ঢাকা, মঙ্গলবার, ১৬ পৌষ ১৪৩১, ৩১ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৮ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

মুক্তমত

পর্ব দুই

তিস্তার নদী-ব্যাকরণ

পাভেল পার্থ | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১২২৯ ঘণ্টা, মে ৬, ২০১৪
তিস্তার নদী-ব্যাকরণ খা খা করছে তিস্তা, বালুচরে উড়ছে পাখি

পর্ব এক: লিংক
পর্ব তিন: লিংক

বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড বাংলাদেশের নদ-নদী সমূহের হাইড্রোলজিক্যাল প্রতিবেশ অঞ্চলকে মোট ১৭টি হাইড্রোলজিক্যাল অঞ্চলে ভাগ করেছে। পাশাপাশি পানি উন্নয়ন বোর্ড রায়মঙ্গল, ইছামতি-কালিন্দি, বেতনা কোদলিয়া, ভৈরব কোবাদাক, মাথাভাঙ্গা, গঙ্গা,পাগলা, আত্রাই লোয়ার, পূর্ণভবা, তেঁতুলিয়া, টাংগন, কুলীক, নাগর, মহানন্দা, ডাহুক, করতোয়া, তালমা, ঘোড়ামারা, দেওনাই-চাড়ালকাটা-যমুনেশ্বরী, বুড়ী তিস্তা, তিস্তা, ধরলা, দুধকুমার, ব্রহ্মপুত্র, জিঞ্জিরাম, চিতলখালী, ভোগাই, নিতাই, সোমেশ্বরী, যাদুকাটা রক্তি, জালুখালি-ধামালিয়া, নয়াগাং, উমিয়াম, ধলা, পিআইন, সারি গোয়াইন, সুরমা, কুশিয়ারা, সোনাই বরদল, জুড়ি, মনু, ধলাই, গোপাল-লংলা, খোয়াই, সুতাং, সোনাই, হাওরা, বিজনী, সালদা, গোমতী, কাকরী-ডাকাতিয়া, সেলোনিয়া, মুহুরী, ফেনী, সাঙ্গু, মাতামুহুরী এবং নাফ সহ ৫৭ টি সীমান্ত ও অভিন্ন নদ-নদীর তালিকা তৈরি করেছে।

৩টি বাদে বাকী ৫৪টি নদ-নদী ভারত থেকে প্রবাহিত। বাংলাদেশের এই আন্তঃরাষ্ট্রিক প্রধান অভিন্ন সীমান্ত নদীসমূহের ভেতর তিস্তা চতুর্থতম। প্রাতিষ্ঠানিক নদীবিজ্ঞান অনুযায়ী বাংলাদেশের নদীসমূহকে প্রধান, উপনদী, শাখা নদী, স্বাধীন নদী নামে ভাগ করা হয়। এর ভেতর তিস্তা বৈশিষ্ট্যের দিক থেকে একটি উপনদী। সিকিম থেকে উৎপন্ন হয়ে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ এবং বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে প্রবাহিত তিস্তা নদীর মোট দৈর্ঘ্য ৩১৫ কি.মি.। উত্তর-পশ্চিম হাইড্রোলজিক্যাল অঞ্চলের ৯৬টি নদীর ভেতর অন্যতম এই তিস্তার আইডি নাম্বার ১৩১।

সিকিম এবং তিব্বতের সংয়োগকারী পর্বত অঞ্চলে সো-লামু/চালামু/লাহামো লাৎসা পাহাড়ি হ্রদের অবস্থান। উত্তর সিকিমের ৬.৫ কি.মি দীর্ঘ এবং ২.৫ কি.মি প্রশস্থ এই পবিত্র হ্রদ থেকেই তিস্তার জন্ম। স্থানীয়দের কাছে এই হ্রদ তিব্বত রক্ষাদেবীর জীবন-হ্রদ হিসেবে বিবেচিত। সমুদ্র সমতল থেকে ১৭,৪৮৭ ফুট উঁচুতে হিমালয় পর্বতের সো-লামু হ্রদ ছাড়াও গুরুডংমার হ্রদও তিস্তার আরেক জননী। সিকিম-তিব্বতের পাহাড় থেকে প্রবাহিত হয়ে তিস্তা দার্জিলিং-থাংগু-ইয়্যুমথাম-ডংখিলা-রাংপু-তিস্তাবাজার হয়ে জলপাইগুড়ি দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। সিকিম পাহাড় থেকে নেমে এই জলধারা রাংগিত নদী নামে প্রবাহিত হয়ে জলপাইগুড়িতে পূর্বদিকে করতোয়া, পশ্চিমে পূনর্ভবা এবং মধ্যে আত্রাই নামে তিনটি ভাগে প্রবাহিত হয়েছে। তিনটি স্রোতস্বী নদীর মিলিত রূপকেই ‘ত্রিস্রোতা’ হিসেবে ডাকতে ডাকতে একসময় নদীটির নাম তিস্তা হয়ে যায় বলে অনেকের ধারণা। সিকিম থেকে উৎপন্ন হয়ে উত্তর-পূর্ব ভারতের ভেতর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে তিস্তা বাংলাদেশের নীলফামারী জেলার ডিমলার ছাতনাই এলাকা দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। নীলফামারী, লালমনিরহাট, রংপুর, কুড়িগ্রাম ও গাইবান্ধা জেলার ডিমলা, পাটগ্রাম, জলঢাকা, গংগাচড়া, হাতিবান্ধা, কালিগঞ্জ, কাউনিয়া, রাজারহাট, লালমনিরহাট, চিলমারী, সুন্দরগঞ্জ, পীরগাছা ও উলিপুর এলাকা দিয়ে প্রবাহিত হয়ে কুড়িগ্রামের চিলমারীর কাছে ব্রহ্মপুত্র নদে মিলিত হয়েছে। তিস্তা ছাড়াও উত্তর-পূর্ব হাইড্রোলজিক্যাল অঞ্চলের আরও দুটি নদীর নাম তিস্তা। এদের একটি বুড়ি তিস্তা নামে এবং আরেকটি মরা তিস্তা নামে প্রবাহিত।

রংপুরের বদরগঞ্জ উপজেলার নিম্নাঞ্চল থেকে উৎপন্ন এবং বদরগঞ্জের যমুনেশ্বরী নদীতে মিলিত হওয়া ১৮ কি.মি. দৈর্ঘ্য এবং ২০ বর্গ কি.মি অবববাহিকার একটি নদীর নাম মরাতিস্তা (আইডি নাম্বার-২৪৮)। সীমান্ত নদী বুড়ি তিস্তা (আইডি নাম্বার-১৮৮) নীলফামারীর ডোমার দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করে জলঢাকা এলাকায় তিস্তার সাথে মিলিত হয়েছে। বুড়ি তিস্তার দৈর্ঘ্য ৩৫ কি.মি. এবং মোট অববাহিকা ৭০ বর্গ.কি.মি.। নীলফামারীর ডিমলার খগাখগি বাড়ীর নিম্নাঞ্চল থেকে উৎপন্ন হয়ে ধূম নদী (আইডি নাম্বার-১৪১) জলঢাকা এলাকায় বুড়িতিস্তার সাথে মিলিত হয়েছে। ১৭ কি.মি দৈর্ঘ্যরে ধূম নদীর মোট অববাহিকা ৫১ বর্গ কি.মি.। ডিমলার পূর্ব ছাতনাই নিম্নাঞ্চল থেকে উৎপন্ন ২২.৮০ কি.মি. দৈর্ঘ্য এবং ৩০ বর্গ কি.মি. অববাহিকার নাউতারা নদী ডিমলাতেই বুড়িতিস্তায় মিলিত হয়েছে। লালমনিরহাটের কালিগঞ্জ উপজেলার হরিশ্বর বিল থেকে উৎপন্ন সতী-স্বর্ণামতি-ভাটেশ্বরী নদী (আইডি নাম্বার-২৭৮) লালমনিরহাট সদরের কাছে তিস্তার সাথে মিলিত হয়েছে। ৬০ কি.মি. দৈর্ঘ্যরে এই নদীর মোট অববাহিকা ১১০ বর্গ কি.মি.। নীলফামারীর কিশোরগঞ্জের নিম্নাঞ্চল থেকে উৎপন্ন ২৯ কিম.মি. দৈর্ঘ্য এবং ৬০ বর্গ কি.মি. অবববাহিকার মানস নদী (আইডি নাম্বার-২২৮) রংপুরের কাউনিয়া এলাকায় তিস্তার সাথে মিলিত হয়েছে।

এরকম অসংখ্য জলধারার সম্মিলিত তিস্তাতে বছরের প্রায় সময়েই কমবেশী প্রবাহ থাকে। তিস্তার বাংলাদেশ অংশের দৈর্ঘ্য ১১৩ কি.মি, প্রস্থ ৯৫০ মিটার (ডালিয়া), গভীরতা ৫.৫০ মিটার (ডালিয়া) এবং বাংলাদেশে তিস্তার মোট অববাহিকা ১৭১৯ বর্গ কি.মি। বর্ষাকালে (আগস্ট-সেপ্টেম্বর) প্রবাহ থাকে ৪৪৯৪ ঘনমিটার/সেকেন্ড এবং গভীরতা ৫.৫০ মিটার থাকলেও শুষ্ক মওসুমে পানি কমে শীর্ণ হয়ে পড়ে তিস্তা। শুষ্ক মৌসুমে (ফ্রেব্রুয়ারি-মার্চ) তিস্তার বাংলাদেশ অংশে আনুমানিক প্রবাহের পরিমাণ ৮ ঘনমিটার/সেকেন্ড(ডালিয়া) এবং গভীরতা এক মিটার থাকে। দেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের তিস্তা প্লাবন সমভূমি কৃষিপ্রতিবেশ অঞ্চলের কৃষি ও জনজীবন এই তিস্তা স্রোতধারার উপরই বেঁচেবর্তে আছে।

তিস্তার প্রাণ ও প্রতিবেশ

যাপিতজীবন কি রাজনৈতিক শোরগোলে তিস্তা গুরুত্বপূর্ণ জলধারা হলেও তিস্তার প্রতিবেশ ও তিস্তা অববাহিকার প্রাণবৈচিত্র্য নিয়ে কোনো ধারাবাহিক গবেষণার দলিল দস্তাবেজ ধারেকাছে নাই। বাংলাদেশ অংশে তো একবারেই নাই, ভারতের অংশেও যা আছে তা যথেষ্ট নয়। তার মানে তিস্তার প্রাণ ও বৈচিত্র্য বিকাশে রাষ্ট্রের এজেন্সি ও বিদ্যায়তনিক ধারাগুলোর মনোযোগের ঘাটতি আছে। তিস্তার নিম্নঅববাহিকায় ২০১০ সনে স্বল্প বিস্তারে করা এক অংশগ্রহণমূলক সমীক্ষা  থেকে জানা যায়, এক কালে তিস্তা ছিল পাহাড় ও সমতলের মাছেদের মিলনস্থল। তিস্তা অববাহিকার বাঙালিরা তিস্তাসহ প্রাকৃতিক প্রবাহের মাছকে দেশোয়াল মাছ বলেন। চাষকৃত মাছগুলা অনেকের কাছেই ‘কার্ফ্যু’ হিসেবে পরিচিত। মাগুর, পোক্তা, ভোঁদরগালি, গজার, বোয়াল, শোল, চিলি, ফলি, বৈরাল, রুই, আইড়, বাঘাইড়, ঘোল, নাড়িয়া, ইছলা হলো তিস্তার দেশোয়াল মাছ। একসময় তিস্তায় ইলিশ মাছও পাওয়া যেত। তিস্তা অববাহিকায় ক্ষেতফসলের আইল, গ্রামীণ বন, মাঠ, বিলের কিনার, নদীর পাড়, রাস্তার ঢালে নানান জাতের কুড়িয়ে পাওয়া শাকলতাপাতা জন্মে। এরাও বেঁচে থাকে তিস্তার জলের গুঞ্জনে। ঢেকিয়া, কচু, ওসুন, কলমু, ডাবুরি, কালাকচু, বিষ মানা, ঢেকিয়া, জোংয়ের ডেরা তিস্তা অববাহিকার কুড়িয়ে পাওয়া শাক। তিস্তা অববাহিকা ডুংর বা দুমরা ও আগুড়ি ধানের আঁতুরঘর। তিস্তাপাড়ের আউশ ধান গতাদুমরা, পত্নীদুমরা, বাঙাল, চেংডুমরা, ধলি, ডুংরা, পাড়াশি, চাপল, লাল গড়িয়া, কালা গড়িয়া. । আমন মওসুমের ধান মধুঘাস, দুধকলম, ফুলপাকড়ি, মালশিরা, ঢেপা, পুলগাজী, নালঢেপা, ভোগ ধান, কাজলঢেপী, অঘনঢেপী, ফকির ধান, যশোয়া, কচুদোলা, খইয়াল, কাকুয়া, বিন্যাফুল, নোহাজাং, লালআগুড়ি, কালাআগুড়ি, সাটিয়া আগুর, কাতিশাইল। কিন্তু এসব মাছ, তরু লতা গুল্ম কি দেশোয়াল ধান এখন নিরুদ্দেশ। ১৯৬০ সনের পর থেকে তথাকথিত সবুজ বিপ্লবের মার্কিন উন্নয়নপত্র হাতে নিয়ে তিস্তা অববাহিকার জমিন থেকে রাষ্ট্র এসব ধান তুলে হত্যা করেছে। পাশাপাশি যন্ত্র দিয়ে মাটির তলার জল টেনে তুলে, বিষ ও সার আমদানি করে, সংহারী বীজের ব্যবসাকে বৈধ করে রাষ্ট্র গড়ে তুলেছে ‘খাদ্য নিরাপত্তা প্রকল্প’। মাঠঘাট থেকে ‘আগাছা’ বলে বিষ ঢেলে মেরে ফেলা হয়েছে সকল কুড়িয়ে পাওয়া খাদ্য ও ঔষধি। কৃষি জমিনের বিষ গিয়ে নদীতে পড়ে মরেেছ মাছ, ব্যাঙ, সাপ, কাছিম, শামুক কত কি। মাটিতে আর রস নেই, মাটির স্বাস্থ্য ভেঙ্গে গেছে। রাষ্ট্রীয় কৃষি উন্নয়ন প্রকল্পে দেশের অপরাপর জুমজমিনের মতই তিস্তা অববাহিকার কৃষিজমিকে উন্নয়নের ছুতোয় ধ্বজভঙ্গ করে দেয়া হয়েছে। পাশাপাশি আছে তিস্তার প্রবাহকে দিনকে দিন বাঁধ ও ব্যারেজের নামে থ্যাৎলে থ্যাৎলে পিষে মারা রাষ্ট্রীয় উন্মাদনা। তিস্তার জল শুষে আর তরতাজা হতে পারছে না তিস্তার নিম্ন অববাহিকা। ২০১০ সনে লালমনিরহাট, কুড়িগাম, নীলফামারী ও কুড়িগ্রাম অঞ্চলে উল্লিখিত সমীক্ষার সময় তিস্তাপাড়র প্রবীণ নারী-পুরুষেরা জানিয়েছেন, তিস্তা অববাহিকার প্রাণবৈচিত্র্য ও খাদ্যশৃংখল নিদারুণভাবে বিপর্যস্ত। বৈচিত্র্য দিন আশংকাজনকভাবেই কমছে। নদীর প্রবাহ ও গতিপথ বদলে যাওয়ার পাশাপাশি রাষ্ট্রীয় বৃহৎ উন্নয়ন পরিবর্তনসমূহকেও তারা আলাপে টেনেছেন।

বাংলাদেশের ২৮৯ প্রজাতির মিঠাপানির মাছের ভেতর তিস্তা নদীর মাছবৈচিত্র্য দিনে দিনে কমে আসছে। তিস্তা নদীর বাংলাদেশ অংশের মাছবৈচিত্র্য ও তিস্তা নদীর জেলে জীবন শীর্ষক এক সমীক্ষায় এম এ রহমান খান ও অন্যান্যরা তিস্তা নদী থেকে মোট ৪২ প্রজাতির মাছ নথিভুক্ত করেন। পাশাপাশি তারা তিস্তা নদীর জেলেদের শিক্ষা-স্বাস্থ্য-অর্থনীতি-পেশা ও বয়সভিত্তিক দুঃসহ করুণ পরিস্থিতি তুলে ধরেন । ভারতের পশ্চিমবঙ্গের জলপাইগুড়ি জেলার গাজোলডোবা এলাকার তিস্তা ব্যারেজ প্রকল্পের চারধারজুড়ে অবস্থিত গাজোলডোবা বিল, সরস্বতীপুর বন ও সরস্বতীপুর চাবাগান ও গ্রামে উদ্ভিদবৈচিত্র্য মূল্যায়ণ এবং সেসবের স্থানীয় ব্যবহার শীর্ষক একটি সমীক্ষা করেছেন দিব্যেন্দু তালুকদার। ২০১৩ সনে প্রকাশিত এ সমীক্ষায় তিনি তিস্তা ব্যারেজ প্রকল্পের চারধারে প্রায় ৮১ প্রজাতির উদ্ভিদ বৈচিত্র্য চিহ্নিত করেন এবং এসবের স্থানীয় ব্যবহার নথিভুক্ত করেন। পর্যটন, ব্যারেজের কর্মকান্ড এবং মানুষঘটিত অনাচারকে উদ্ভিদবৈচিত্র্য সংরক্ষণে তিনি সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করেন। তিস্তার নিম্ন অববাহিকার উদ্ভিদবৈচিত্র্য সংরক্ষণে জোর পদক্ষেপ নেয়ার প্রস্তাবও রাখেন তিনি

তিস্তার মূল উজান উত্তর-পূর্ব ভারতের সিকিম। তিস্তা এবং রঙ্গিত হলো সিকিমের মূল দুই জলপ্রবাহ। এ দুটি জলধারার মাছবৈচিত্র্য বিশ্লেষণ করে সরোজ তপ্প ও অন্যান্যরা দেখিয়েছেন, এসব জলপ্রবাহের উপর বেঁচে আছে আশালা, কাটলে, বধূনা, কাব্রে, চিরকি, চেপ্টির মতো বিরল প্রজাতির মাছ। সিকিমে ২৭টি প্রস্তাবিত ও নির্মাণাধীন জলবিদ্যুৎ প্রকল্প ও বাঁধ তিস্তা ও রঙ্গিতের জলপ্রবাহ ও পানির ধর্মকে বাঁধাগ্রস্থ করছে। যা সরাসরি মাছবৈচিত্র্যর উপর বিরূপ প্রভাব তৈরি করছে১০ । ভারতের পশ্চিমবঙ্গের জলপাইগুড়িয়ে তিস্তার শাখা করলা নদীতে সিপ্রিনিফরমিস বর্গের উপর গবেষণা করে ২০১০ সনে অমল কুমার পাত্র ও তন্ময় দত্ত ৩১ প্রজাতির মাছ নথিভূক্ত করেন। চেপচেলা, বাঁশপাতা, থারড়বেকা, চেলা, অঞ্জু, ডানকুনি, দুধিখা, দারকিনা, খোকশা, জয়া, ভোলা, চেদ্রা, মৌরালা, মরার, কাঞ্চন পুঁটি, বাঘা পুঁটি, তিঁত পুঁটি, ভূষন্ডি পুঁটি, কুর্টি, সরপুঁটি, চৈতা পুঁটি, মহাশোল, বাঘাড়, ঘন্টা, রাইগ বাটা, কারকি বাটা, মৃগেল, কলাবাটা, দারঙ্গি, ভাগনা বাটা, নাওতা, ঘুতুম, পয়া, ঘরপয়া, লাঠি মাছ তারা সনাক্ত করেন। তাঁদের আগে তিস্তাপ্রবাহ থেকে ১৯৩৭ সনে জি ই শ এবং ই ও শিবারী সিপ্রিনিফরমিস বর্গের প্রায় ৬৭ প্রজাতির মাছ নথিভূক্ত করেন। গবেষণাদুটির উপাত্ত বিশ্লেষণে এটি স্পষ্ট হয় যে, তিস্তাপ্রবাহে মাছবৈচিত্র্য কমছে। অমল কুমার পাত্র ও তন্ময় দত্ত এর কারণ হিসেবে তিস্তার নদী ভাঙন, আশেপাশে চাবাগানসহ নানাবিধ রাসায়নিক বিষ ব্যবহার এবং নদীর স্রোতপ্রবাহ বাধাগ্রস্থ হওয়াকে দায়ী করেছেন১১ । ভারতের পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ের সুপারিশে করা তিস্তা ব্যারেজের ফলে তিস্তা অববাহিকার প্রাণবৈচিত্র্য ও পরিবেশগত মূল্যায়ণ শীর্ষক দিল্লী বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষণায় দেখা যায়, তিস্তা অববাহিকায় ৩৪১৮ প্রজাতির উদ্ভিদ ও ১৬৯ প্রজাতির স্তন্যপায়ী প্রাণী আছে। তিস্তা অববাহিকায় প্রায় ৪০ প্রজাতির বাদুড় দেখা যায়১২ । ভারতের দার্জিলিংয়ের পাহাড়ি এলাকার তিস্তা অংশে মাছবৈচিত্র্যের উপর এক সমীক্ষায় তিস্তার পাহাড়ি স্রোতস্বী শীতল জলে এম এল আচার্য ও এস বারাত প্রায় ৬৫ প্রজাতির মাছ তালিকাভূক্ত করেন। তিস্তা নদীর উপর মাত্রাতিরিক্ত মানুষঘটিত বিপর্যয় ও এর পানিপ্রবাহে বাঁধাদানকে মাছবৈচিত্র্য সংরক্ষণ এবং তিস্তার মাছ জিনপুলের ক্ষেত্রে হুমকী হিসেবে চিহ্নিত করেন তারা১৩

………………………

৭ তিস্তা অববাহিকার প্রাণবৈচিত্র্যকে জানাবোঝার জন্য ২০১০ সনের জুলাই-আগষ্ট মাসে সংগঠিত পাভেল পার্থের এক অংশগ্রহণমূলক সমীক্ষার তথ্যবিবরণী থেকে এ অংশটুকু লেখা হচ্ছে। যাদের জ্ঞান ও চিন্তা প্রধানসূত্র হিসেবে কাজ করেছে :  লালমনিরহাটের সদর উপজেলার রাজপুর ইউনিয়নের রাজপুর গ্রামের সুধাংশু মোহন্ত (বয়স-৬০, কৃষক, মা-বিমলা রানী মোহন্ত, বাবা-সুধীর চন্দ্র মোহন্ত), মুক্তিযোদ্ধা মোহন চন্দ্র বর্মণ (বয়স-৮০, মা-কৃষ্ণা বালা, বাবা-ধরণী কান্ত বর্মণ), ডুলুমণি বর্মণ (বয়স-৮০, মা-আকাময়ী ও বাবা-ভ’পেন্দ্র বর্মণ), গাদলী বর্মণ (বয়স-৮০, মা-সব্বে বর্মণ, বাবা-দেবেশ্বের বর্মণ), একাদশী বর্মণ (বয়স-৭৫, মা-ছিল্ল্যানি বর্মণ ও বাবা টেপরা বর্মণ)। তিস্তার প্রাণবৈচিত্র্য সুরক্ষায় তিস্তাবাসীর জ্ঞানকে অগ্রাধিকার দিয়ে বিবেচনা করতে হবে। পাশাপাশি রাষ্ট্রীয় সনদ ও জাতিসংঘের আন্তজার্তিক প্রাণবৈচিত্র্য সনদকেও আলোচনায় রাখা জরুরি।

৮ M.A. Rahman Khan,M. Idris Miah,M. Belal Hossain,Afroza Begum,M.H. Minar and Rajaulkarim, 2013, Fish Biodiversity and Livelihood Status of Fishing Community of Tista River, Bangladesh, Global Veterinaria 10 (4): 417-423, 2013

৯ Dibyendu Talukdar, 2013, Species richness and floral diversity around ‘Teesta Barrage Project’ in Jalpaiguri district of West Bengal, India with emphasis on invasive plants and indigenous uses, Biology and Medicine, 5: 01-14, 2013, availavle at : www.biolmedonline.com

১০Saroj Toppo, H. Rahman and N. Haque, Fish Biodiversity as an Indicator of Riverine Status of Sikkim, http://sikkimforest.gov.in/Reports%20and%20Publications/Biodiveristy-of-Sikkim/12%20Fish_221-232%20web.pdf

১১Amal Kumar Patra and Tanmay Datta. 2010, Diversity of Cypriniformes fish fauna in Karala river, a tributary of Teesta at Jalpaiguri district of west Bengal, India, Research Journal of Biological Sciences 5(1) : 106-110

১২Carrying capacity study Teesta basin in Sikkim: Executive summary and Recommendation, Commissioned by Ministry of Environment & Forests, Government of India, Sponsored by National hydroelectric power corporation ltd. Faridabad, Centre for inter-disciplinary studies of mountain & hill environment, University of Delhi, India

১৩M. L. Acharjee  and S. Barat, 2013, Ichthyofaunal Diversity of Teesta River in Darjeeling Himalaya of West Bengal, India, ASIAN J. EXP. BIOL. SCI. VOL 4 (1) 2013

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।