ঢাকা, শুক্রবার, ১২ পৌষ ১৪৩১, ২৭ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৪ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

মুক্তমত

১৫ আগস্টে শোক প্রকাশের আড়ালে কি অন্য কিছু ছিল?

আতিকুল বারী চৌধুরী | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২২০১ ঘণ্টা, আগস্ট ১৮, ২০২৪
১৫ আগস্টে শোক প্রকাশের আড়ালে কি অন্য কিছু ছিল? ফাইল ছবি

সারা রাত ডিজে পার্টি, সারা দিন নাচ-গান, ঠিক যেন থার্টিফার্স্ট নাইট ও নববর্ষ উদযাপন। অন্যদিকে আওয়ামী লীগকে ৩২ নম্বরে এসে শোক প্রকাশ করতে না দেওয়া, তাদের সমর্থকদের হয়রানি করা, মোবাইল ফোন চেক করা, তাদের পেটানো, এমনকি টেনেহিঁচড়ে গায়ের জামা ছিঁড়ে ফেলা!

১৫ আগস্টে ছাত্রদের কাছ থেকে এমন আচরণ আশা করেননি, তাই তো?

তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া না দেখিয়ে মাথা ঠান্ডা করে একটু চিন্তা করে দেখুন।

অহিংস আন্দোলনের মাধ্যমে একটা অত্যাচারী স্বৈরাচারকে গদিচ্যুত করল যে ছাত্ররা, যারা আন্দোলন চলাকালীন পুলিশকে বাঁচাল, অ্যাম্বুলেন্সের জন্য সুশৃংখলভাবে রাস্তা ছেড়ে দিল, গণভবন থেকে লুটপাট হওয়া মূল্যবান সামগ্রী উদ্ধার করে সেনাবাহিনীর কাছে ফিরিয়ে দিল, রাত জেগে মন্দির পাহারা দিল, সেই ছাত্ররা কেন এমন উশৃঙ্খল এবং মারমুখী হয়ে উঠল, চলুন তার উত্তর খোঁজার চেষ্টা করি।

শোক প্রকাশ করতে দিলে কী এমন ক্ষতি হতো?
আপাত দৃষ্টিতে মনে হতেই পারে যে, ৩২ নম্বরে এসে শেখ মুজিবুর রহমান ও তার পরিবারের নিহত সদস্যদের আত্মার মাগফেরাত কামনা করা, ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করা খুবই নিরীহ কর্মসূচি। এতে কোনো বিপদ হবার আশঙ্কা নেই।

আসলে কি তাই?
১৫ আগস্টে ঢাকা শহরের ৩২ নম্বরে বিনা বাধায় আওয়ামী লীগের পান্ডাদের একত্রিত হতে দিলে কী ঘটতে পারত, তা বোঝার জন্য এর ৫ দিন আগে, ১০ আগস্ট কী ঘটেছিল তা মনে করিয়ে দেই।

সংখ্যালঘু নির্যাতনের প্রতিবাদে শাহবাগে জড়ো হবার জন্য ডাক দেওয়া হয় আওয়ামী লীগের অফিসিয়াল ফেসবুক গ্রুপ থেকে, অন্যদিকে প্রধান বিচারপতি ফুল কোর্ট মিটিং ডেকে বসেন। তার একদিন আগে সজীব ওয়াজেদ জয় দাবি করেন, তার মা পদত্যাগ করেননি এবং এখনো তিনিই বাংলাদেশের বৈধ প্রধানমন্ত্রী!

এর সবচে সম্ভাব্য ব্যাখ্যা এই যে, ওইদিন শাহবাগে নির্যাতনের প্রতিবাদে জড়ো হওয়া হিন্দু ধর্মাবলম্বী, যাদের মধ্যে কিছু মানুষ নিজের নাম-ঠিকানা বলতে পারেননি, কেউ আবার নিজেই ছিলেন আওয়ামী গুন্ডা। কিন্তু জনরোষ থেকে বাঁচার জন্য নিজের হিন্দু পরিচয়কেই সামনে আনেন। আওয়ামী লীগের উদ্দেশ্য ছিল সেই হিন্দু সমাবেশে অনুপ্রবেশ করে একটা বড় জমায়েত ঘটানো, একই সাথে প্রধান বিচারপতির উদ্দেশ্য ছিল ফুল কোর্ট সভা করে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে অবৈধ ঘোষণা করা এবং এই সুযোগে প্রশাসনে ও পুলিশে আওয়ামী লীগের অনুগত যারা রয়ে গেছেন তারা শক্তি প্রয়োগ করে সেই রায় বাস্তবায়ন করে দিতেন।

এর মানে উপদেষ্টাদের গ্রেপ্তার, বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের সমন্বয়কদের গ্রেপ্তার হতেন। শেখ হাসিনা ফিরে আসতেন মহাবিজয়ীর বেশে।

কিন্তু না! ছাত্ররা এই ষড়যন্ত্র ব্যর্থ করে দেয়। তারা হাইকোর্ট প্রাঙ্গণসহ দেশের সব আদালতে অবস্থান ও ঘেরাও কর্মসূচির মাধ্যমে প্রধান বিচারপতিসহ আপিল বিভাগের বিচারপতিদের পদত্যাগ করতে বাধ্য করেন।

এই অভিজ্ঞতার পর ছাত্ররা বুঝতে পারেন যে, আওয়ামী লীগের জনসমর্থন না থাকলেও ষড়যন্ত্র করে ক্যু সংগঠিত করার ক্ষমতা এখনো আছে। এজন্য তারা এটা ঠেকাতে ঘোষণা করেন রেজিস্ট্যান্স উইক। যার উদ্দেশ্য, আওয়ামী লীগকে এই জরুরি সময়ে কোনো অজুহাতেই সংগঠিত হবার সুযোগ না দেওয়া।

এবার নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন ছাত্ররা কেন ১৫ আগস্টে যেকোনো মূল্যে আওয়ামী লীগকে ৩২ নম্বরে সমবেত হওয়া থেকে বিরত রাখতে চেয়েছে।

চলুন এবার দ্বিতীয় প্রশ্নে
ছাত্ররা কেন ১৫ আগস্টে নাচ গান ফূর্তি করল? ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে ডিজে পার্টি, ৩২ নম্বরের সামনে রাতে ও দিনে নাচ-গান, এসব দেখে অনেকেই ফেসবুকে লিখেছেন, নির্মমতা, বর্বরতা! হয়েছে থামুন!

গত ১৫টি বছর ধরে ১৫ আগস্ট এলে এই ছাত্ররা কি নারকীয় অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে গেছে সেটা ভুলে গেছেন? স্কুলের বাচ্চাদের রোদে দাঁড় করিয়ে কর্মসূচি পালনে বাধ্য করা হতো।

ছাত্রলীগ পুরো আগস্ট মাসব্যাপী কর্মসূচি হাতে নিত, শোকসভা, আলোচনা সভা, কবর জিয়ারত, বিক্ষোভ মিছিল, স্মারকলিপি দাখিল… এ সব কিছুই ছিল হলে থাকা ছাত্রদের জন্য বাধ্যতামূলক। কর্মসূচিতে না গেলেই মারধর। অথবা হল থেকে বের করে দেওয়া।  

যেসব ছাত্র এই মগের মুল্লুক দেখতে দেখতে বড় হয়েছে, তাদের কাছে এই বারের ১৫ আগস্ট ছিল মুক্তির দিন। তারা মুক্তি পেয়েছে আগস্ট মাসের বাধ্যতামূলক কর্মসুচি থেকে, তারা মুক্তি পেয়েছে ছাত্রলীগের গণরুম থেকে, তারা মুক্তি পেয়েছে আবরারের মতন মার খেয়ে মরে যাবার হাত থেকে। এর পরেও কি বলবেন? কেন তারা ১৫ আগস্টে আনন্দ উল্লাস করল?

এবারে শেষ প্রশ্ন
হাতেগোনা যে কয়েকজন ৩২ নম্বরে আসতে চেয়েছিলেন, তাদের হেনস্তা করা হলো কেন? আপনি একবার নিজেকে একজন আওয়ামী লীগের কর্মীর জায়গায় কল্পনা করে দেখুন। ১৫ বছর দেশকে বন্দুকের মুখে শাসন করবার পর ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আপনার দলীয় প্রধান দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন। নেতাকর্মী এবং অনুগত পুলিশ আত্মগোপনে। এই অবস্থায় ছাত্ররা ঘোষণা দিয়েছে যে আওয়ামী লীগকে ৩২ নম্বরে আসতে দেওয়া হবে না। সংঘাত এড়াতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ৩২ নাম্বার এলাকাটি ব্যারিকেড দিয়ে বন্ধ করে দিয়েছে।  

এই অবস্থায় আপনি কি ৩২ নম্বরে গিয়ে শোক প্রকাশকে যুক্তিযুক্ত বলে মনে করেন? নিশ্চয়ই না! সিংহভাগ আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীর চিন্তাভাবনাও একইরকম। তাই স্বয়ং শেখ হাসিনা এবং তার ছেলে সজীব ওয়াজেদ আহবান করার পরেও মাত্র গুটিকয়েক নেতাকর্মী ৩২ নম্বরে আসার মতন পাগলামো দেখিয়েছেন।

শেখ হাসিনা কেন তাদের আসতে বলেছেন বলে আপনি মনে করেন?
উত্তরটা আমিই দেই, দেখেন আপনার ধারণার সাথে মেলে কি না। শেখ হাসিনা জানতেন এই গুটিকয়েক লোকই তার আহ্বানে সাড়া দেবেন এবং তারা ৩২ নম্বরে যেতে গিয়ে বাধার মুখে পড়বেন, হয়ত হয়রানি এবং মারধরের শিকার হবেন। আর এইটাই তিনি চেয়েছিলেন।

আওয়ামী লীগের সংখ্যালঘু কার্ড এবং প্রধান বিচারপতি দিয়ে ক্যু ঘটাবার পরিকল্পনা ব্যর্থ  হয়ে যাবার পর তার হাতে একটাই কৌশল বাকি আছে,  নিজেকে নিরীহ দুর্বল ভিকটিম হিসাবে প্রমাণ করা।

এতে করে দেশের মানুষের মানে আপনার এবং আমার সহমর্মিতা পাওয়া যাবে, এবং পাওয়া যাবে টুইটারে ট্রেন্ডিং স্ট্যাটাস আপডেট, যা দিয়ে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল, জাতিসঙ্ঘ আর কপাল ভালো হলে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রীর একটা বিবৃতি যোগাড় করা যাবে।

আওয়ামী লীগের কাছে আমার প্রশ্ন, কী হবে এইসব বিবৃতি দিয়ে? বিদেশি রাষ্ট্র এবং সংস্থার বিবৃতিতে যে কাজের কাজ কিছুই হয়না, তা আপনাদের আমলেই প্রমাণিত হয়ে গেছে।

বাকি রইলো আমার আর আপনার সহমর্মিতা।

একটা বিষয় খেয়াল করেছেন, রোকেয়া প্রাচী, কাদের সিদ্দিকী এরাও কিন্তু হয়রানির শিকার হয়েছেন। কিন্তু এটা নিয়ে আমরা তেমন উচ্চবাচ্চ্য করিনি।

আমরা জানি এই দুইজন কীভাবে সব সময় গণমানুষের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছেন। বিরোধী মতের মানুষদের দমন করে নিজেদের ব্যক্তিগত এবং দলীয় স্বার্থ রক্ষা করতে চেয়েছেন। তাই তাদের ওপর ঘটে যাওয়া হয়রানিকে আপনি আর অন্যায় হিসেবে দেখতে পারছেন না। বরং দেখছেন তাদের কর্মফল হিসেবে।

একইভাবে হাতেগোনা যে কয়জন ১৫ আগস্টে ৩২ নম্বরে যাবার চেষ্টা করেছেন, তাদের মধ্যেও কিন্তু আওয়ামী লীগের কমিটিতে পদধারী নেতাই বেশি।  

যেমন ধরুন সাবেক ছাত্রলীগের নেতা মহিবুল্লাহ, যিনি ছিলেন জাহাঙ্গীরগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ধর্ষণের সেঞ্চুইর করা ছাত্রলীগ নেতা মানিকের পার্টনার ইন ক্রাইম।

অন্যজন আব্দুল কুদ্দুস মাখন, শেরপুর জেলার আওয়ামী লীগ নেতা। অতীতে যিনি মাদক কারবারের জন্য গ্রেপ্তার হয়েছেন এবং গত জুলাই মাসজুড়ে যিনি ডান্ডা মেরে আন্দোলন ঠান্ডা করে ফেলার পক্ষে সাফাই গেয়েছেন।

এনারাই কি ১৫ বছর ধরে দেশটাকে মগের মুল্লুক বানিয়ে রেখেছিলেন না? এমনকি দশদিন আগ পর্যন্ত ছাত্রদের উপর যে দমনপীড়ন গুলি চলেছে, তাতে সমর্থন যুগিয়েছেন না, এমন কি পদধারী নেতা হিসাবে মাঠে নেমে নিজ হাতে ছাত্রদের নির্যাতন করেননি?

এইবার কি আর এদের ওপর ঘটা হয়রানি, হেনস্তাকে অবিচার বলে মনে হচ্ছে, নাকি মনে হচ্ছে এটা তাদেরই প্রাপ্য কর্মফল।

লেখাটা এখানেই শেষ করে দিতে পারতাম, কিন্তু করছি না, কারণ আমি কোনো হামলা হেনস্তার পক্ষে না। ছাত্রদের যেভাবে পেটানো হয়েছে, কোপানো হয়েছে, হেলিকপ্টার থেকে গুলি করা হয়েছে, আহত হয়ে পড়ে যাবার পরেও কাছে এসে গুলি করে মৃত্যু নিশ্চিত করা হয়েছে, তার বিপরীতে এটা সামান্য হয়রানি, কানে ধরা, জামা ছিড়ে ফেলা অতি অতি তুচ্ছ।

আওয়ামী লীগের কৃতকর্মের জন্য আদালতে বিচার হতে হবে এবং বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের সমন্বয়করাও মনে করেন, এই ধরনের হেনস্তা করা অন্যায়। তারা এসব থেকে বিরত থাকতে বলেছেন।

আমরা আশা করব, সামনের দিনগুলিতে, বিশেষত ২১ আগস্ট যখন আওয়ামী লীগ আবার সমবেত হবার চেষ্টা করবে, ছাত্ররা সর্বোচ্চ সহনশীলতা দেখিয়ে আওয়ামীলী গারদের বুঝিয়ে বাসায় ফেরত পাঠাবেন।

আতিকুল বারী চৌধুরী
রাজনৈতিক কর্মী ও কন্টেন্ট ক্রিয়েটর

বাংলাদেশ সময়: ২২০১ ঘণ্টা, আগস্ট ১৮, ২০২৪
এমজেএফ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।