ঢাকা, শনিবার, ১৩ পৌষ ১৪৩১, ২৮ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৫ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

মুক্তমত

চলে গেলেন প্রিয় মাসুদ ভাই

নাজমুল আলম কিরণ | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৬১১ ঘণ্টা, জুলাই ২৮, ২০১৪
চলে গেলেন প্রিয় মাসুদ ভাই

আমার ভাল লাগার খুব প্রিয় এক মানুষ ছিলেন তিনি, ছিলেন প্রিয় ক্রিকেটার। ১৯৭৮ সালে পাবনা থাকার সময় থেকেই তার সাথে পরিচয়।

ক্রিকেট লীগ খেলার কারণেই যেন সখ্যতা গড়ে উঠে বেশী। খুব স্নেহ করতেন আমাকে। বাবার চাকরির সূত্রে পাবনা থেকে চলে যাওয়া হয় চট্রগ্রামে। তবে যোগাযোগ থেমে থাকেনি। চিঠিতে যোগাযোগ রাখতাম। তিনিও রিপ্লাই দিতেন। মনে পরে, ১৯৭৯ সালে যখন আইসিসি খেলতে ইংল্যান্ড গিয়েছিলেন তখন হোটেলে বসেই চিঠি লিখে পোস্ট করেছিলেন আমাকে। দেশে ফেরার সময় গিফটও নিয়ে এসেছিলেন। কথাবার্তায় চলনে-বলনে যেমন ছিলেন স্মার্ট ও স্টাইলিশ তেমনি ছিলেন অতি বিনয়ী-শান্ত ভদ্র-অমায়িক হাসিখুশি মুডের সদা হাস্যোজ্জল। ছিলেন প্রচারবিমুখ। ছোট-বড় করে কাউকে আলাদা করে দেখা হত না তার। সবাইকেই সম্মান করে চলতেন। দেখা হতেই আমার আগেই সালাম দিয়ে দিতেন তিনি। শ্রদ্ধায় মাতা নত হয়ে আসত। তার মতো ভাল মনের মানুষ আমাদের ক্রীড়াঙ্গনে কমই আছে বলা যায়। বলছিলাম সত্তর-আশি দশকের মাঠ কাঁপানো ও এক সময়ের জাতীয় দলের দেশ সেরা পেস বোলার দীর্ঘকায় জিয়াউল ইসলাম মাসুদ ভাইয়ের কথা।

সেই প্রিয় ক্রিকেটার মাসুদ ভাই ২৭ জুলাই রোববার দুপুরে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করে আমাদের ছেড়ে চিরবিদায় নিয়েছেন (ইন্না লিল্লাহে…রাজেউন)। ৬৫ বছরের মাথায় মাসুদভাই চলে গেলেন না ফেরার জগতে। হঠাৎ করে মাসুদ ভাইয়ের চলে যাওয়াটা সত্যি কষ্টের। তবে স্মৃতির মণিকোঠায় থাকবেন জাগ্রত তা বলতেই হয়। মাসুদ ভাই কাঁদিয়ে যেন চলে গেলেন। নিজেকে বড্ড অপরাধী মনে হচ্ছে। চিরবিদায় নেওয়ার পর তাকে নিয়ে আমার সাইডে লিখতে বসেছি বলে ক্ষমা করবেন মাসুদ ভাই। দোয়া করি আল্লাহ আপনাকে শান্তিতে রাখুক, বেহেস্থ নসিব করুক, আমিন...

কদিন আগের একটি ঘটনা এখানে না তুলে পারছি না। গিয়েছিলাম আমাদের ক্রিকেটের আরেক প্রিয় মুখ অনেকেরই ভাললাগার এই মানুষটির বাসায়। পুরানো দিনের ক্রিকেট স্মৃতির পাতা উল্টাতে গিয়ে চলে আসে সেই ১৯৭৯-তে বাংলাদেশ যখন প্রথমবারের মতো আইসিসি খেলতে যায় ইংল্যন্ডে সেই স্মৃতির কথা। বলছিলেন, তখন আমি ছাত্র, ও সময়টায় হাত খরচ ছিলো খুবই সীমিত, আমার থাকা হত লন্ডনে আর বাংলাদেশ দলের খেলা হত বামিংহামে। যা ছিলো অনেক দূরের পথ। তবে বাংলাদেশ দলের খেলা দেখার সুযোগ হাতছাড়া করব ভাবতেও পারিনি। অনেক কষ্ট করেই যেন ট্রেন-বাস-পাঁয়ে হেঁটে দূর পথে ছুটে যেতাম খেলা দেখার জন্য। একদিন বাংলাদেশ দলের এক খেলোয়াড় আড়ালে ডেকে নিয়ে বল্লেন, আপনি এত কষ্ট করে দূর থেকে আসা-যাওয়া করে কেন খেলা দেখবেন! এক কাজ করুন, আমার হোটেল রুমেই থেকে যান। অবাক হলাম তার কথা শুনে। বল্লাম, ব্যাপারটা কি ঠিক হবে? বল্লেন, কিছুই হবে না, কেউ জানবে না, থাকেন খুশি হব। ভাবতেও পারিনি মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে এগিয়ে এসে সহানুভুতি দেখিয়ে তিনি এভাবে আমার জন্য এমন একটা কাজ করবেন। মুগ্ধ না হয়ে পারলাম না তার সহানুভুতি প্রকাশে।

অতঃপর ছেলেমানুষি অচেতন মনে ভাল-মন্দ না বুঝেই কেন জানি রাজিও হয়ে গেলাম মাসুদ ভাইয়ের বিশেষ অনুরোধে। তবে রাত্রে যখন ঘুমাতে যাব তখন আরো বিস্মিত হলাম। অবাকই হলাম, ভাবতেই পারিনি তিনি এমন উদার মনোভাবের ও বড় মনের পরিচয় দেবেন। দেখি উনি হোটেল রুমের ফ্লোরে শুয়ে আমাকে বল্লেন, বেডে ঘুমাতে। আমি তো আকাশ থেকে পড়লাম। এ কি করে সম্ভব! এতটা ভাল মনের মানুষ দেখে আমি আবেগে আপ্লুত হয়ে পড়ি, এমনটা কল্পনাতেও ছিলো না।

পাঠক বড় মনের সেই ভাল মানুষটি আর কেউ নয় আমার অনেক প্রিয় মাসুদ ভাই। ওদিকে সেদিনের সেই ছাত্রটি যাকে মাসুদ ভাই আন্তরিকভাবেই হেলপ করেছিলেন তিনি হলেন এ মহূর্তের ক্রিকেট বোর্ড পরিচালক আমাদের সবার প্রিয় ববি ভাই। কথা প্রসঙ্গে ববি ভাই আরো উল্লেখ করলেন, মারা যাবার আগ পর্যন্ত মাসুদ ভাই ক্রিকেট বোর্ডে কর্মরত ছিলেন। সেই সূত্রে যখন-তখন যেখানে-সেখানে স্যার সম্বোধন করেই কথা বলতেন। ব্যাপারটা মোটেও ভাল লাগার মতো ছিলো না। শত অনুরোধ করেও বদলানো যায়নি। এই হলো প্রিয় মাসুদ ভাই।

খেলায় শুধু নয়, আচরণেও মাসুদ ভাই ছিলেন সবার অতি প্রিয় মানুষ আর আপনজন। বলতে হয়, পরিচিত জন সবার মনের গভীরেই ঠাঁই করে নেন মাসুদ ভাই। মাসুদ ভাই আজ আমাদের মাঝে নেই তবে থাকবেন অন্তর জুড়ে তা না বল্লেই নয়।

মাসুদ ভাইয়ের জন্ম রাজশাহীতে। পড়াশোনার পাঠ চুকিয়ে ওখানেই বড় হয়ে হয়েছেন। তার ক্রিকেট হাতে খড়ি পাবনাতেই। রাধানগর পল্যানপুর ক্লাবেই শুরু লীগ খেলা। সত্তর দশকের শুরুতে যোগ দেন ঢাকা লীগের ওয়ান্ডার্রাস ক্লাবে। সেই শুরু উত্থানের। তবে বলতে হয়, আজাদ বয়েজ ক্লাবে যোগ দিয়েই ক্রমান্বয়ে ভাল খেলে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করে বাংলাদেশ দলেও সুযোগ করে নেন। বলব নিজ যোগ্যতার গুনেই মাসুদ ভাই নিজেকে অনেক উপরে তুলে ধরেন। ও সময়টায় এমসিসি-হায়দ্রাবাদ ব্লুজ দলের বিরুদ্ধে তিন দিনের বেসরকারি টেস্টসহ একদিনের ম্যাচ খেলে সুনাম কুড়ান। অতঃপর ইংল্যান্ডে অনুষ্ঠিত ১৯৭৯ এর আইসিসি ট্রফিতে প্রথমবারের মতো জাতীয় দলের ব্লেজার গায়ে জড়ান। খেলেছেন হংকং এ অনুষ্ঠিত সাউথ ইস্ট এশিয়া কাপেও। লীগ জীবনের শেষের ক মরসুম খেলেছেন মোহামেডানের হয়ে।

মাসুদ ভাই ছিলেন দলের সূচনাকারী দ্রুতগতির পেস বোলার। তার বোলিং স্টাইলটাই ছিলো যেন একটু ভিন্ন ধাচের। ওপেন চেস্টে বল ছুঁড়তেন। সে সময় ম্যাটিং উইকেটে মাসুদ ভাইয়ের দ্রুতগতির বলগুলো যেন ব্যাটসম্যানদের রীতিমত কাঁপুনি ধরাতো। এতে করে প্রতি ম্যাচেই তার ঝুলিতে জমা পড়ত একাধিক উইকেট।

মাসুদ ভাইকে একজন ফাস্ট বোলার হিসেবেই জানেন অনেকেই। বোলার হিসেবেই খ্যাত ছিলেন তিনি। তবে ব্যাটিংটাও ভাল করতেন। মনে পড়ে, ১৯৭৯ মওসুমে ইংল্যান্ডের এমসিসি দল খেলতে এসেছিলো বাংলাদেশে। নিজের পরিচিত মাঠ রাজশাহীতে তিন দিনের ম্যাচে প্রথম ইনিংসে দলের চরম বিপর্যয়ের মুখে সর্বোচ্চ ৩৩ রান তুলে দলের বিপদই কাটাননি, খেলা ড্র করতে মূখ্য ভূমিকা রেখেছিলেন। পরের ম্যাচে চট্রগ্রামেও ব্যাট হাতে জ্বলে উঠেছিলেন মাসুদ ভাই। মূল্যবান দুই উইকেট নেওয়ার পাশাপাশি ৩০ রান তুলে নেন। এর বাইরে ঢাকা লীগে মাসুদ ভাইয়ের সেঞ্চুরি হাঁকানোর কথা অনেকেরই অজানা। ১৯৭৮ মওসুমে ওয়ান্ডারার্সের হয়ে উদিতির বিরুদ্ধে অপরাজিত শতরান হাঁকিয়েছিলেন মাসুদ ভাই।

লেখক: ক্রীড়া লেখক ও প্রাক্তন ক্রিকেটার

বাংলাদেশ সময়: ০৬১০ ঘণ্টা, জুলাই ২৮, ২০১৪

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।