ১৯৯৬ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি তাকে হত্যা করা হয়। ২০০৪ সালের জানুয়ারিতে প্রবীণ সাংবাদিক মানিক চন্দ্র সাহা হত্যা বাংলাদেশে সাংবাদিক হত্যার একটি অমীমাংসিত উদাহরণ।
সাহা দৈনিক ‘নিউ এজ’ পত্রিকার সংবাদদাতা এবং বিবিসি বাংলার কন্ট্রিবিউটর ছিলেন। খুলনা প্রেসক্লাব থেকে খুলনা শহরে নিজ বাড়িতে যাওয়ার সময় আততায়ীরা তার রিকশা থামিয়ে হাত বোমা ফেলে হত্যা করে। দীর্ঘ তদন্ত ও বিচার শেষে ২০১৬ সালের ৩০ নভেম্বর ১১ আসামির মধ্যে নয়জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড এবং ১০ হাজার টাকা জরিমানা অনাদায়ে আরও এক বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়।
সাংবাদিক সমাজ এই রায়কে প্রত্যাখ্যান করে এর প্রতিবাদ জানায়। এই মামলার বিচারে মৃত্যুদণ্ড ব্যাপকভাবে প্রত্যাশিত ছিল এবং সাংবাদিকরা মামলার পুনঃতদন্তের দাবি জানান।
মাত্র পাঁচ মাসের ব্যবধানে খুলনায় তার অফিসের সামনে আরেকটি বোমা হামলায় দৈনিক জন্মভূমির সম্পাদক হুমায়ুন কবির বালু নিহত হন।
আরেক সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনিকে ২০১২ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি পশ্চিম রাজাবাজারে তাদের ভাড়া করা অ্যাপার্টমেন্টে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছিল, যা একটি রহস্য এবং বিষয়টি অমীমাংসিত রয়ে গেছে। সম্প্রতি মামলার তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল ৯৯তম বারের মতো পিছিয়েছে।
কিছু সাংবাদিক হত্যার রহস্য নাম মাত্র তদন্ত হলেও অনেক হত্যার ঘটনাই কয়েক দশক ধরে এই দেশে অমীমাংসিত রয়ে গেছে।
২০০০ সালে বাংলাদেশের যশোর জেলায় দৈনিক জনকণ্ঠের প্রাক্তন বিশেষ প্রতিনিধি শামসুর রহমান তার অফিসে দুই সশস্ত্র লোকের হাতে নিহত হন। নিহত সাংবাদিকের ভাই বকুল ২০২১ সালে গণমাধ্যমকে বলেন যে, খুলনার দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালের তত্ত্বাবধানে থাকা সত্ত্বেও মামলার তদন্ত এখনো শুরু হয়নি।
বাস্তবতা হলো এই যে, সাংবাদিক হামলা, মামলা এবং হত্যার সমস্যা সমাধানে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের আগ্রহের অভাব রয়েছে। সাংবাদিক হত্যার নিন্দা করার ক্ষেত্রে রাজনীতিবিদরা বেশ কয়েকবার একে অপরের সাথে দোষারোপের খেলায় মেতেছেন, অথচ ক্ষমতায় থাকাকালীন তারা খুব কম সময়ই হত্যা মামলার সুরাহা করতে পেরেছেন। এমনকি তেমন জোরালো কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি বলেই আমি মনে করি।
সাংবাদিকতা শুধু বাংলাদেশে নয়, বিশ্বব্যাপী একটি চ্যালেঞ্জিং পেশা হয়ে উঠেছে। ২০২২ সালের ১১ মে ফিলিস্তিনি-আমেরিকান সাংবাদিক শিরিন আবু আকলেহের হত্যার শিকার হন, যিনি ২৫ বছর ধরে আল জাজিরার জন্য কাজ করেছিলেন। এই ঘটনা বিশ্ব সাংবাদিক সম্প্রদায়ের মেরুদণ্ডকে শীতল করে দেয়। বিশ্বব্যাপী সাংবাদিকতায় ক্রমবর্ধমান ঝুঁকি তুলে ধরে শিরিনের হত্যাকাণ্ড ব্যাপক আলোচনার জন্ম দিয়েছে।
প্রশ্নটি দীর্ঘস্থায়ী হচ্ছে যে, বাংলাদেশ কি সত্যিই সাংবাদিকদের জন্য ‘রেড জোন’ হয়ে উঠছে? এর উত্তর বাংলাদেশের সাংবাদিক সমাজকে আগামী দিনে নির্ধারণ করতে হবে।
লেখক: সাংবাদিক ও পিএইচডি প্রার্থী
আরএইচ