ঢাকা, মঙ্গলবার, ১৬ পৌষ ১৪৩১, ৩১ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৮ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

মুক্তমত

পর্ব তিন

পুরুষালি বাঁধ ও তিস্তার অকাল গর্ভপাত

পাভেল পার্থ | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৫৪৯ ঘণ্টা, মে ৭, ২০১৪
পুরুষালি বাঁধ ও তিস্তার অকাল গর্ভপাত

পর্ব এক: লিংক
পর্ব দুই: লিংক
পর্ব চার: লিংক

কিউসেক দৃষ্টিভঙ্গি


বাংলাদেশের শহুরে রাজনৈতিক পরিসরে চলতি সময়ের এক মূখ্য বাহাসের বিষয় ‘তিস্তা চুক্তি’। তিস্তা নিয়ে একদম জানপ্রাণ শোরগোল।

যারা কোনোদিনও দেশের কোনো জলপ্রবাহের একবিন্দু ন্যায্যতা দাবি করেনি, তারাই নানান সময়ে কখনো ফারাক্কা কখনো তিস্তা নিয়ে ‘রাজনৈতিক দরবারে’ চারদিক তুলকালাম করে তুলে। বিষয়টি যত না নদীর ব্যাকরণের সঙ্গে জড়িত, তারচে বেশি তা ‘ভারত-বিরোধীতার’ এক অহেতুক রাজনৈতিক হাঙ্গামা উসকে দেয়। গত দশ বছর ধরে বাংলাদেশ কি ভারতের রাষ্ট্রপ্রধানরা যখনই দুটি রাষ্ট্রে সফরে গেছেন তখন অনেক তর্কের ভেতর ‘তিস্তার পানিকে ভাগাভাগি করে নেয়ার তর্কটি’ সেইসব রাষ্ট্র বেশ জোর দিয়ে দেখেছে। কখনো কখনো রাষ্ট্রীয় সফরসমূহের সফলতা কি ব্যর্থতার প্রসঙ্গে বারবার তিস্তা নদীর পানিবন্টন নিয়ে পারস্পরিক বাদানুবাদ চরমে পৌঁছেছে। রাষ্ট্র হিসেবে তিস্তার উজানের ভারত ও ভাটির বাংলাদেশ তিস্তা-তর্ক জারি রাখলেও সকলেই ঐতিহাসিক তিস্তা নদীকে কেটে ছিঁড়ে টুকরো করতে চাইছে। এতে কারো একবিঘত পার্থক্য নেই। এমনকি দেশের আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জাতীয় পার্টিসহ ভারতের বড় রাজনৈতিক দল তিস্তা ভাগাভাগি প্রশ্নে কারোর কোনো বিরোধ নেই। এখানে আর কোনো ভিন্ন মতাদর্শ বা রাজনৈতিক ঘোঘণা নেই। রক্তাক্ত নদীর লাশের ভাগ নিয়েই ভারত-বাংলাদেশের যাবতীয় রাজনৈতিক দেনদরবার। কোনো রাষ্ট্রই, রাষ্ট্রের কোনো বৃহত্তর রাজনৈতিক দলই নদীটিকে আর তার নিজের মতন আস্ত রাখতে চাইছে না। রাষ্ট্র শাসকরা তিস্তার জলপ্রবাহের কতভাগ ছিনিয়ে নেবে তা নিয়ে ক্ষমতার লড়াই তুঙ্গে। এখনো পর্যন্ত উভয় রাষ্ট্রই তিস্তার দৃষ্টিতে নয়, বরং রাষ্ট্রের দুর্বৃত্ত ক্ষমতার দেনদরবার থেকেই ‘তিস্তা চুক্তিকে’ দেখছে। তিস্তা অববাহিকার বাংলাদেশ ও ভারতের নিম্নবর্গের তিস্তা-জীবন থেকে তথাকথিত ‘তিস্তা চুক্তির’ আখ্যান রচিত হয়নি। প্রতিবেশীয় রাজনৈতিক জায়গা থেকে নদীকে এভাবে রাষ্ট্র-ক্ষমতার গায়ের জোরে ভাগ-বিভাগ করাকে নদীর উপর সহিংসতা হিসেবেই পাঠ করা হয়। এটি নদীর উপর ঐতিহাসিক রাষ্ট্রীয় জুলুম। বাঁধ, উন্নয়ন প্রকল্প, বিদ্যুৎ প্রকল্প, অবকাঠামো, জলশাসন কি জল-ভাগ করে কোনো নদীকে কেটে কেটে টুকরো টুকরো করার ভেতর দিয়ে কোনোভাবেই কোনোধরনের প্রতিবেশীয় ন্যায্যতা নিশ্চিত হয় না। পাহাড় ও বনভূমির জরায়ুতে জলপ্রবাহের জন্ম হয়। তারপর তা ছড়া, ঝিরি, ঝর্না, খাল, নদ- নদী কত নামে, কত পরিচয়ে উজান থেকে ভাটিতে তার জটিল জীবনগাথা মেলে ধরে। কেবলমাত্র তিস্তা চুক্তি নয়, নদী বিষয়ক কোনো চুক্তির ক্ষেত্রেই নদীর এ ঐতিহাসিক জীবনধারা ও নদী-দর্শনকে আমলে নেয়া হয় না। কত কিউসেক জল কে ব্যবহার করবে তা নিয়েই দেনদরবার চলে। নদী তার নিয়মে উজান থেকে ভাটিতে গড়িয়ে যাবে। এখানে কোনো ব্যক্তি, কি রাষ্ট্রই কোনোভাবে নদীর উপর একক কর্তৃত্ব ও বলপ্রয়োগ করতে পারে না। কিন্তু ঐতিহাসিকভাবে নদীর উপর এমনি প্রশ্নহীন অনিবার্য রাষ্ট্রীয় আঘাত ও নিপীড়ন আমরা দেখে আসছি। তিস্তা নদীর জলপ্রবাহকে ‘কিউসেক দৃষ্টিভঙ্গিতে’ না দেখে, এর প্রবাহিত জীবনআখ্যানকে বিবেচনা করে বাংলাদেশ ও ভারতের উচিত তিস্তার উপর রাষ্ট্রীয় ন্যায়পরায়ণতা নিশ্চিত করা।
তিস্তা নদীর জলধারাকে বাংলাদেশ ও ভারতের ক্ষমতাসীন রাজনীতিকেরা আটচল্লিশ-বায়ান্নো কি পঞ্চাশ-পঞ্চাশ অনুপাতে ভাগ করতে সোচ্চার। পঞ্চাশ-পঞ্চাশ অনুপাতকে জলপ্রবাহের সমানভাগ দেখিয়ে বলা হচ্ছে ‘পানিবন্টনের ন্যায্য হিস্যা’। একটি জলজ্যান্ত নদীকে তার আপন গতিপথ থেকে সরিয়ে এভাবে ভাগ-বিভাগের রাজনীতিতে স্পষ্ট হয়েছে তিস্তাকে কেউই বাঁচতে দিতে চায় না। তিস্তা নিয়ে এই ভাগ-বিভাগের বিতণ্ডায় একটি গল্পের কথাই মনে পড়ে যায় বারবার। একবার দু’জন নারী এক শিশুকে উভয়েই নিজের সন্তান বলে দাবি করেন। বিচারকের কাছে যাওয়ার পর বলা হয় সন্তানটিকে কেটে সমান দুই টুকরো করা হবে। তারপর দুই নারীকে দুই টুকরো দিয়ে দেয়া হবে। নারীদের একজন এতে সম্মতি দেন এবং তিনি শিশুটির মাথাসহ শরীরের উপরের অংশ দাবি করেন। কিন্তু দ্বিতীয় নারী বিচারকের এই নৃশংস পন্থাকে অস্বীকার করে শিশুটিকে না কেটে প্রথম নারীকেই জীবন্ত শিশুকে দিয়ে দেয়ার অনুরোধ করেন। বিচারক বুঝতে পারেন শিশুটির সত্যিকার মা কোনজন। তিস্তা নদী ভারত ও বাংলাদেশ উভয় জনপদের সন্তান। রাষ্ট্রের দায়িত্ব তার সন্তানের সুরক্ষা নিশ্চিত করা। রাষ্ট্রের মনোজগতে তিস্তার প্রতি সেই সাহস ও ভালবাসো জাগ্রত হোক, যেখানে তিস্তাকে টুকরো না করে তার আপন গতিধারা নিশ্চিত করবে উভয় রাষ্ট্র। ভারতের জলপাইগুড়ির গাজলডোবা ও বাংলাদেশের নীলফামারীর ডালিয়ায় বাঁধ ও ব্যারেজ চালু রেখে তিস্তার সত্তাকে নিয়ন্ত্রিত করার মানসিকতা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। কারণ নদীকে নিয়ন্ত্রণ করার এ মানসিকতাই ‘কিউসেক দৃষ্টিভঙ্গির’ জন্ম দিয়েছে। যেখান থেকে কোনো রাষ্ট্রই সরে এসে তিস্তার নদী-ব্যাকরণের সঙ্গে সামিল হতে পারছে না।

আজ তিস্তার ন্যায্যতায় রাজনৈতিক দলসমূহ গণপদযাত্রা সংগঠিত করছে। কিন্তু দুঃখজনকভাবে সেসব কর্মসূচিতে তিস্তাবাসীসহ দেশের সকল মানুষ জান-জীবন নিয়ে যোগ দিচ্ছে না। কারণ এসব কর্মসূচি কোনোভাবেই তিস্তা প্রশ্নকে দেশের মৌলিক রাজনৈতিক প্রশ্ন হিসেবে হাজির করতে পারেনি। ফারাক্কা বাঁধের বিরুদ্ধে ভাটি থেকে উজানে সংগঠিত ফারাক্কা গণপদযাত্রায় যোগ দিয়েছিল হাজারো লাখো গরিব নিম্নবর্গ। কারণ তখন প্রশ্নটি রাজনৈতিকতা ও সাংগঠনিক জায়গা থেকে মানুষের ছিল, নদীজীবনের ছিল। আজ যখন নদীজীবন লুটেরারাই এ দলে থাকলে উজানের সঙ্গে তিস্তা নিয়ে দরকষাকষি, আবার ওই দলে থাকলে করছে লংমার্চ তখন এসব রাজনৈতিক মাস্তানি আর বাহাদুরির সঙ্গে কোনো মানুষ সামিল হতে চায় না। কারণ জলজীবনের সঙ্গে বেঈমানি করা, পানিকে বেইজ্জতি করা এ জনপদের নিম্নবর্গের নদীদর্শন নয়। এসব বিষয় বোঝে-জেনে আন্দাজ করেই নদীর ন্যায্যতা সুরক্ষায় জানপ্রাণ নিয়ে নামা জরুরি। তা না হলে যে দেশ নদী সুরক্ষার দীর্ঘ গণপদযাত্রা করেছে, সে দেশের নদী গণপদযাত্রার বর্তমান হাল হকিকত দেখে সারা দুনিয়ার ভিড়মি লাগে। নদীকে এমনি এমনি উছিলা করে সামনে রেখে নিজেদের সাংগঠনিক রাজনৈতিক কর্মসূচিকে চাঙ্গা রাখার এসব মুখস্থ পুরনো কৌশল বিশ বছর আগে ধরা না গেলেও আজকের দিনে হরহামেশাই মানুষ এসব বিবেচনা করে। ধরে ফেলে। সিদ্ধান্ত নেয়। আর তাই ফারাক্কা গণপদযাত্রার পর, তিস্তা নদী নিয়ে সংগঠিত নানান কর্মসূচিতে নদীবাসী মানুষের উপস্থিতি শূন্য। কারণ দেশের এই নদীবাসী নিম্নবর্গ প্রতিদিনই নদীর আপন ধারার সুরক্ষায় জানজীবন দিয়ে লড়াই করে যাচেছ। গ্রামের ধনী প্রভাবশালী থেকে শুরু করে চেয়ারম্যান, জনপ্রতিনিধি, সরকারি কর্মকর্তা, এনজিও, সার-বিষ ব্যবসায়ী, ইজারাদার, প্রকৌশলী, মন্ত্রী, রাষ্ট্র, বহুজাতিক বাজার, উজানের হাঙ্গামা সকল কিছুর বিরুদ্ধেই প্রতিক্ষণ দাঁড়াতে হয় দেশের নদীজীবনের মানুষকে নদীর আপন প্রবাহ সুরক্ষায়।

যেকোনো কিছুতেই চিৎকার করা যায়, ফেনা তোলা যায়, ভিজিয়ে ফেলা যায় কিন্তু নদীর ব্যাকরণ না বুঝে নদী-রাজনীতি চলে না। আর এজন্যই রাষ্ট্র ও রাজনৈতিক দল আলাদা হলেও ভারত ও বাংলদেশের ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক প্রক্রিয়াগুলো সকলেই অভিন্ন নদীর ক্ষেত্রে ‘কিউসেক দৃষ্টিভঙ্গি’ ধারণ করে। যার যেমন মাজার জোর, সে তেমনি নদীর উপর বাঁধ কি ব্যারেজ বানায়। আর মিথ্যা সাফাই প্রচার করে ‘কৃষিকাজের জন্য সেচের পানি’ জোগাতেই নদীর বুকের কলিজা থ্যাতলে বান দেয়া হয়েছে’। যার যায় সে-ই জানে কী তার গেছে। নদী নিরুদ্দেশ হলে, আহত কি নিহত হলে নদীজীবনের নিম্নবর্গই সেই জ্বালা রক্তে টের পায়। পানি উন্নয়ন বোর্ডের প্রকৌশলী, নদীমন্ত্রী, যৌথ কমিশন, রাষ্ট্রপ্রধান, বাঁধ নির্মাণ সরঞ্জাম ব্যবসায়ী, এলাকার চাঁদা আদায়কারী রাজনৈতিক মাস্তান কারো তাতে একবিন্দু কিছুই যায় আসে না। দেশে কি কম নদী মরেছে? দেশে কি কম জলপ্রবাহ দখলে রেখেছে রাজনৈতিক দুবৃর্ত্তরা? কাপ্তাই জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের জন্য একলাখ মানুষ নিরুদ্দেশ হয়েছে। দেশের ভেতর যেসব নদীতে অন্যায়ভাবে রাবার ড্যাম, সেচপ্রকল্প ও ব্যারেজ করা হয়েছে সেখানে ভাটি ও উজানে পানি ব্যবস্থাপনা নিয়ে প্রতিদিন খবরদারি করছে কে? বাংলাদেশ কি নিজ দেশের ভেতরে কোনো একটি নদীর সুরক্ষা দিতে পেরেছে? কোনো রাজনৈতিক দল কি কোনো একটি নদীর দায়িত্ব নিয়ে সে নদীর উপর থেকে যাবতীয় বাঁধা সরাতে সচেষ্ট হয়েছে? হয়নি। কারণ রাষ্ট্র ও রাষ্ট্রের এজেন্সি এবং ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক প্রক্রিয়াগুলো নদীজীবন থেকে চিন্তা-শরীর-চর্চা ও সংস্কৃতিতে অনেক দূরে অবস্থান করে।

তিস্তা ব্যারেজ বিতর্ক
নানান নামের ও নানান গড়নের অসংখ্য জলধারার সম্মিলিত তিস্তাতে বছরের প্রায় সময়েই কমবেশী প্রবাহ থাকে। দেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের তিস্তা প্লাবন সমভূমি কৃষিপ্রতিবেশ অঞ্চলের কৃষি ও জনজীবন এই তিস্তা স্রোতধারার উপরই বেঁচেবর্তে আছে। দেশের মোট শস্যভূমির ১৪ ভাগ এই তিস্তা প্লাবন কৃষি প্রতিবেশ অঞ্চলের অন্তর্গত, যেখানে দেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় ৮.৫ ভাগ মানুষের বসতি। ভারত ও বাংলাদেশ উভয় রাষ্ট্রই উন্নয়নের নাম করে মূলত: কর্পোরেট বাণিজ্য মুনাফা লুটতেই দুই দেশের তিস্তাবাসীকে অগ্রাহ্য ও জলধারাকে রক্তাক্ত করে নদীর সারা শরীর জুড়ে বাঁধ ও ব্যারেজ তৈরি করেছে। যেহেতু তিস্তা ভারত থেকে উৎপন্ন হয়ে এসেছে তাই উজানের রাষ্ট্র হিসেবে ভারত অপরাপর নদীর মত তিস্তার পানিও প্রত্যাহার ও শাসন করছে তার ইচ্ছেমত। শুষ্ক মওসুমে ভারত ধরে রাখছে পানি আর বর্ষাতে ছেড়ে দিচ্ছে। পানির অভাবে তিস্তা অববাহিকা শীতকালে আরও পানিশূন্য খরাগ্রস্থ এবং বর্ষাতে বন্যায় তলিয়ে যাচ্ছে। অভিন্ন তিস্তা নদীর পানি নিয়ে ভারতের এই অন্যায় অবিচার বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলকে আরও মঙ্গা-দুর্যোগের দিকে ঠেলে দিচ্ছে, পাশাপাশি নদী-প্রতিবেশও হয়ে পড়ছে ছিন্নভিন্ন।

আমন, বোরো ও আউশ ধানের এই তিনটি ঋতুর কথা বললেও রাষ্ট্রের মনোযোগ ঘিরে থাকে সর্বদা প্রশ্নহীন তথাকথিত সবুজ বিপ্লবের ধাক্কা। মূলত শুষ্ক মওসুমে কর্পোরেট কোম্পানির রাসায়নিক সার-বিষ-হাইব্রিড-উফশী বীজের বাণিজ্য টিকিয়ে রাখবার জন্য তিস্তা ব্যারেজকে কৃষি উন্নয়নের নাম করে ব্যবহার করে বোরো মওসুমের উফশী চাষে। ভারত ও বাংলাদেশ উভয়ই উন্নয়নের নাম করে মূলত কর্পোরেট বাণিজ্য মুনাফা লুটতেই দুই দেশের তিস্তাবাসীকে অগ্রাহ্য ও জলধারাকে রক্তাক্ত করে নদীর সারা শরীর জুড়ে ব্যারেজের পর ব্যারেজ তৈরি করেছে। যেহেতু তিস্তা ভারত থেকে উৎপন্ন হয়ে এসেছে তাই উজানের রাষ্ট্র হিসেবে ভারত অপরাপর অভিন্ন নদীর মত তিস্তার পানিও প্রত্যাহার ও শাসন করছে তার ইচ্ছেমত। শুষ্ক মওসুমে ভারত ধরে রাখছে পানি আর বর্ষাতে ছেড়ে দিচ্ছে। পানির অভাবে তিস্তা অববাহিকা শীতকালে আরও পানিশূন্য খরাগ্রস্থ এবং বর্ষাতে বন্যায় তলিয়ে যাচ্ছে। অভিন্ন তিস্তা নদীর পানি নিয়ে ভারতের এই অন্যায় অবিচার বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলকে আরও মঙ্গা-দূর্যোগের দিকে ঠেলে দিচ্ছে, পাশাপাশি নদী-প্রতিবেশও হয়ে পড়ছে ছিন্নভিন্ন।

বাংলাদেশের বোরো মওসুম মূলত এখন শস্য ফসলের জন্য নয়, টিকে আছে বহুজাতিক কৃষি বিষ কোম্পানির বাজার চাঙ্গা রাখার জন্য। ভারত কি বাংলাদেশ এসব কোম্পানিকে ছাড়া চলতে পারে না বলেই, বোরো মওসুমে এইসব কোম্পানির সার-বিষ আর বীজ বিক্রির বৈধতা ও মাত্রাতিরিক্ত সুযোগ করে দেয় রাষ্ট্র। খাদ্য নিরাপত্তার মিথ্যা সাফাই প্রমাণের জন্য এ বোরো মওসুমেই আরো ব্যাপক চাষাবাদের জন্যই ব্যাপক জলসেচ প্রয়োজন হয়। মাটির তলার জল সব টেনে তোলা হয়ে গেছে বলে এখন নদীর শেষ রক্তবিন্দুটুকুও দরকার। তাই তিস্তা নদীর পানিকে বোরো মওসুমে সেচকাজে ব্যবহারের জন্য উভয় দেশের এই রাষ্ট্রীয় উন্মাদনা।

মো. রিয়াজ আক্তার মল্লিক ও অন্যান্যরা তিস্তা নদীর সেচের পানির অথনৈতিক মূল্যায়ন শীর্ষক এক সমীক্ষায় জানিয়েছেন, বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশসূহের সেচের পানির অর্থনৈতিক বিশ্লেষণ খুব জরুরি। পানিপ্রবাহের উপর যেহেতু সেচসুবিধা নির্ভর করে তাই তিস্তার মতো কোনো অভিন্ন নদীর পানি দিয়ে সেচব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে উভয়অংশে পানিপ্রবাহের মাত্রা সঠিক রাখা জরুরি। তা না হলে এক অংশে সেচখরচ অনেক বেড়ে যায়, বিশেষত তিস্তার ভাটি বাংলাদেশের উত্তরবঙ্গের তিস্তা অববাহিকার গ্রামগুলোতে। মো. ফকরুল ইসলাম ও ওয়ারদাতুল আকমাম ডালিয়ার তিস্তা সেচ প্রকল্প এলাকায় উক্ত প্রকল্পের ফলে পরিবর্তিত সামাজিক-অর্থনৈতিক ও পরিবেশীক পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে দেখান, তিস্তার অবিচ্ছিন্ন এবং বাধাগ্রস্ত পানিপ্রবাহ গ্রামীণ সামাজিক, অর্থনৈতিক ও পরিবেশ পরিস্থিতিকে প্রভাবিত করছে১৫

তিস্তা নদীর উজানে ১৯৮৫ সনে ভারতের গাজলডোবাতে ব্যারেজ এবং ভাটিতে বাংলাদেশের ডালিয়া-দোআনি ১৯৯০ সনে তিস্তা ব্যারেজ নির্মিত হয়। তিস্তার উপর উজান ও ভাটিতে নির্মিত এ দুটি ব্যারেজই হলো তিস্তার পানি মাপামাপির উজান-ভাটির রেখাবিন্দু। বাংলাদেশের লালমিনরহাটের ডালিয়ায় নির্মিত তিস্তা ব্যারেজ সেচ প্রকল্প নিয়ে রাষ্ট্রীয় ওয়েবসাইট ‘বাংলাদেশ জাতীয় তথ্য বাতায়নে’ বলা হয়েছে, উত্তর জনপদের বৃহত্তর রংপুর, দিনাজপুর ও বগুড়া জেলার অনাবাদী জমিতে সেচ সুবিধা প্রদানের মাধ্যমে বাড়তি ফসল উৎপাদনের লক্ষ্যে ১৯৩৭ সনে তৎকালীন সরকার তিস্তা ব্যারেজ প্রকল্পের পরিকল্পনা গ্রহণ করে। মূল পরিকল্পনা গৃহীত হয় ভাষা আন্দোলনের পরের বছর ১৯৫৩ সনে। ১৯৫৭ সনে প্রকল্পের কাজ শুরুর উদ্যোগ নেয়া হলেও নানান জটিলতায় তা সম্ভব হয়নি। পরবর্তীতে ১৯৭৯ সালে লালমনিরহাট ও নীলফামারীর সীমান্তে তিস্তানদীর উপর ৪৪টি রেডিয়াল গেট সংবলিত ৬১৫ মিটার দীর্ঘ ব্যারেজ নির্মাণ কাজ শুরু হয়। নির্মাণ কাজ শেষ হয় ১৯৯০ সনে। ১৯৯০ সনের ৫ আগষ্ট এর উদ্বোধন করেন তৎকালীন রাষ্ট্রপধান এইচ এম এরশাদ। বাই পাস ক্যানেলের উপর নির্মিত গেটসহ এ ব্যারেজের মোট গেট ৫২টি১৬ । উক্ত ব্যারেজটি ১১০টি ক্যানেল হেড রেগুলেটর, ৭০৮ কি.মি. সেচ খাল, ৩৮০ কি.মি. সেচ নালা ও ৮০ কি.মি বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধসহ গঠিত। তিস্তা ব্যারেজ প্রকল্পের সেচ আওতায় ৭,৪৯,০০০ হেক্টর কৃষিজমি আছে। দুটি পর্যায়ে এই ব্যারেজের কাজ শুরু হয়। তিস্তা ব্যারেজের কাজ যা ১৯৯০ সনে উদ্বোধন করা হয় তা আবারো ১৯৯৩ সনে সংস্কার করা হয় এবং ১৯৯৮ সনে এর প্রথম পর্যায় সমাপ্ত হয়। প্রথম পর্যায়ে নির্মিত হয় ৩০৭ কি.মি মূল সেচ খাল, ১৪৫০ কি.মি. দ্বিতীয় আবর্তের খাল ও ২৭৩৫ কি.মি তৃতীয় আবর্তের খাল ও ৮০০০ টি ফিল্ড আউটলেট। প্রথম পর্যায়ে উক্ত প্রকল্প ১১১৪০৬ হেক্টর জমিকে বর্ষাকালে সহসেচসুবিধার জন্য প্রকল্পের আওতায় নিয়ে আসে।

আন্তঃরাষ্ট্রিক ৫৭টি অভিন্ন নদীর ভেতর গঙ্গা ও তিস্তার উজানে পানিপ্রবাহে বাঁধাদান ও পানি প্রত্যাহারকে বিশ্লেষণ করে রওনক আফরোজ ও মো. আতাউর রহমান তাদের এক গবেষণায় দেখিয়েছেন, তিস্তা ও গঙ্গার মতো অভিন্ন নদীর পানি প্রত্যাহার করে আন্তজার্তিক আইনী ধারাকে বারবার অবজ্ঞা করে চলেছে উজানের রাষ্ট্র ভারত। ১৯৭০ থেকে ২০১১ সন পর্যন্ত গঙ্গার পানি প্রবাহকে বোঝার জন্য বাংলাদেশের হার্ডিঞ্জ সেতু ও তিস্তার জন্য ডালিয়া অঞ্চলের পানি প্রবাহ তথ্য তারা বিশ্লেষণ করেন। তিস্তার পানিপ্রবাহের তথ্যবিশ্লেষণ করে তারা দেখান, ১৯৯০ সনে তিস্তা নদীর উজানে গজলডোবাতে ব্যারেজ নির্মাণের পর তিস্তার ভাটিতে মানে বাংলাদেশে তিস্তার পানিপ্রবাহ প্রায় ৮৮ ভাগ হ্রাস পেয়েছে। অপরদিকে ১৯৯০ সনে বাংলাদেশে তিস্তাব্যারেজ নির্মাণের পর পানিপ্রবাহ মাত্র আড়াইবার বৃদ্ধি পেয়েছে১৭

রিয়াজ মল্লিক ও অন্যান্যরা (২০১০) বাংলাদেশের লালমনিরহাটের ডালিয়ায় নির্মিত তিস্তা সেচ প্রকল্পের ব্যারেজ থেকে ৭০ কি.মি. ভাটিতে রংপুরের কাউনিয়ায় তিস্তার পানি পানিপ্রবাহ বিশ্লেষণ করে এক গবেষণায় দেখান, ভাটিতে তিস্তার পানিপ্রবাহ শুষ্কমওসুমে খুব কম থাকার ফলে এর পরিবেশগত বৈশিষ্ট্যও বদলে যাচ্ছে১৮ । তিস্তার পানি নিয়ে উজান-ভাটির রাজনৈতিক দেনদরবার থামছে না। ভারতের পানিসম্পদ সচিব উমেশ নারায়ণ পানজির তিস্তা বিষয়ে তাঁর এক মন্তব্যে বলেন, বাংলাদেশ বর্তমানে তিস্তার সকল পানিই ব্যবহার করতে পারছে, কিন্তু তিস্তা ব্যারেজের কাজ সম্পূর্ণ হলে ভারতও সেই পানি ব্যবহার করবে১৯ ।  

তিস্তাকে ব্রহ্মপুত্রের এক জলপ্রবাহ হিসেবে উল্লেখ করে আন্তঃরাষ্ট্রিক নদীসমূহের পরিবেশগত সুরক্ষা বিষয়ক এক সমীক্ষায় রাশেদ আল তিতুমীর ও অন্যান্যরা জানিয়েছেন, তিস্তার মতো অভিন্ন নদীতে ভারত ও বাংলাদেশ উভয়েই মূলত সেচ সুবিধার জন্য নানান ব্যারেজ তৈরি করেছে। কিন্তু এসব ব্যারেজ নির্মাণের ঘটনায় তিস্তার পানিপ্রবাহের উপর পরিবেশগত প্রভাবের কোনো চিন্তা করা হয়নি। তাই তিস্তার ভাটি বাংলাদেশে শুষ্ক মওসুমে পানি প্রবাহ মারাত্মক হারে কমে গেছে২০
………………………………………………
১৫ Md. Fakrul Islam and Wardatul Akmam (2007). Changes in Socio-economic and Environmental Situations in the Dalia Irrigation Project Area During 2000-2007: Policy Recommendations. Journal of Bangladesh Studies, 9(1), 32-38.

১৬   বাংলাদেশ জাতীয় তথ্য বাতায়ন, লামনিরহাট জেলা-তিস্তা ব্যারেজ প্রকল্প: http://www.lalmonirhat.gov.bd/node/93534

১৭ Rounak Afroz and Md. Ataur Rahman. 2013, Transboundary River Water for Ganges and Teesta Rivers in Bangladesh: An Assessment, Global Science and Technology Journal, Vol. 1. No. 1.July 2013 Issue. Pp.100-111

১৮ Reaz A. Mullick, Mukand S. Babel and Sylvain R. Perret. 2010, Flow characteristics and environmental flow requirements for the Teesta River, Bangladesh, Proc. of International Conference on Environmental Aspects of Bangladesh (ICEAB10), Japan

১৯The Hindu.[Online].India, Bangladesh to discuss Teesta water-sharing. 17 March, 2010. Accessed on August 2010. Available: http://www.thehindu.com/news/national/article253918.ece

২০ Rashed Al Mahmud Titumir, Mohammed Abdul Baten and Faiz Ahmed Chowdhury, 2012, Environmental Security in Relation to Trans-boundary Water Regime: A SituationAnalysis of GBM Basin (draft for discussion), Unnayan Onneshan, Dhaka, p. 9





লেখক: গবেষক, প্রতিবেশ ও প্রাণবৈচিত্র্য সংরক্ষণ।
animistbangla@gmail.com

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।