ঢাকা, শনিবার, ১৩ পৌষ ১৪৩১, ২৮ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৫ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

মুক্তমত

আমেরিকায় ভুতের বাড়ি... ।। আদনান সৈয়দ

... | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১২৫৯ ঘণ্টা, আগস্ট ১২, ২০১৪
আমেরিকায় ভুতের বাড়ি... ।। আদনান সৈয়দ ছবি: সংগৃহীত

বসন্ত যায় যায়। মনটাও উড়ো উড়ো! ভাবছিলাম এভাবেই কি তাহলে বসন্তের দিনগুলো খরচ হয়ে যাবে? আমার এই ভাবনা-চিন্তার মাঝেই ফ্লোরিডা থেকে জরুরি ফোন কল।

আমেরিকান বন্ধু রয় জানালো একটা ফাটাফাটি প্রজেক্ট হাতে নিয়েছে আর এধরনের প্রজেক্ট আমাকে ছাড়া হাত দেওয়া রীতিমত গর্হিত কাজ। শুনে মনটা চাঙ্গা হয়ে গেল। এখানে রয় সম্পর্কে দুচার কথা না বললেই নয়। রয় আমাদের নিউইয়র্কে বিশ্ববিদ্যালয় পড়াকালীন বন্ধু। চেহারায় পোশাকে একদম সাদা চামড়ার কিন্তু স্বভাবে-চলাফেরায় খাঁটি বাঙালি। রয় বর্তমানে ফ্লোরিডাবাসী হলেও আমাদের বন্ধুত্ব টিকে আছে পিরিতের আঠার মতই।

যা ভেবেছিলাম তাই। ফোন করার সাথে সাথেই রয় তার চিকন গলায় যা জানালো তা হল ফ্লোরিডায় ওয়েস্ট পাম্পবিচ থেকে এক’শ মাইল দূরে লেক মিয়াকায় একটা ভুতুড়ে বাড়ির সন্ধান পাওয়া গেছে। স্থানীয় ভাষায় যাকে বলে, ‘স্পুকি হাউস’। বাড়িটিতে বছর দুয়েক আগে আগুন লেগে চার শিশুসহ অনেকেই আগুনে পুড়ে মারা যায়। আশেপাশের স্থানীয় অনেক ভাগ্যবানেরই নাকি ছোট ছোট শিশুদের প্রেতাত্মা দেখার সৌভাগ্য হয়েছে। গভীর রাতে এই শিশুরা নাকি আর্তচিৎকার করে আর বাড়িটির চারপাশ দিয়ে ঘুরে বেড়ায়। শুনেই, আত্মারাম খাঁচাছাড়া আর কি! কিন্তু ভুত দেখার এরকম সুবর্ণ সুযোগটাই বা হারাই কোন বুদ্ধিতে! সেই ছেলেবেলা থেকেই ভুত দেখার কতই না বায়না ছিল। যাক শেষ কালে এই আমেরিকায়া এসে স্বপ্ন বুঝি পূরণ হতে চলল! মনে মনে রয়কে কোটি কোটি ধন্যবাদ দিয়ে অফিস থেকে আগাম দুদিনের ছুটি নিয়ে এক শুক্রবার ফ্লোরিডার উদ্দেশ্যে পা বাড়াই। আহারে! কল্পনায় দেখছিলাম ছোট ছোট শিশু প্রেতাত্মারা কি সহজ সরলভাবেই না হাত ধরে ধরে বাড়িটার চারপাশে চক্কর খাচ্ছে আর নানা রকম যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে।

নিউইয়র্ক থেকে ফ্লোরিডা আকাশে ঘণ্টা তিনেকের পথ। ফোর্টলোডেল বিমান বন্দরে বত্রিশ দাঁত বের করে রয় আর তার বউ সিনথিয়া আমাকে অভ্যর্থনা জানাল। পাশেই দেখি আমার আরেক পুরনো দোস্ত বাবু আমাকে দেখে মিটিমিট করে হাসছে। আমি তো খুশিতে আটখানা! এতো দেখি মেঘ না চাইতেই বৃষ্টি! জানতাম বাবু মায়ামি থাকে কিন্তু মায়ামি থেকে যে ও ওয়েস্ট পাম্পবিচ চলে আসবে তা আমার ধারণাই ছিল না। যাইহোক রাতে খাবারের পর রয়কে ঘিরে আমি বাবু আর সিনথিয়া ওদের এন্টিক টাইপের বৈঠক খানায় বসলাম। রয় আমাদের পুরো কাজ বুঝিয়ে দিল। বরাবরের মত এবারও রয়ই আমাদের দল নেতা। সিনথিয়া আগেই জানিয়ে দিল যে, সে আমাদের এসব ‘পাগলামো’তে নেই। আমরা মনে মনে খুশিই হলাম। তিন দোস্ত একসাথে অনেক পাগলামো করা যাবে! বাবুর কাজ হল গাড়ি চালানো। ও রাস্তাঘাঁট বেশ ভালো চিনে আর আমি রয়কে চোখ বুজে অনরণ করব। ভুত দেখার জন্য আমাদের দিন ধার্য হল শনিবার রাত বারোটা অর্থাৎ লেক মিয়াকায় আমরা পৌঁছে যাব রাত দুইটার দিকে। সময়টা ভুত দেখার জন্য একটা উপযুক্ত সময়।

যাত্রা হল শুরু...
বাবুর উত্তেজনাটা একটু বেশিই মনে হল। সেই আধ ঘণ্টা আগে থেকেই গাড়ি স্টার্ট দিয়ে আমাদের ডাকাডাকি করে চলছে। রয় একটা ছোট ছুরি, একটা টর্চ, কিছু দড়ি আর কিছু বিড়ির প্যাকেট সাথে নিয়ে নিল। আমি শুধু আড় চোখে দেখে আড়ালেই একটু হেসে নিলাম। ভুত দেখার সাথে ছুরির কি প্রয়োজন হতে পারে বুঝলাম না! তবে গাড়িতে রয় বিষয়টা পরিষ্কার করল। ফ্লোরিডায় বনে-জঙ্গলের বিভিন্ন জলাশয়ে কুমিরের আখড়া। বিভিন্ন জলাশয়ের পাশেই কুমিরের ছবিসহ সতর্কিকরণ চিহ্ন দেখা যায়, ‘আই এম হেয়ার’। যাক তাও ভালো একটা ছুরি থাকলে কুমিরের সাথে যুদ্ধ করা যাবে বৈকি? লেক মিয়াকায় যখন পৌঁছলাম তখন চারদিকে থমথমে অন্ধকার। জোনাকি পোকাগুলো ইতিউতি উড়ছে। চাঁদের আলোয় লেক মিয়াকাকে আলতো করে চোখ দিয়ে চেটে নিলাম। ‘অই যে এই বাড়িটা’, রয় আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল। পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী বাবু ভুতুরে বাড়িটির একদম গা ঘেঁষে গাড়িটি পার্ক করে স্টার্ট বন্ধ না করে দাঁড়িয়ে থাকল। রয় ঝটপট গাড়ি থেকে নেমে পড়ল আর আমি তাকে অনুসরণ করলাম। টর্চের আলো এদিক ওদিক ফেলে রয় বাড়িটির দিকে এগুচ্ছিল। এবার আমরা দুজনেই বাড়িটার একদম সামনে। পুরনো কাঠের বাড়ি। বুঝাই যায় এখানে কারো পায়ের ধুলি পড়ে না। কাঠের দরজা আলতো করে লাগানো। রয় দরজাটায় একটু চাপ দিতেই খুলে গেল। এবার রয় ঢুকে পড়ল বাড়ির ভেতর। আমি ইতস্তত করছি ঢুকব কি ঢুকব না। রয় ঘরটার মেঝেতে পা দাওয়ার সাথে সাথেই হঠাৎ একটা লোমে কাঁটা দেওয়া শব্দ! কয়েকটা মুহূর্ত মাত্র। রয় চোখ বুজেই দৌড়। এদিকে আমি আর রয় দৌড়ে আসতে দেখে বাড়ির পাশে অপেক্ষমাণ আমাদের বুদ্ধিবান বাবু আমাদেরকে রেখেই গাড়ি নিয়ে দে ছুট। যাইহোক কিছুদূরে যেয়ে সে দয়া করে থামল আর আমরা কোনোরকমে গাড়িতে উঠেই বললাম শালা! গাড়ি চালা। গাড়ি ছুটছে ওয়েস্ট পাম্পবিচের দিকে। কারো মুখে কোনো কথা নেই। কিছুদূর যাওয়ার পর শহরের বাতি গায়ে এসে পড়তেই আমাদের সবার যেন প্রাণ ফিরে এল। এবার রয়কে ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করলাম সে কি দেখেছিল। রয় যা বলল তা অনেকটা এই রকম, ‘ঘরটিতে ঢুকার সাথেই সাথেই আমার পা পুরনো কাঠের মেঝে দেবে গেল। হঠাৎ শুনি ফিসফাস ধরনের কিসব যেন আওয়াজ। এদিকে মনে হল প্রেতাত্মাগুলো যেন আমার দিকে বড় বড় চোখে তাকিয়ে আছে। আবার একটা ঠাণ্ডা বাতাস যেন আমার চুলটাকেও আলতো করে বুলিয়ে দিল। তখন আমি আর আমাকে ধরে রাখতে পারলাম না। মনে হচ্ছিল ভয়ে আমার শরীর অবশ হয়ে যাচ্ছে। ’

ভুতের কোনো অভিজ্ঞতা না নিয়েই দুদিন পরেই নিউইয়র্ক চলে আসি। তারপরও মাঝে মাঝে ভাবি আওয়াজটা কিসের ছিল? চুলটাই বা কে ঠাণ্ডা হাওয়ায় বুলিয়ে দিল? তাহলে কেউ ছিল নিশ্চয়? কোন অশরীরী আত্মা? সেই শিশুরা নাতো! পাঠক আপনিই বলুন।

লেখক: লেখক, প্রাবন্ধিক, তথ্যপ্রযুক্তিবিদ এবং যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী

বাংলাদেশ সময়: ১২৫৬ ঘণ্টা, আগস্ট ১২, ২০১৪

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।