ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১১ পৌষ ১৪৩১, ২৬ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৩ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

মুক্তমত

মারাত্মক সংকটের মধ্যে আছেন দেশের ব্যবসায়ীরা: নিরঞ্জন রায়

নিউজ ডেস্ক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১১০৭ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২৬, ২০২৪
মারাত্মক সংকটের মধ্যে আছেন দেশের ব্যবসায়ীরা: নিরঞ্জন রায় নিরঞ্জন রায়

ঢাকা: বাংলাদেশের ব্যবসায়ীদের সংকট যেন কাটতেই চাইছে না। সেই যে করোনা মহামারির কারণে বাংলাদেশের ব্যবসায়ীরা একটি চ্যালেঞ্জের মধ্যে পড়ে গেল, সেখান থেকে কোনোভাবেই স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসতে পারছে না।

একটি সমস্যা মোকাবিলা করে ঘুরে দাঁড়াতে না দাঁড়াতেই আরেকটি সমস্যা এসে হাজির হয়। প্রথমে শুরু হলো করোনা মহামারি, যার প্রভাবে বিশ্বব্যাপী ব্যবসা-বাণিজ্য মারাত্মক ক্ষতির সম্মুখীন হলো।

করোনার ক্ষতি কোনোমতে সামলে নিয়ে দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য ঘুরে দাঁড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে দেখা দিল রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, যা নতুন সংকটের সৃষ্টি করল ব্যবসায়ীদের জন্য। বিশেষ করে এই যুদ্ধের কারণে দীর্ঘমেয়াদি ডলার সংকট সৃষ্টি হয়। এর ফলে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ একধাক্কায় ৫০ বিলিয়নের কাছাকাছি থেকে ২০ বিলিয়ন ডলারের নিচে নেমে আসে। ডলারের বিনিময় মূল্য ৮০ থেকে এক লাফে ১২০ টাকার ওপরে চলে যায়।

এর নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে দেশের ব্যবসায়ী সম্প্রদায়ের ওপর। এত সমস্যার মধ্যেও সব কিছু সামলে ব্যবসায়িক কার্যক্রম চালিয়ে যাওয়ার মধ্যেই ঘটে গেল রাজনৈতিক পটপরিবর্তন, যার প্রভাবে ব্যবসায়ীরা ভালোভাবেই সমস্যায় পড়েছেন।
অর্থনীতির স্বার্থেই ব্যবসায়ীদের সহযোগিতা প্রয়োজন  আমাদের দেশে রাজনৈতিক পটপরিবর্তন নতুন কিছু নয়। এর আগে বেশ কয়েকবার রাজনৈতিক পটপরিবর্তন হয়েছে, কিন্তু ব্যাবসায়িক কার্যক্রমের ধারাবাহিকতা অব্যাহত থেকেছে।


হাতে গোনা দু-একজন বাদ দিলে দল-মত-নির্বিশেষে সব ব্যবসায়ী তাদের ব্যাবসায়িক কার্যক্রম অব্যাহত রাখতে পেরেছেন। এবারই ঘটেছে ব্যতিক্রম। রাজনৈতিক আক্রমণ, অনেক ব্যবসায়ীর দেশত্যাগ, অনেকের কারাবরণ—এসব নানা প্রতিবন্ধকতা তো আছেই। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে কিছু ব্যবসায়ীর বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশনের তৎপরতা এবং অনেক ব্যবসায়ীর ব্যাংক হিসাব জব্দ বা ফ্রিজ করার মতো ঘটনা। এ কথা ঠিক যে এসব পদক্ষেপ নিশ্চয়ই সব ব্যবসায়ীর বিরুদ্ধে সংঘটিত হচ্ছে না, বরং খুব কমসংখ্যক ব্যবসায়ীই হয়তো এ রকম সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছেন।

কিন্তু এসব ঘটনার কারণে ব্যবসার পরিবেশটাই আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে গেছে। এক ধরনের অনিশ্চয়তা বিরাজ করছে ব্যবসায়ীদের মধ্যে।
এ রকম অনিশ্চয়তা নিয়ে স্বাভাবিকভাবে ব্যবসায়িক কার্যক্রম পরিচালনা করা যায় না। ব্যবসা হচ্ছে চলমান ক্রমবর্ধমান একটি প্রক্রিয়া, যেখানে ক্রমাগত বিনিয়োগ অব্যাহত রাখতে হয়। একজন ব্যবসায়ী যা লাভ করেন, তার কমই নিজেরা ভোগ করেন। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে লাভের অংশ পুনর্বিনিয়োগ করে থাকেন। এমনকি লাভ না হলেও ঋণ করে নতুন নতুন বিনিয়োগ করেন, যদি সে রকম ব্যাবসায়িক সুযোগ থাকে। একজন সামান্য চায়ের দোকানদারও নিজের ব্যবসায় সফল হওয়া মাত্র একটি রেস্টুরেন্ট দেওয়ার কথা চিন্তা করেন। আজ পর্যন্ত এমন ব্যবসায়ী খুঁজে পাওয়া যাবে না, যিনি বলেছেন যে যথেষ্ট হয়েছে, এখন বিনিয়োগে ক্ষান্ত দিতে হবে। ব্যবসায়ীদের কাছে সর্বোচ্চ সীমা বলে কিছু নেই। উন্মুক্ত আকাশ হচ্ছে তাদের সীমা। ব্যাবসায়িক বিনিয়োগ হচ্ছে কিছুটা নেশার মতো। একবার ব্যবসা শুরু করলে একের পর এক ব্যবসা বাড়াতেই থাকেন এবং নতুন নতুন বিনিয়োগ হতেই থাকে। হ্যাঁ, এ কথা ঠিক যে কিছু খারাপ ব্যবসায়ী আছেন, যারা ব্যবসার নাম করে অর্থ সংগ্রহ করে আত্মসাৎ করেন। কিন্তু তাদের সংখ্যা খুব বেশি নয়। তারা প্রকৃত ব্যবসায়ী না। প্রকৃত ব্যবসায়ীরা কখনোই এ রকম করেন না এবং তাদের সংখ্যাই সমাজে বেশি। এই প্রকৃত ব্যবসায়ীরাই অর্থনীতির চালিকাশক্তি। তারাই দেশে বিনিয়োগ করেন, কর্মসংস্থান সৃষ্টি করেন, পণ্য সরবরাহ নিশ্চিত করেন এবং সর্বোপরি দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জনে ভূমিকা রাখেন।

আমাদের দেশের ব্যবসায়ী সম্প্রদায় যে এক কঠিন সময় পার করছে এবং তারা যে নানা রকম সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে, তা বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারও বেশ ভালোভাবেই অবহিত আছে; যে কারণে কিছুদিন আগে অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ ও বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর ব্যবসায়ীদের স্পষ্টভাবে আশ্বস্ত করেছিলেন। উভয়েই বাংলাদেশের অর্থনীতি এবং মুদ্রাবাজারের প্রধান নীতিনির্ধারক। দুজনই স্পষ্ট করে ঘোষণা দিয়েছিলেন যে একটি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানও বন্ধ হতে দেবেন না। এ প্রসঙ্গে তারা দুজনই যথার্থভাবে উল্লেখ করেছিলেন যে প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে কর্মসংস্থানের বিষয়টি জড়িত থাকে এবং অনেকের রুজি-রোজগারের প্রশ্ন। তাই কোনো ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ তো করা হবেই না, বরং প্রতিষ্ঠানগুলোর আরো উন্নতির জন্য পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে। ব্যবসায়ীদের উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা দূর করার ক্ষেত্রে এ রকম আশ্বাসের খুবই প্রয়োজন ছিল। আমরাও বেশ নিশ্চিন্ত হয়েছিলাম যে এখন ব্যবসায়ীদের আর চিন্তার কোনো কারণ থাকবে না এবং ব্যবসায়ীরা পূর্ণমাত্রায় ব্যবসায় মনোনিবেশ করতে পারবেন। সরকারের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী মহল থেকে ব্যবসায়ীদের এভাবে আশ্বস্ত করার তাৎপর্য তুলে ধরে আমি কালের কণ্ঠে কলামও লিখেছিলাম। সেই লেখায় আশাবাদ ব্যক্ত করেছিলাম যে অর্থ উপদেষ্টা ও বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ব্যবসায়ীদের আশ্বস্ত করে সরাসরি বক্তব্য দেওয়ার পর দেশের ব্যবসা-বাণিজ্যে গতি আসার ক্ষেত্রে আর কোনো সমস্যা থাকবে না।

ব্যবসায়ীদের সমস্যা কেটে গেছে—বাস্তবে কিন্তু এমন অবস্থা মোটেই দৃশ্যমান নয়। অধিকন্তু আরো অনেক নতুন সমস্যা দেশের ব্যবসায়ীদের সামনে এসে হাজির হতে শুরু করেছে। সম্প্রতি কালের কণ্ঠ, ডেইলি সান এবং অন্যান্য জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত সংবাদে ব্যবসায়ীদের সমস্যার বিষয়গুলোই উঠে এসেছে। পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদনগুলো পাঠ করলে স্পষ্টই বোঝা যায় যে দেশের ব্যবসায়ীরা কী মারাত্মক সংকটের মধ্যে আছেন। সুতরাং অর্থ উপদেষ্টা ও বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরের মৌখিক আশ্বাস খুব একটা কাজে আসেনি। আসলে দৃশ্যমান কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ না করলে, শুধু মুখের কথায় যে কোনো কাজ হয় না, তা আমরা অতীতে বহুবার প্রত্যক্ষ করেছি এবং এখন আবারও করলাম। বিষয়টি উল্লেখ করে আমি আমার সেই লেখায় দৃশ্যমান কিছু পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য জোরালো সুপারিশ করেছিলাম। এমনকি কী ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণ করা যেতে পারে, তা-ও সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করেছিলাম। কিন্তু সে রকম কোনো পদক্ষেপ গ্রহণের কথা আমরা এখনো শুনিনি। উল্টো সরকারের ওপর মহল থেকে এমন কিছু কথাবার্তা বলা হয়েছে, যা ব্যবসায়ীদের উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা আরো বাড়িয়ে দিয়েছে। যেমন—কর বা রাজস্ব ফাঁকি দেওয়ার জন্য ব্যবসায়ীদের ঢালাওভাবে দায়ী করে বক্তব্য দেওয়া হয়েছে, যা নিঃসন্দেহে ব্যবসায়ীদের আতঙ্কিত করেছে।  

এসব কারণে ব্যবসায়ীদের সংকট মোটেই কাটছে না। অধিকন্তু নতুন নতুন আরো অনেক সমস্যার মধ্যে পড়ে তাদের ব্যাবসায়িক কার্যক্রম চালিয়ে যাওয়াই কষ্টকর হয়ে দাঁড়িয়েছে। দেশের ব্যবসায়ীদের যেসব সমস্যা মোকাবিলা করতে হচ্ছে তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে—১. আইন-শৃঙ্খলার অবনতি এবং ফ্যাক্টরি, উৎপাদনকেন্দ্র বা ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে হামলার আতঙ্ক; ২. কাঁচামাল আমদানির জন্য এলসি খোলার সমস্যা; ৩. তারল্য সংকটের কারণে ওয়ার্কিং ক্যাপিটাল বা কার্যকরী মূলধন সংগ্রহে ব্যাংক থেকে সুবিধা না পাওয়া; ৪. ভারী যন্ত্রপাতি আমদানির জন্য এলসি খোলার সমস্যা; ৫. শ্রমিক অসন্তোষ এবং উৎপাদনকেন্দ্রে বিশৃঙ্খলার হুমকি; ৬. ব্যাংক থেকে নতুন ঋণ বা বিদ্যমান ঋণ পুনঃ তফসিলের সুযোগ না পাওয়া; ৭. নতুন নিয়মের কারণে অনেক ভালো ঋণ খারাপ হওয়ার উপক্রম; ৮. বিগত পাঁচ-ছয় মাসের রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে ব্যাবসায়িক কার্যক্রমে বিঘ্ন ঘটলেও ব্যাংকঋণের ওপর সুদ মওকুফ বা কোনো প্রকার গ্রেস পিরিয়ডের সুযোগ না থাকা; ৯. শিল্পে দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগের জন্য ব্যাংক থেকে ঋণ গ্রহণ বা পুঁজিবাজার থেকে তহবিল উত্তোলনের সুযোগ সীমিত হয়ে যাওয়া; ১০. কারখানায় গ্যাস সরবরাহে বিঘ্ন ঘটায় উৎপাদন ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া এবং ১১. বিদেশের ক্রেতাদের সঙ্গে সরাসরি আলোচনার সুযোগ সীমিত। কারণ অনেক ব্যবসায়ী তাদের ব্যাবসায়িক প্রতিপক্ষের সঙ্গে আলোচনার জন্য বিদেশে যেতে পারছেন না। এ ছাড়া আরো অনেক সমস্যা ব্যবসায়ীরা মোকাবিলা করেছেন, যা এখানে তুলে ধরতে গেলে স্থান সংকুলান হবে না।

সবচেয়ে বড় উদ্বেগের বিষয় হচ্ছে যে দেশের এত বড় রাজনৈতিক পরিবর্তনের পর ব্যবসায়ীদের সঙ্গে সরাসরি আলোচনা করে তাদের সমস্যাগুলো শোনা, বোঝা এবং সমাধানের উদ্যোগ সেভাবে নেওয়া হচ্ছে না। এই পদক্ষেপ যেমন অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষ থেকে নিতে দেখছি না, তেমনি দেশের প্রধান প্রধান বিরোধী দল, বিশেষ করে যারা ভবিষ্যতে নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে ক্ষমতায় যাওয়ার প্রতিযোগিতায় এগিয়ে আছে, তারাও ব্যবসায়ীদের সঙ্গে সরাসরি আলোচনা করে তাদের সমস্যা সমাধানের আশ্বাস দিতে পারছে না। ফলে দেশের ব্যবসায়ীরা এক অনিশ্চিত অবস্থার মধ্যে পড়ে আছেন। এর সুদূরপ্রসারী প্রভাব পড়ছে দেশের বিনিয়োগে এবং অর্থনীতিতে। এরই মধ্যে অর্থনীতির অনেক ক্ষতি হয়ে গেছে। আইএমএফ আগামী বছরের জন্য জিডিপি নির্ধারণ করেছে মাত্র ৩.৮ শতাংশ, যা মাত্র ছয় মাস আগেও ছিল ৬ শতাংশের ওপরে। এই অবস্থা দেশের জন্য মোটেই ভালো নয়। অর্থনীতি যদি একবার মুখ থুবড়ে পড়ে, তখন শত চেষ্টা করেও তাকে আর চাঙ্গা করা সম্ভব হবে না।

বাংলাদেশ সময়: ১১০৫ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২৬, ২০২৪
এসআইএস

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।