ঢাকা, রবিবার, ১৪ পৌষ ১৪৩১, ২৯ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৬ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

মুক্তমত

বেকারত্ব থেকে উদ্যোক্তা

‘আমরা চাকরি প্রার্থী নই, চাকরি দাতা’

মুহাম্মদ ইউনূস | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৭৩১ ঘণ্টা, জুন ৯, ২০১৪
‘আমরা চাকরি প্রার্থী নই, চাকরি দাতা’ ড: মুহাম্মদ ইউনূস

চট্টগ্রামের জোবরা গ্রামে ১৯৭৬ সালে একটি ছোট্ট উদ্যোগ নিয়ে গ্রামীণ ব্যাংক এর যাত্রা শুরু হয়েছিল। ১৯৮৩ সালে এটি একটি ব্যাংক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে।

বর্তমানে গ্রামীণ ব্যাংকের ৮৫ লাখ ঋণ গ্রহীতা রয়েছে। শুরু থেকে আমরা যে দু’টি বিষয়ের ওপর গুরুত্ব আরোপ করে এসেছি, তা হলো ১) ঋণ গ্রহীতাদের মধ্যে সাপ্তাহিক সঞ্চয় করার অভ্যাস গড়ে তোলা এবং তারা যেন এ অভ্যাস কোন প্রকারেই পরিত্যাগ না করে সে ব্যাপারে উৎসাহিত করা, এবং ২) ঋণ গ্রহীতাদের  সন্তানদরে  স্কুলে পাঠাতে উৎসাহিত করা। আমরা ঋণ গ্রহীতাদের পরিবারের দ্বিতীয় প্রজন্মের দিকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব প্রদান করেছিলাম।

গ্রামীণ ব্যাংকের যাত্রার শুরুতইে আমরা আমাদের ঋণ গ্রহীতাদের উৎসাহিত করেছিলাম যাতে তাদের সাপ্তাহিক সভার স্থানটিকে, অর্থাৎ যে চালাটির নীচে তারা প্রতি সপ্তাহে সাপ্তাহিক সভার উদ্দেশ্যে একত্রিত হয়, সে স্থানটিকেই তারা যেন তাদের      সন্তানদরে স্কুল হিসেবে ব্যবহার করেন। গ্রামের একজন মহিলাকে স্বল্প বেতনে (৫০০ টাকা) এই কেন্দ্র স্কুলে অক্ষর ও সংখ্যা জ্ঞান দেয়ার  জন্য শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দেওয়ার নিয়ম করে দেওয়া হয়েছিল। গ্রামের ওই সকল পরিবারের সদস্যদের মধ্যে স্কুলে পড়াশোনা সম্পর্কে কোন ধারণাই ছিল না। গ্রামীণ ব্যাংকের এই নতুন ধারার স্কুল ওদের সন্তানদের জন্য ছিল লেখাপড়া জগতের প্রথম অভিজ্ঞতা।

স্কুলে যাওয়ার ভয়কে অতিক্রম করে প্রতিদিন সবার সঙ্গে মজা করা বাচ্চাদের কাছে আকর্ষনীয় বিষয়ে পরিণত হলো। সদস্যরা প্রত্যেকে নিজ নিজ সন্তানকে স্কুলে পাঠাবে, এই শপথটিকে আমরা ঋণগ্রহীতাদের মূল অঙ্গীকারনামার সনদে অর্ন্তভূক্ত করেছিলাম। এই সনদটি ‘ষোল সিদ্ধান্ত ’ নামে সবার কাছে পরিচিত হয়ে পড়েছিল। এই সনদটি তৈরি করার জন্য আমরা সপ্তাহের পর সপ্তাহ, বছরের পর বছর গ্রামীণ ব্যাংকের সকল ঋণ গ্রহীতাদের সঙ্গে তাদের সাপ্তাহিক সভাতে এবং বিশেষভাবে আয়োজিত কর্মশালাতে গভীরভাবে আলোচনা চালিয়েছি।

গ্রামীণ পরিবার গুলোর সকল সন্তানের স্কুলে যাওয়াকে নিশ্চিত করার জন্য আমরা সদস্যদের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টির চেষ্টা চালিয়ে গেছি। যে সময়ে গ্রামের দরিদ্র পরিবারগুলোর অধিকাংশ শিশুই স্কুলে যেত না, সেরকম সময়ে এ ধরনের একটি সদ্ধিান্ত বাস্তবায়ন করা ছিল দুঃসাহসিক কাজ। গ্রামীণ ব্যাংক প্রত্যেক শিশুকে স্কুলে যেতে উৎসাহিত করেছে। যারা স্কুলে ভালো রেজাল্ট করতো তাদের জন্য বৃত্তি দেওয়ার ব্যবস্থা করেছিল। আমাদের প্রচেষ্টা সফল হয়েছিল।

আমরা সকল শিশুর স্কুলে যাওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করতে পেরেছিলাম। তাদের প্রাথমিক শিক্ষা শেষ হলে আমরা তাদেরকে হাই স্কুলে যেতে উৎসাহিত করেছি। তাদের অধিকাংশই আমাদের কথা শুনেছে। উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায় শেষ হলে আমরা তাদেরকে ডিগ্রি কলেজে যেতে উৎসাহিত করেছি। কিন্তু এ পর্যায়ে এসে অতিরিক্ত খরচ বহনের সমস্যা দেখা দেয়। আমরা তারও একটা সমাধান খুঁজে বের করি। গ্রামীণ ব্যাংক উচ্চ শিক্ষা নিশ্চিত করতে দরিদ্র শিক্ষার্থীর জন্য ‘শিক্ষা ঋণ’ এর ব্যবস্থা করলো।

নবীন উদ্যোক্তা

সেই সময় থেকে হাজার হাজার শিক্ষার্থী ডাক্তার, প্রকৌশলী, স্নাতক বা পেশাজীবী হওয়ার উদ্দেশ্যে গ্রামীণ ব্যাংক থেকে শিক্ষা ঋণ গ্রহণ করেছে। কিন্তু সমস্যা হল, তাদের অধিকাংশের জন্য দেশে কোন চাকরি ছিল না। তাদেরকে হতাশা থেকে মুক্ত করার জন্য আমরা আর একটা কাজ হাতে নিলাম। আমরা তাদের মনটাকে চাকরি খোঁজার দিক থেকে ঘুরিয়ে নিয়ে নিজেকে উদ্যোক্তা হিসেবে চন্তিা করার দিকে জোর দিলাম। তাদেরকে বিশ্বাস করতে আহবান জানালাম যে ঃ “আমরা চাকুরী প্রার্থী নই, আমরা চাকুরীদাতা”। আমরা তাদেরকে চাকুরীর সন্ধানে না ঘুরে, গ্রামীণ ব্যাংকের ঋণ সুবিধা গ্রহণ করে ব্যবসা শুরু করার জন্য উৎসাহিত করতে থাকি। উদ্যোক্তা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করার জন্য যারা গ্রামীণ ব্যাংকের ঋণ গ্রহণ করেছিল, আমরা তাদেরকে ‘নবীন উদ্যোক্তা’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছিলাম।

কিন্তু এই উদ্যোগটির কাজ তেমন গতি পায়নি। কারণ, যেখানে শিক্ষার্থীদের আগের নেওয়া শিক্ষা ঋণ পরিশোধ করার ব্যবস্থা হয়নি, সেখানে অভিভাবকরা তাদের ছেলে বা মেয়েদের নতুন করে ব্যবসার জন্য ঋণ নিতে উৎসাহিত করেননি। তাছাড়া ব্যাংক কর্মকর্তারাও নতুন করে তাদের ঋণ দিতে স্বস্তি বোধ করছিলেন না। ফলে নবীন উদ্যোক্তা সৃষ্টির কাজ কোন গতি পায়নি।

ডিজাইন ল্যাব

সামাজিক ব্যবসা সৃষ্টির কাজে নিয়োজিত আছি অনেক দিন থেকে। ২০১৩ সালের মধ্যে বিভিন্ন আলোচনাসভা, লেখালেখি ও সাক্ষাৎকারের মাধ্যমে সামাজিক ব্যবসার ধারণাটির সঙ্গে মানুষ পরিচিত হয়ে উঠেছে। নিয়মিতভাবে সামাজিক ব্যবসা সৃষ্টির জন্য ইউনূস সেন্টারের মাধ্যমে ‘ডিজাইন ল্যাব’ শুরু  করলাম ২০১৩ সালের জানুয়ারি থেকে। উদ্যোগটির প্রতি উৎসাহ দেখে আমরা প্রতি মাসে ডিজাইন ল্যাব আয়োজনের সিদ্ধান্ত নেই। যেহেতু ডিজাইন ল্যাবে উপস্থাপিত নতুন নতুন ব্যবসায়িক পরিকল্পনা মানুষকে আকর্ষণ করছিল, তখন ভাবলাম নবীন উদ্যোক্তা সৃষ্টি করার জন্য একটি নতুন ভঙ্গীতে কাজ শুরু করলে কেমন হয়। এবার ঋণ থেকে বের হয়ে এসে বিনিয়োগে চলে যাবার কথা ভাবলাম।

ডিজাইন ল্যাবে নবীন উদ্যোক্তাদের বিজনেন্স প্ল্যান নিয়ে আসার ব্যবস্থা করলাম। তাতে দু’রকম কাজ হলো। প্রথমত, নতুন নতুন ব্যবসার ধারণা নিয়ে নবীনরা এগিয়ে আসতে উৎসাহিত হলো; এবং দ্বিতীয়ত, এর মাধ্যমে নিজেদেরকে সামাজিক ব্যবসার স্থায়ী কাঠামোর অর্ন্তভুক্ত হতে দেখে নবীনরা আরো পরিষ্কারভাবে একে বুঝার সুযোগ পেলো।

২০১৪ এর এপ্রিল মাসের শেষাবধি ৬৮ জন নবীন উদ্যোক্তা ডিজাইন ল্যাবে তাদের ব্যবসার পরিকল্পনা উপস্থাপন করে। তার মধ্যে ৬৪টি প্রকল্প অর্থায়নের জন্য অনুমোদিত হয়। আমার ধারণা, এই ল্যাবের মাধ্যমে ২০১৪ সালের শেষাবধি কমপক্ষে ২০০ জন নবীন উদ্যোক্তার ব্যবসায়িক পরিকল্পনা বাস্তবায়নরে জন্য বিনিয়োগের টাকা অনুমোদন পেয়ে যাবে। এর পর থেকে এর গতি ক্রমাগতভাবে বেড়েই চলবে। প্রায়োগিক কাঠামো একবার তৈরি হয়ে গেলে, সম্প্রসারণের উদ্যোগ সহজেই  গতি পাবে এটাই আশা করছি।

ঋণ থেকে অংশীদারিত্বে রূপান্তর

সামাজিক ব্যবসার মাধ্যমে নবীন উদ্যোক্তা সৃষ্টিতে ঋণের ব্যবস্থা করার চাইতে সামাজিক ব্যবসার মাধ্যমে অংশীদারিত্ব সৃষ্টি করাটাই বিশেষভাবে ফলপ্রসু হবে বলে আমার বিশ্বাস। ঋণ থেকে অংশীদারিত্বে রূপান্তরের প্রভাব হবে সুদূরপ্রসারী। এটি টেকসই ও অনুকরণীয়ভাবে যুব সম্প্রদায়ের বেকারত্ব সমস্যা সমাধানের পথে নতুন সম্ভাবনার পথ সৃষ্টি করবে। বিষয়টি খুবই সহজ, কিন্তু খুবই কার্যকরী। অধিক মুনাফা লাভের উদ্দেশ্যে বিনিয়োগ বা সরকার কর্তৃক বিশাল কোনো অবকাঠামোগত নির্মাণ প্রকল্পে বিনিয়োগের মাধ্যমে গতানুগতিক চাকরীর ক্ষেত্র তৈরীর ধারা থেকে বের হয়ে এসে সামাজিক ব্যবসার পদ্ধতিতে বেকার ব্যক্তি নিজেই সহজ, টেকসই এবং সরাসরি ক্ষুদ্র অংশীদারিত্বের কাঠামোতে বিনিয়োগ করে বিষয়টির মোড় ঘুরিয়ে দেবে। এখানে সরাসরি যেকোন একজন নির্দিষ্ট বেকার ব্যক্তির সমস্যার সমাধান করা যায়। যার সমস্যা তাকে দিয়েই সমাধান। শুধু দরকার প্রাতিষ্ঠানিক আয়োজন। এটা মুনাফা বৃদ্ধির  উদ্দেশ্যে উৎপাদিত কোন অনিশ্চিৎ পণ্য নয়।  

সামাজিক ব্যবসায় একজন বিনিয়োগকারী উদ্যোক্তার মাধ্যমে নতুন ব্যবসা সৃষ্টি করে তার সমস্যার সমাধান করে দেয়। নবীন উদ্যোক্তাদের ক্ষেত্রে বিনিয়োগকারী তরুণদরে বেকারত্ব সমস্যার সমাধান করে। (বলার অপেক্ষা রাখে না যে, এটা যে কোন বয়সের মানুষের বেকারত্ব সমাধানে কাজে লাগতে পারে, তা যুবকদের হোক বা বয়স্কদেরই হোক। ) সামাজিক ব্যবসায় বিনিয়োগকারী তার বিনিয়োগকৃত অর্থ তুলে আনা ব্যতীত তা থেকে কোন লভ্যাংশ গ্রহণ করে না।

কাজেই একজন নবীন উদ্যোক্তা তার বিনিয়োগকারী থেকে যে অর্থ গ্রহণ করেছিল তা ফেরৎ দিতে পারলে নিজেই ব্যবসার মালিক হয়ে যেতে পারে। এটি যে কোন উদ্যোক্তার জন্য একটি চমকপ্রদ সুযোগ। কল্পনা করুন, একজন তরুণ উদ্যোক্তার জন্য এ বিষয়টি কতটা আকর্ষণীয়। সে তার নতুন ব্যবসার জগতে প্রথমবারের মত প্রবেশ করতে যাচ্ছে, আর নিজের কোন টাকা বিনিয়োগ না করেই ব্যবসার মালিক হয়ে যেতে পারছে। এর পরেও তার জন্য আরো সুখবর আছে।

বিনিয়োগকারী ও উদ্যোক্তার মধ্যে সম্পর্ক

ব্যবসায় উদ্যোক্তার অংশীদারিত্ব থাকতে পারে আবার নাও থাকতে পারে। বিনিয়োগকারীর মালিকানাধীন ব্যবসায় উদ্যোক্তা একজন বেতনভূক ব্যবস্থাপকের ভূমিকা পালন করে মাত্র। বিনিয়োগকারী তার ব্যবসার দৈনন্দিন কাজের সঙ্গে সম্পৃক্ত হবে না। ব্যবসায়ে লাভ হলে বিনিয়োগকারী তার লভ্যাংশ গ্রহণ করবে। বিনিয়োগকৃত অর্থের সমান লভ্যাংশ গ্রহণ করার পর বিনিয়োগকারী আর কোন লভ্যাংশ গ্রহণ করবে না।   যে অর্থ সে ফেরৎ পেয়েছে তা আবার নতুন কোন সামাজিক ব্যবসায়ে বিনিয়োগ করবে।

কিন্তু তার উদ্দেশ্য ততক্ষণ র্পযন্ত অর্জিত হবে না, যতক্ষণ র্পযন্ত না সে উদ্যোক্তাকে একজন মালিক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে পারে। কারণ তার উদ্দেশ্যই ছিল একজন চাকরি প্রার্থীকে একজন চাকরিদাতায় পরিণত করা। যদি তার উদ্দেশ্য থাকতো নিছকই একজন বেকারের জন্য চাকরির ব্যবস্থা করা, তবে তার উদ্দেশ্য কাজের সূচনাতেই অর্জিত হয়ে যেতো। এমনকি যদি সে ব্যবসার মালিকানা না-ও ছাড়ে তবু তার ব্যবসা সফল সামাজিক ব্যবসা হিসেবে গণ্য হবে। কিন্তু নবীন উদ্যোক্তাদের ব্যাপারে বিনিয়োগকারীর উদ্দেশ্য বেকারদের জন্য নিছক চাকরির ব্যবস্থা করার চাইতেও আরো বড় ছিল। উদ্দেশ্য ছিল, একজন চাকরি প্রার্থীকে, একজন চাকরি দাতায় পরিণত করা। একজন উদ্যোক্তার সৃষ্টি করা। এ লক্ষ্য সে বাস্তবায়ন করে তার শেয়ার উদ্যোক্তার নিকট বিক্রির মাধ্যমে।

প্রশ্ন হলো, বিনিয়োগকারী তার শেয়ার বিক্রির সময় কী মূল্যে বিক্রি করবে? সে শুধুমাত্র তার শেয়ারের বুক ভেল্যু বা হিসাব মত মূল্য বা বাজার মূল্য চাওয়ার অধিকার রাখে। এক্ষেত্রে উভয় মূল্যই ফেসভ্যালুর চাইতে বেশি থাকবে, কারণ তার ব্যবসাটি একটি সফল ব্যবসা। এরইমধ্যে মূলধনের সম-পরিমাণ অর্থ সে অর্জন করে ফেলেছে। সামাজিক ব্যবসার নিয়ম অনুযায়ী, বিনিয়োগকারী তার শেয়ার বাজার মূল্যে বিক্রি করতে পারে। কিন্তু সে তার ফেসভ্যালুর বাইরে যে অর্থ পাবে, তাকে পুনরায় তা অন্য কোন সামাজিক ব্যবসায়ে বা একাধিক ব্যবসায়ে বিনিয়োগ করতে হবে। সে তার নিজের বিনিয়োগকৃত অর্থের ওপর অর্জন করা বাড়তি মূল্য ব্যক্তিগতভাবে ভোগ করতে পারবে না।

আমরা আমাদের নবীন উদ্যোক্তা প্রোগ্রামে একটা সহজ নিয়ম করেছি। নবীন উদ্যোক্তা কর্মসূচির ব্যাপারে আমরা প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগের কথা মাথায় রেখে নিয়মটি চালু করেছি। আলোচনার সুবিধার জন্য আমরা এই প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীকে ‘ফান্ড’ নামে অভিহিত করবো। ব্যবসায় শেয়ার বিক্রির ক্ষেত্রে, (বিনিয়োগকারী) ফান্ড মূল বিনিয়োগকৃত অর্থের সমান পরিমাণ অর্থ এবং তার উপর ২০% অতিরিক্ত গ্রহণ করবে। এই বাড়তি অর্থকে আমরা ‘শেয়ার ট্রান্সফার ফি’ নাম দিয়েছি। নবীন উদ্যোক্তারা এ ব্যবস্থাটিকে আকর্ষণীয় মনে করেছে।

কারণ, প্রথমত তারা এ শেয়ারটি কিনতে পারছে ফেসভ্যালুতে, তাদেরকে বুক ভেল্যুতে কিনতে হচ্ছে না। দ্বিতীয়ত, মূল ইকুইটির ওপর নির্ধারিত ২০% একটি স্থির পরিমাণ। অর্থাৎ কত দিন পরে ইক্যুইটি ফেরৎ দিলো তার উপর এর পরিমাণ বাড়ে কমে না। উদাহরণ স্বরূপ, একজন উদ্যোক্তা তার বিনিয়োগকৃত অর্থের সম-পরিমাণ অর্থাৎ ধরুন, ১ লক্ষ টাকা বিনিয়োগের বিপরীতে ১.০ লক্ষ টাকা মুনাফা হিসেবে শেয়ারমালিককে দেয়ার পরেও শেয়ারের মালিক হবার জন্য তাকে আরো ২০ হাজার টাকা অতিরিক্ত ফি হিসেবে দিতে হবে।

কত বছর ধরে মুনাফা দিয়ে যাচ্ছে তার হিসাব এখানে কোন প্রভাব ফেলবে না। কিন্তু নবীন উদ্যোক্তা যদি বিনিয়োগ (ইকুইটি) হিসেবে ১ লক্ষ টাকা নেয়ার পরিবর্তে কোন ব্যাংক থেকে ১ লক্ষ টাকা ঋণ হিসেবে নিতো, তবে উদ্যোক্তার ওপর সুদের বোঝা প্রতি দিন বাড়তে থাকতো। তার ১.০ লাখ টাকা পরবর্তী কয়েক বছরে সুদে আসলে দ্বিগুণ, তিনগুণ হয়ে যেতে পারতো।

নবীন উদ্যোক্তা কর্মসূচিতে ‘শেয়ার ট্রান্সফার ফি’ ধার্যের ব্যাপারে দু’ধরনের যৌক্তিকতা আছে।

এক, সামাজিক ব্যবসায় শেয়ার বদল হয় মার্কেট ভেল্যুতে। আমরা নবীন উদ্যোক্তা কর্মসূচির জন্য এটা নির্দিষ্ট করে দিয়েছি যে এটা ফেসভ্যালুতে হস্তান্তর হবে। দুই. নবীন উদ্যোক্তা কর্মসূচিতে ফান্ড নিষ্ক্রিয় ভূমিকায় থাকে না, খুবই সক্রিয় ভূমিকা পালন করে। সে উদ্যোক্তার জন্য প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করে, উদ্যোক্তার কর্মকাণ্ডকে সরাসরিভাবে তদারক করে, নানারকম সহায়তা সেবা প্রদান করে, ব্যবসায়িক ঝুঁকি গ্রহণ করে, নানারকম ভাবে তাকে সাহায্য করে, জরুরি অবস্থায় ফান্ড নিজে দায়দায়িত্ব নেয়, উদ্যোক্তাকে দক্ষ করে তৈরি করার জন্য ফান্ড কার্যকর ভূমিকা পালন করে। কয়েক বছর ধরে এ সকল সেবা দেবার জন্য সর্বসাকুল্যে মাত্র ২০% অতিরিক্ত দেওয়া খুবই যুক্তিসম্মত হিসেবে সবাই গ্রহণ করবে।

 ২০১৩ সালের সেপ্টেম্বর মাসের মধ্যে আমরা নবীন উদ্যোক্তা কর্মসূচীর মৌলিক নিয়মনীতিগুলি চূড়ান্ত করে ফেলেছি। এ সময়ের মধ্যে আমরা মূল পদ্ধতি নির্ধারণের সঙ্গে সঙ্গে রিপোর্টিং এর ফরমাটগুলি তৈরি করছি, উদ্যোক্তা নির্বাচন প্রক্রিয়া স্থির করে নিয়েছি। প্রাথমিকভাবে গ্রামীণ টেলিকম ট্রাস্ট ছিল এর ফান্ড বা বিনিয়োগকারী। তারা অভিজ্ঞতা সম্পন্ন কর্মকর্তাদের মাধ্যমে প্রকল্প বাছাই করে। এরপর নবীন উদ্যোক্তার প্রকল্পগুলি ডিজাইন ল্যাবে উপস্থাপনের জন্য উদ্যোক্তাদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করে। সাধারণত ডিজাইন ল্যাবে ১৫০ জন আলোচনাকারী উপস্থিত থাকে। তাছাড়া এ প্রোগ্রামে ইন্টারনেটের মাধ্যমে সরাসরি অংশগ্রহণ করা যায়। ৭০ থেকে ৮০ টি দেশের অংশগ্রহণকারী সরাসরি নেটের মাধ্যমে ডিজাইন ল্যাবে যোগ দেয়। উপস্থিত অংশগ্রহণকারীরা প্রশ্ন করে, প্রকল্পের উন্নয়নের জন্য ফান্ডকে পরামর্শ প্রদান করে, অথবা প্রকল্প তৈরির সময়ে যে সব বিষয় বিবেচনায় আসেনি তা তুলে ধরে। বর্তমানে, এক বছর পরে, প্রকল্প মূল্যায়নের পদ্ধতি অনেক বেশি শাণিত হয়েছে। অনেকগুলো গ্রামীণ কোম্পানি (গ্রামীণ টেলিকম ট্রাস্ট, গ্রামীণ কল্যাণ, গ্রামীণ ট্রাস্ট, গ্রামীণ ব্যবসা বিকাশ, গ্রামীণ শক্তি) এতে সম্পৃক্ত হয়ে তাদের নিজস্ব প্রোগ্রাম  হিসেবে একে গড়ে তুলছে। ফলে প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য একটি সাধারণ বা কমন সুযোগ সুবিধা গড়ে তোলার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। যেমন, কমন কমপিউটার ভিত্তিক এম আই এস এবং হিসাবরক্ষণ সফ্টওয়্যার, কমন প্রশিক্ষণ সুবিধাদি ইত্যাদির ব্যবস্থা করা হচ্ছে। উদ্যেক্তাকে ব্যবসা ব্যবস্থাপনায় প্রশিক্ষণ, প্রযুক্তিগত প্রশিক্ষণ, হিসাব রক্ষণে প্রশিক্ষণ অন্যান্য অনেক প্রাসঙ্গিক বিষয়ে দক্ষ করে তোলার জন্য নানারকম পদক্ষেপ নেওয়া সহজ হয়েছে।

প্রকল্প মূল্যায়ন এবং বাস্তবায়ন

বিনিয়োগকারী বা ফান্ড এ জন্য গ্রাম পর্যায়ে লোক নিয়োগ করছে। এ কর্মীরা স্থানীয়ভাবে সবার সঙ্গে সরাসরি আলাপ আলোচনা করে নবীন উদ্যেক্তাকে  প্রকল্প তৈরির কাজে উদ্বুদ্ধ করবে। গ্রাম পর্যায়ের কর্মীরাই প্রকল্প তৈরীর কঠিন কাজটি দক্ষতার সঙ্গে করার জন্য উদ্যোক্তাকে তৈরি করবে। ধাপে ধাপে ব্যবসার পরিকল্পনাটি ডিজাইন ল্যাবের মাধ্যমে অনুমোদন করার পর্যায়ে নিয়ে যাবে। উদ্যোক্তার বাড়িতে গিয়ে, তার নিজের ও পরিবারের সকলের তথ্য জেনে, তার স্বপ্ন ও ভীতিকে অনুধাবন করে, তার মধ্যে আত্মবিশ্বাস গড়ে তোলার মধ্যে দিয়ে সম্পূর্ণ প্রক্রিয়াটি অগ্রসর হয়।

৪ বা ৫ জন সম্ভাব্য উদ্যোক্তার মধ্যে পারস্পরিক আলোচনার মাধ্যমে উদ্যোক্তারা একে  অপরকে জানার সুযোগ পায়। এর পর আরো বেশী সংখ্যক উদ্যোক্তাদের নিয়ে (৩০ থেকে ৫০ জন) ওরিয়েন্টেশন ও বাছাইকরণের উদ্দেশ্যে পরিচিতি ক্যাম্প এর আয়োজন করা হয়। অভিজ্ঞতা সম্পন্ন ক্যাম্প পরিচালকরা এই ক্যাম্প পরিচালনা করে। তাদের মূল লক্ষ্য হলো নবীন উদ্যোক্তাদের মনে আত্মবিশ্বাস জাগিয়ে তোলা; তাদের মনের কথাগুলো ষ্পষ্টভাবে বলার ব্যাপারে সাহায্য করা, কাগজে লিখে মনের কথা প্রকাশ করার অভ্যেস করানো, ব্যবসার সকল দিক বিবেচনা করানোতে অভ্যস্ত করা, ইত্যাদি।

অংশগ্রহণকারীরা প্রক্রিয়া ও নিয়ম কানুন জানার জন্য এবং তাদের দায়-দায়িত্ব সন্বন্ধে একটি স্পষ্ট চিত্র পাওয়ার জন্য নানারকম প্রশ্ন করবে। তারা একে অপরের ব্যবসায়ের পরিকল্পনা ও ব্যবসা পরিচালনার কর্মসূচিকে যাচাই করবে। ক্যাম্প প্রধান তাদেরকে নানারকম ব্যবসাভিত্তিক গেমস খেলতে দিয়ে তাদের ব্যবসায়িক সমস্যা সমাধানের ক্ষমতা যাচাই করার সুযোগ নেবে।

উদ্যোক্তাকে চেনা-জানা প্রক্রিয়ার শেষ পর্যায়ে অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে যাদেরকে ক্যাম্প প্রধানের দৃষ্টিতে অগ্রগামী বলে মনে হবে তিনি তাদের একটি তালিকা তৈরি করবেন। যাদের নাম তালিকায় স্থান পাবে না তাদেরকে জানিয়ে দেয়া হবে যে তাদেরকে পরবর্তী ক্যাম্পে ডাকা হবে। তারা নিজেদেরকে পরবর্তী ক্যাম্পে ভালো ফলাফল করার জন্য প্রস্তুতি নিতে থাকবে।

বাছাইকৃতদের তালিকায় যারা স্থান পাবে তাদেরকে একটি কর্মশালায় ডাকা হবে। এবার প্রত্যেকে নিজ নিজ প্রকল্পকে সুন্দর করে গড়ে তোলার কাজে  হাত দেবে। এই কর্মশালা থেকে যোগ্যতার ভিত্তিতে উদ্যোক্তাদেরকে চূড়ান্ত  বাছাই করা হবে। এরপরে চূড়ান্ত সিদ্ধান্তের জন্য তাদের ঢাকায় ডাকা হবে। ঢাকায় এসে তারা ফান্ডের প্রশিক্ষিত কর্মীদের সহযোগিতায় ডিজাইন ল্যাবে প্রকল্প উপস্থাপনার জন্য প্রকল্প তৈরি করবে এবং উপস্থাপনার জন্য প্রস্তুতি নেবে। প্রকল্পটি ডিজাইন ল্যাবে উপস্থাপনের জন্য তাকে ৫ মিনিটের মধ্যে মূল বক্তব্য তুলে ধরার প্রস্তুতি নিতে হয়। সাধারণত, প্রস্তুতিমূলক দীর্ঘ প্রক্রিয়ার পরে ডিজাইন ল্যাবটি তার জন্য কঠিন পরীক্ষা বলে মনে হয় না। বরং সবার প্রশ্নের জবাব দিতে তার কাছে আনন্দের কাজ বলেই মনে হয়।

ডিজাইন ল্যাবে বড় কোন দুর্বলতা ধরা না-পড়লে প্রকল্পটি বিনিয়োগের জন্য অনুমোদিত হয়ে যায়। দুর্বলতা চিহ্নিত হলে উদ্যোক্তাকে পরবর্তী ল্যাবে প্রকল্পটি উপস্থাপনের জন্য আহ্বান জানানো হয়।

একবার প্রকল্প পাশ হয়ে গেলে তা বাস্তবায়নের জন্য হাতে কলমে কাজ শুরু হয়। ফান্ড এবং উদ্যোক্তা এবার একটি যৌথ টিম হিসেবে প্রকল্পকে সফল করার কাজে নেমে পড়ে। হাতে পুঁজি পাবার পর নবীন উদ্যোক্তা এবার দৃঢ় পদক্ষেপে এগিয়ে যায়।  

ব্যবসার প্রতিদিনের এম আই এস ও একাউন্টিং তথ্য সংগ্রহ করার জন্য গ্রামীণ সফ্টওয়্যার কোম্পানি, ‘গ্রামীণ কমিউনিকেশন’ একটি একাউন্টিং এবং মনিটরিং সফ্টওয়্যার তৈরি করেছে। উদ্যোক্তারা প্রত্যেক দিনের তথ্য টেলিফোনে টেক্সট মেসেজের মাধ্যমে কেন্দ্রীয় সার্ভারে পাঠিয়ে দেয়। ফান্ড তার ভিত্তিতে দৈনিক সাপ্তাহিক,মাসিক সকল তথ্যের বশ্লিষেণমূলক প্রতিবেদন পায়।

সামাজিক ব্যবসার গ্রাম:

নবীন উদ্যোক্তা কর্মসূচির পরবর্তী ধাপ হবে একে আরো গভীরে নিয়ে যাওয়া, এবং তার চাইতে বড় কাজ হবে একে ঘিরে একটি প্রাতিষ্ঠানিক আয়োজন গড়ে তোলা। এই উদ্যেশ্যে পরবর্তী ধাপ হিসেবে ‘‘সামাজিক ব্যবসার গ্রাম’’ গড়ে তোলার উদ্যোগ নিয়েছি। একটি গ্রাম নিজেদের উদ্যোগ নিয়ে নিজেদের সমস্যা সমাধানে এগিয়ে যাবে এটাই হবে তার দর্শন। এই লক্ষ অর্জনের স্ট্র্যাটেজি হবে সামাজিক ব্যবসা ভিত্তিক ব্যাপক উদ্যোগ গড়ে তোলা।

গ্রামের আয়তনকে বড় আকারে পাওয়ার জন্য  একেকটি ইউনিয়নকে একটি বৃহত্তর গ্রাম হিসেবে ধরা হয়েছে। এই বৃহত্তর গ্রামকেই আমরা ‘‘সামাজিক ব্যবসার গ্রাম’’ হিসেবে ধরবো। এই গ্রামের মৌলিক সমস্যাগুলি সামাজিক ব্যবসার মাধ্যমে সমাধানের উদ্যোগ নেয়া হবে। এই উদ্যোগের কেন্দ্রস্থলে থাকবে ‘‘সামাজিক ব্যবসা ফান্ড’’। এই ফান্ড বিভিন্ন সামাজিক ব্যবসায় বিনিয়োগ করবে। শুরু করবে নবীন  উদ্যোক্তাদেরকে কেন্দ্র করে। এটা সফল হতে থাকলে এই উদ্যোগকে সকল বয়সের বেকারদের উদ্দেশ্যে সম্প্রসারিত করা হবে। ক্রমে ক্রমে অন্যান্য সমস্যা সামাধানের জন্য সামাজিক ব্যবসার উদ্যোগ সৃষ্টি করা হবে ফান্ড থেকে বিনিয়োগের মাধ্যমে। শিক্ষা, শিল্প, স্বাস্থ্য, প্রযুক্তি, পরিবেশ, গৃহ নির্মাণ, কৃষি বাজারজাতকরণ ইত্যাদির সমস্যা সমাধানে সামাজিক ব্যবসা এগিয়ে আসবে।

ফান্ডের সহায়ক শক্তি হিসেবে আরো একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা হবে। সেটা হবে সামাজিক ব্যবসা ইনকিউবেশান প্রতিষ্ঠান। তার কাজ হবে নানাক্ষেত্রে সামাজিক ব্যবসার উদ্যোগ সৃষ্টি করার জন্য সকল রকম সহায়ক কর্মসূচী গ্রহণ করা। দেশের ও বিদেশের অন্যান্য জায়গায় কী কী ধরণের সামাজিক ব্যবসা চালু হয়েছে সেটা স্থানীয় উদ্যোক্তাদের কাছে তুলে ধরা, তাদের নিয়ে কর্মশালা করা। যেরকম ভাবে নবীন উদ্যোক্তা সৃষ্টির জন্য ক্যাম্প করার আয়োজন করা হচ্ছে  সেরকম অন্য সকল উদ্যোক্তার ক্ষেত্রে চালু করা, উদ্যোক্তাদের আত্মবিশ্বাস বাড়ানোর জন্য ও দক্ষতা অর্জনের জন্য কর্মসূচি গ্রহণ করা, যৌথভাবে সামাজিক ব্যবসা সৃষ্টির জন্য গ্রামের বাইরের কোম্পানীর সঙ্গেঁ যোগাযোগ স্থাপন করিয়ে দেওয়া, ইত্যাদি।

গ্রামের লোক যারা গ্রামের বাইরে বসবাস করে, এমন কি দেশের বাইরে কাজ করে তাদেরকে গ্রামের সামাজিক ব্যবসায় বিনিয়োগের জন্য উৎসাহিত করা। গ্রামের মানুষ কাজ উপলক্ষে যে যেখানেই থাকুক না কেন সব সময় তার মধ্যে একটা বাসনা সুপ্ত থাকে আমি আমার গ্রামের জন্য কিছু করতে চাই, আমি আমার সেই ছোটবেলার প্রথম স্কুলটার জন্য কিছু করতে চাই, ইত্যাদি। ইনকিউবেশান কোম্পানির কাজ হবে এদের সঙ্গেঁ যোগাযোগ করে গ্রামের সামাজিক ব্যবসা ফান্ডে আরো তহবিল বাড়ানোর জন্য স্থায়ী ব্যবস্থা করা, ইত্যাদি।

বাংলাদেশের প্রত্যেক ইউনিয়নের জন্য এরকম সামাজিক ব্যবসা তহবিল গঠণ করা যায়। যে সব ইউনিয়ন সামাজিক ব্যবসার গ্রাম প্রতিষ্ঠায় আগ্রহী হবেন তাঁদেরকে আমাদের সঙ্গেঁ যোগাযোগ করার জন্য আহবান জানাচ্ছি। এই ফান্ড পরিচালনার জন্য আমরা চুক্তিদ্ধ হতে প্রস্তুত আছি। এরকম তিনটি ইউনিয়নে সামাজিক ব্যবসা ফান্ড গঠণ করার জন্য ইউনিয়নের পক্ষ থেকে যত টাকার তহবিল সংগ্রহ করে তহবিলে জমা দেবে গ্রামীণ টেলিকম ট্রাস্টে সমপরিমাণ অর্থ-ঐ তহবিলে জমা দেবার জন্য প্রস্তুত থাকবে। এই তহবিলের ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে থাকবে গ্রামীণ টেলিকম ট্রাস্ট।

আগ্রহী সকল ইউনিয়নের মধ্য থেকে বাছাই করে গ্রামীণ টেলিকম ট্রাস্ট তিনটি ইউনিয়ন বাছাই করে নেবে যেখানে তারা সংগৃহীত অর্থের সমপরিমাণ অর্থ নিজেরা বিনিয়োগ করবে। টাকা সংগ্রহে উৎসাহ দেবার জন্য গ্রামীণ টেলিকম ট্রাস্টের পক্ষ থেকে সম পরিমাণ অর্থ বিনিয়োগের আকর্ষনীয় প্রস্তাবটি দিয়ে রাখলাম। এর মাধ্যমে যৌথ বিনিয়োগে সামাজিক ব্যবসার গ্রাম প্রতিষ্ঠার একটা আনন্দময় অভিজ্ঞতা পাওয়া যাবে।

বহু পুরানো সমস্যার নতুন সমাধান:

গ্রামীণ ব্যাংকের প্রাথমিক বছরগুলিতে যখন গরীব মহিলাদের আমি বিনা জামানতে ঋণ দেওয়া শুরু করলাম তখন বহু অর্থনীতিবিদ জোর গলায় বলেছিলেন যে এটা চলবে না। ঋণের ব্যবহার করতে পারে একমাত্র এমন ধরণের মানুষ যাদের মধ্যে উদ্যোক্তা হবার ক্ষমতা আছে। গরীবদের মধ্যে সাধারণভাবে এই ক্ষমতা নেই। গুটি কয়েক গরীব মানুষের মধ্যে হয়তো এইগুণ থাকতে পারে। কিন্তু তারা সংখ্যায় নেহাৎ নগণ্য। গরীব, তার উপর আবার মহিলা, তারা উদ্যোক্তা হবার গুণ পাবে কোথেকে? আমার কাজকে কেন্দ্র করে দেশে বিদেশে এই বির্তক চলতেই থাকলো। আমিও পাল্টা অবস্থান নিলাম।

আমি বললাম, দুনিয়ার সকল মানুষই উদ্যোক্তাগুণ সম্পন্ন। উদ্যোক্তা হবার গুণ নেই এমন মানুষ দুনিয়ায় নেই। কেউ কেউ নিজের জীবনে এই শক্তির সন্ধান পাবার সুযোগ পায়, আর বেশীর ভাগ মানুষকে এই ক্ষমতা সন্বন্ধে জানতে দেয়া হয় না। যেমন, গরীব মানুষদের। গরীব মেয়ে মানুষ হলে ত কথাই নেই। তাদেরকে বুঝানো হয় তোমাদের জন্ম হয়েছে অন্যের হুকুম তামিল করার জন্য। হুকুম দেওয়ার ক্ষমতা তোমাদের নেই। হাজার হাজার বছর ধরে একথা শুনতে শুনতে তারাও বিশ্বাস করে এসেছে যে কথাটা সত্যি। আমি গরীব, ও গরীব মহিলাদের এই ভুল বিশ্বাস ভাঙার কাজে নামলাম। ক্ষুদ্র ঋণ হলো সেই হাতুড়ি, যেটা পিটিয়ে আমি এই বিশ্বাস ভেঙে দিয়ে চলেছি।

সামাজিক ব্যবসা এসেছে এবার দ্বিতীয় পর্যায়ের আরো শক্তিশালী হাতুড়ি হিসেবে। এবার সবাইকে বিশ্বাস করতে বলছি যে ‘আমি চাকরি প্রার্থী নই, আমি চাকরিদাতা’। শুধু মুখে বল্লে হবে না কাজে প্রমাণ করে দেখাতে হবে।

সামাজিক ব্যবসার মাধ্যমে ব্যবসায় বিনিয়োগকারী এবং শরীক হিসেবে এগিয়ে এসে যেকোন মানুষকে তার উদোক্তা হবার ক্ষমতা আবিষ্কার করার সুযোগ করে দেয়াই হলো এই দ্বিতীয় পর্বের কাজ। বেকারত্ব পৃথিবীর আদি সমস্যা। যে পুঁজিবাদের অলৌকিক ক্ষমতা নিয়ে আমরা প্রশংসায় পঞ্চমুখ সে পুঁজিবাদ যে এইসমস্যার সমাধান দিতে চরমভাবে ব্যর্থ হয়েছে সেটা বর্তমান ইউরোপের দিকে তাকালেই পরিস্কার বুঝা যায়।

আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি বেকারত্ববিহীন পৃথিবীর স্বপ্ন দেখা এখন কল্পনাবিলাস বলে মনে করার কোন কারণ নেই। তরুণ, যুবক, বৃদ্ধ, পুরুষ, নারী, শিক্ষিত, অশিক্ষিত, ধনী, দরিদ্র  যেকোন মানুষ সফল উদ্যোক্তা হবার ক্ষমতা রাখে। প্রত্যেক মানুষের আছে মৌলিক সৃষ্টিশীলতা। এই সৃষ্টিশীলতাকে কেন্দ্র করেই বেকারত্ববিহীন পৃথিবী গড়ার স্বপ্ন বাস্তবে  রূপান্তর হবে।

বেকারত্বের চরম হতাশা, বিষন্নতা, এবং মানবতার অবমাননা থেকে মানুষ অবশেষে মুক্ত হবে। সেদিন ‘বেকার’ শব্দটির আর কোন প্রয়োগ থাকবে না। তখন মানুষ বুঝতে অক্ষম হবে বেকারত্ব মানে কী, এটা কোন ধরণের পরিস্থিতি। কেন একজন মানুষ বাধ্য হবে নিজের সৃজনশীলতার বর্ণিল প্রকাশকে অবরুদ্ধ রাখতে?

যেদিন বেকারত্ব বলে কিছু থাকবে না সেদিন মানুষের নব জন্ম লাভ হবে। নতুন আশা, নতুন সীমাহীন সম্ভবনার জগতে প্রবেশ করবে মানুষ। এই নতুন মানুষকে ঘিরে নতুন অর্থনীতির  জন্ম হবে। প্রত্যেক মানুষের সৃষ্টিশীলতার প্রকাশ দ্রুতলয়ে ক্রমাগতভাবে বাড়তে থাকবে। নিজের জীবন ধারণের জন্য রাষ্ট্রের ওপর  নির্ভরশীলতা থেকে মানুষ নিজেকে মুক্ত করে নিজের কৃতিত্বে নিজেকে গৌরবান্বিত বোধ করবে।

সামাজিক ব্যবসা আমাদেরকে এই সম্ভাবনার জগতে প্রবেশ করার অধিকার দিলো। সাহস দিলো। নবীন উদ্যোক্তা কর্মসূচি এবং সামাজিক ব্যবসার গ্রাম রচনা করে আমরা এর দ্বার উন্মোচন করতে চাই।

বাংলাদেশ সময়: ১৭২৬ ঘণ্টা, জুন ০৯, ২০১৪

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।