মনে পড়ে সেই প্রিয়া সাহার কথা? বাংলাদেশ হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের কেন্দ্রীয় কমিটির সাবেক এই সাংগঠনিক সম্পাদক ২০১৯ সালে যখন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের কাছে বাংলাদেশে তথাকথিত সংখ্যালঘু নির্যাতনের অভিযোগ তুলে ধরেছিলেন, তখন কি ভেবেছিলেন যে বিষয়টি এভাবে গড়াবে? সে সময়কার কথা মনে করলে মনে হয়, বাংলাদেশে এক বিপর্যয় অপেক্ষা করছিল। সময় গড়িয়ে গেলেও সেই মিথ্যা অভিযোগের ইকো যেন আজও আমাদের কানে বাজে।
শেখ হাসিনার সরকারের তিনটি অবৈধ নির্বাচনে ‘সমর্থন’ ছিল ভারতের। বাংলাদেশের এসব পাতানো নির্বাচনে ডেমোক্রেটিক পার্টি সবসময় সমালোচনা করে আসছে, তারা সর্বদা আলোচনার মাধ্যমে সমাধানের রাস্তা খুঁজতে বলেছেন, দেশের মানবাধিকার নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। অন্যদিকে ট্রাম্পের রিপাবলিকান পার্টি যখন ক্ষমতায় ছিল, তারা এটা নিয়ে খুব একটা আওয়াজ করেনি। এখন উপন্যাসের ক্রমধারার সাথে আশ্চর্য এক মিল রেখেই যেন দেশের গণঅভ্যুত্থানে ভীত হয়ে ফ্যাসিস্ট হাসিনা পালিয়েছেন, তাও আবার সেই ভারতে যারা কিনা তাকে অবৈধভাবে ক্ষমতায় টিকিয়ে রাখার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করে গেছে! ভারতীয় মিডিয়া তখন অশান্তি ছড়ানোর চেষ্টা করছিল, বাংলাদেশে তথাকথিত সংখ্যালঘু নির্যাতিত হওয়ার খবর যে কতবার বেরিয়েছে, তার কোনো শেষ নেই।
এমন এক সময়, যখন ফ্যাসিস্ট হাসিনার পুত্র সজীব ওয়াজেদ জয় আমেরিকায় দেশকে নিয়ে নতুন করে ষড়যন্ত্রের জাল বোনার জন্য লবিস্ট নিয়োগ করলেন বলেই খবর পেলাম। এরপর, ট্রাম্প আবার সেই পুরনো সুরে কথা বলতে শুরু করলেন, যেন প্রিয়া সাহার অভিযোগের মিথ্যা ও পৌরাণিক কাহিনী নতুন করে আবির্ভূত হয়েছে। আর ঠিক সেই মুহূর্তে আমেরিকায় ভারতের প্রচুর বৈধ ভোটারের খবর শোনা গেল, এদিকে আমেরিকার নির্বাচনের দিন ঘনিয়ে আসছে, সবকিছুই গল্পের ঐকতানে মিলেমিশে একাকার। একই সঙ্গে মোদীর মুসলমানদের বিরুদ্ধে পদক্ষেপগুলোও স্মরণে আসে, ট্রাম্পের আমেরিকায় মুসলমান প্রবেশে নিষেধাজ্ঞার মতোই। অনেক প্রশ্নের জন্ম দেয় এখানে, কিন্তু সবচেয়ে বড় যে বিষয়টা ভাবতে হবে সেটা হচ্ছে আমেরিকার নির্বাচনকে কেন্দ্র করে পরাজিত শক্তি, ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ ভারতের সুবিধা নিয়ে আবারো দেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের ফন্দি আঁটতে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। অর্থাৎ বোঝাই যাচ্ছে ডোনাল্ড ট্রাম্প ক্ষমতায় এলে তারা বিভিন্ন ধরনের ভুয়া তথ্য প্রদানের মাধ্যমে দেশে ফ্যাসিস্ট শক্তি পুনঃপ্রতিষ্ঠা করার একটা নতুন সুযোগ নিতে চাইবে।
সম্প্রতি এক টুইটে ডোনাল্ড ট্রাম্প লিখেছেন, ‘আমি বাংলাদেশে হিন্দু, খ্রিস্টান ও অন্যান্য সংখ্যালঘুদের ওপর বর্বরোচিত সহিংসতার তীব্র নিন্দা জানাচ্ছি। দেশটিতে দলবদ্ধভাবে তাদের ওপর হামলা ও লুটপাট চালানো হচ্ছে। বাংলাদেশ এখন পুরোপুরিভাবে একটি বিশৃঙ্খল অবস্থার মধ্যে রয়েছে। এটা আমার সময় ঘটত না। কমলা এবং জো সারা বিশ্বে এবং আমেরিকায় হিন্দুদের উপেক্ষা করেছে। ’
ট্রাম্প আরও বলেন, ‘আমার প্রশাসনের অধীনে, আমরা ভারত এবং আমার ভালো বন্ধু প্রধানমন্ত্রী মোদীর সঙ্গে আমাদের অংশীদারত্ব আরও শক্তিশালী করব। ’
ডোনাল্ড ট্রাম্পের সাম্প্রতিক মিথ্যা টুইটের প্রতিবাদ জানিয়েছেন বাংলাদেশ খ্রিস্টান অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি এলবার্ট পি কস্টা। তিনি বলেছেন, সম্প্রতি সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এক টুইট বার্তায় উল্লেখ করেন, বাংলাদেশে হিন্দু ও খ্রিস্টানদের ওপর নির্যাতন হচ্ছে যা সম্পূর্ণ মিথ্যা ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। শুধু মার্কিন নির্বাচনে বাংলাদেশসহ এই উপমহাদেশের হিন্দু ও খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের সহানুভূতি পাওয়ার আশায় ও পতিত সরকারের কিছু কিছু এজেন্টদের ইন্ধনে একজন সাবেক বিশ্ব নেতার এমন টুইটে বাংলাদেশ খ্রিস্টান সমাজ হতাশ।
এলবার্ট পি কস্টা আরও বলেন, ৫ আগস্টের পর বাংলাদেশে খ্রিস্টানদের ওপর কোনো হামলা নির্যাতনের ঘটনা ঘটেনি। দুইটা বিচ্ছিন্ন ঘটনা হয়েছে, যা নাকি পতিত স্বৈরাচারী সরকারের সহযোগীদের ওপর হয়েছে, এটা সম্পূর্ণ রাজনৈতিক বিচ্ছিন্ন ঘটনা। একজন দায়িত্বশীল ব্যক্তির এহেন মন্তব্যের কারণে বাংলাদেশে সম্প্রীতি নষ্ট হতে পারে, এমনকি খ্রিস্টানদের ওপর সাবেক সরকারের লোকজন হামলা করে বর্তমান সরকারের অবস্থানকে প্রশ্নবিদ্ধ করারও চেষ্টা করতে পারে। বাংলাদেশ খ্রিস্টান অ্যাসোসিয়েশন আশা করে ট্রাম্প ভবিষ্যতে এমন মিথ্যা টুইট করা থেকে বিরত থাকবেন। মিথ্যা টুইটের জন্য ডোনাল্ড ট্রাম্পকে নিঃশর্ত ক্ষমা চাওয়ার ও দাবি জানানো হয়।
পরিশেষে, একটি জনসম্পৃক্ত সফল অভ্যুত্থানের পর শেখ হাসিনা যেভাবে ক্ষমতার মসনদ ছেড়ে পালিয়ে গেছেন, তা সত্যিই লজ্জার। তার সঙ্গীদের মধ্যে থেকে অনেকেই এখনও দেশে রয়ে গেছেন, বিদেশেও তাদের দৌরাত্ম্য রয়েছে। তাদের হাতে রয়েছে বাংলাদেশের মানুষের ঘাম ও রক্তের বিনিময়ে উপার্জিত অর্থ। মেগা প্রজেক্টে সীমাহীন দুর্নীতি করে ও নীল নকশার মাধ্যমে মানিলন্ডারিং, শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারি এবং বিভিন্ন অসদুপায়ে উপার্জিত পাচার করা অর্থ। এই টাকা দিয়েই তারা নিজেদের পুনর্বাসনের গল্প সাজানোর চেষ্টা করছে এবং দেশকে আবারো একটি ব্যর্থ রাষ্ট্রের দিকে ঠেলে দিতে চাচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে, শেখ হাসিনা স্বার্থপরের মতো যেভাবে পালিয়ে গেছেন, তাতে বোঝাই যায় দেশ তো অনেক দূরের কথা, তার দলের নেতাকর্মীদের প্রতিও তার বিন্দুমাত্র মায়া নেই। তাই দেশের মানুষের জন্য পরাজিত শক্তির ষড়যন্ত্রের দিকে তীক্ষ্ণ নজর রাখা অতীব জরুরি।
দেশে বিদেশে যখন বাংলাদেশে সংখ্যালঘু নির্যাতনের মিথ্যা গালগল্প শোনানো হচ্ছে, তখন আমরা দেখলাম, কিছুদিন আগেই ঘটে যাওয়া হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের বড় ধর্মীয় উৎসব দুর্গাপূজায় বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল-বিএনপিসহ গণতন্ত্রের পক্ষের সকল শক্তি এক হয়ে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে মন্দির পাহারা দিয়েছেন। আকাশে উড়ন্ত সাদা কবুতরের মতো শান্তির এক অনন্য বার্তা ছড়িয়ে দিয়েছেন প্রিয় দেশ মাতৃকায়, যেখানে কোনো সংঘাত সংঘর্ষের কোনো ঠাঁই নেই, আছে শুধু সৌহার্দ্য, সম্প্রীতি আর শান্তির অফুরন্ত বার্তা।
এই পরিপ্রেক্ষিতে, ডোনাল্ড ট্রাম্পের বক্তব্যকে মনে হচ্ছে বাংলাদেশবিরোধী শক্তিগুলোর ষড়যন্ত্রের একটা অংশবিশেষ। তিনি পরাজিত শক্তির প্ররোচনায় গভীরভাবে প্ররোচিত। তবে আমি বিশ্বাস করি, পরিবর্তিত বাংলাদেশে আর কোনো ষড়যন্ত্র সফল হবে না। জনগণ এখন তাদের অধিকার এবং মুক্তির জন্য একত্রিত এবং তাদের দৃঢ়তা এবং সংকল্পই হবে আগামী দিনের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার মূল ভিত্তি। এখন সময় এসেছে সত্যিকারের গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার, যেখানে মানুষের কণ্ঠস্বরই হবে সর্বশ্রেষ্ঠ শক্তি।
লেখক: কথাসাহিত্যিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক।