ঢাকা, শুক্রবার, ১২ পৌষ ১৪৩১, ২৭ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৪ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

মুক্তমত

মধ্যবর্তী নির্বাচন

মার্কিন পররাষ্ট্রনীতিতে পরিবর্তন সম্ভব?

জেমস এম লিন্ডসে | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৬৫৯ ঘণ্টা, নভেম্বর ৯, ২০১৪
মার্কিন পররাষ্ট্রনীতিতে পরিবর্তন সম্ভব?

[গেল চার নভেম্বর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে মধ্যবর্তী প্রেসিডেন্ট নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। তাতে রিপাবলিকানরা ব্যাপকভাবে বিজয়ী হয়।

এ নির্বাচনের ফলে অনেকে ধারণা করেছেন, সিনেটে রিপাবলিকানদের নিয়ন্ত্রণ বেড়ে যাওয়ায় মার্কিন পররাষ্ট্রনীতিতে পরিবর্তন আসতে পারে। কিন্তু আসলেই কি কোনো পরিবর্তন হবে?]

নির্বাচনের মাসটা নিষ্ঠুর আর ক্ষমাহীনই হয়। ৪ নভেম্বরের ভোটে যেমন মাত্র ২১টি আসন পেয়েছে ডেমোক্র্যাটরা। এর মধ্যে তারা কয়েকটি অঙ্গরাজ্য মিলিয়ে যে সাতটি আসন পেয়েছে, ২০১২ সালে রিপাবলিকান নেতা মিট রমনি একাই সেসব আসন জিতে নিয়েছিলেন। সাধারণত মধ্যবর্তী নির্বাচন কমসংখ্যক ভোটারকেই আকর্ষণ করে। যারা এ সময় ভোট দিয়ে থাকেন তাদের বেশির ভাগই হয়ে থাকে বয়ষ্করা। আর এই বয়ষ্করা ডেমোক্রেটদের জন্য খুব একটা সমর্থক বান্ধব না। যেকারণে দেখা গেছে, এই নির্বাচনে ডেমোক্র্যাটদের বারাক ওবামাকে মাত্র ৪০ শতাংশ ভোটার প্রেসিডেন্ট হিসেবে দেখতে চেয়েছে। কিন্তু সব মিলিয়ে ২০১৪ সালে অনুষ্ঠিত এ মধ্যবর্তী নির্বাচনে আপনি সন্তুষ্ট হতে পারেন। এর জন্য রয়েছে মোটাদাগে তিনটি ভাবনা যাতে মার্কিন পররাষ্ট্রনীতিসহ অভ্যন্তরীণ ইস্যু মিলিয়ে মোটামুটি সবকিছুই উঠে আসে।

এক.
রিপাবলিকানরা বড় ধরনের জয় পেয়েছে। কিন্তু এ জয় বড় নয়। ২০০৬ সালে প্রথম রিপাবলিকানরা সিনেটে বিজয়ী হয়। এরপর দীর্ঘদিন পর আবার তারা সিনেটের নিয়ন্ত্রণ ফিরিয়ে আনল। তারা এখন আইন প্রণয়নের এজেন্ডা নিয়ে কাজ করতে পারে। কিন্তু এর মানে এ নয় যে, ইতিমধ্যে আইন প্রণয়নের ফলে যেসব ঘটনা তৈরি হয়েছে সেগুলোর বিষয়েও তারা খবরদারি করার সক্ষমতা রাখে। আলাস্কা ও লুইজিয়ানায় চলমান যেসব বিষয় সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় রয়েছে সেগুলো যদি জিওপি বা সিনেটের রিপাবলিকানদের অধীনে চলে যায় সেক্ষেত্রে সিনেটে আইন প্রণয়নের জন্য রিপাবলিকানদের জন্য ৬০টি আসন জরুরি।     
অপরদিকে রিপাবলিকান নেতা ম্যাক কনিলকে মোকাবেলায় ডেমোক্র্যাটরাও একই কৌশল প্রয়োগ করতে পারে। তবে ম্যাক কনিলই এর জন্য সবচেয়ে পারফেক্ট। কারণ সে সময় ম্যাককনিল ছিলেন সংখ্যালঘু। তখন সংখ্যাগরিষ্ট নেতা হওয়ার জন্য বেশ অস্থিরতায় ভুগছিলেন তিনি। এ মুহূর্তে ক্রিটিক্যাল ইস্যুগুলোতে প্রভাব তৈরি করে ডেমোক্র্যাটদেরকে উস্কানি দিতে কঠোর পরিশ্রম করে যাবে রিপাবলিকানরা। তবে এই কৌশল বাস্তবায়ন করা রিপাবলিকানদের জন্য বেশ কঠিন হয়ে যেতে পারে।
নির্বাচনে একটা বিষয় ঘটে গেছে। মানে ভোটের দিক থেকে সিনেটের ঝুঁকিপূর্ণ এবং রাজনৈতিকভাবে মডারেট ডেমোক্র্যাটদেরকে পরিষ্কার করে তুলেছে এ নির্বাচন। একদম ছাটাই হয়ে ঝেড়েঝুড়ে সিনেটে যারা এখন আছে ডেমোক্র্যাটদের তারা বেশ উদার। এবং তারা তাদের আসনকেও বেশি নিরাপদ রাখতে পারছে। এমনকি যদি সিনেটের রিপাবলিকান কমিটি জিওপি ডেমোক্র্যাটিকদেরকে আঘাত করতে চায় তাহলেও তাদের জন্য কমপক্ষে ৬০টি ভোট লাগবে। এতে ওবামাও ভোট দিতে পারবে। যেকারণে ওবামা নিজে এবং তার ডেমোক্র্যাট সিনেটররা আইনপ্রণয়নের দিক থেকে এখনো খুব গুরুত্বপূর্ণ।
      
দুই.
রিপাবলিকানদের শরিকানা আরো মজবুত ও ঘনিভূত হবে। এরফলে সিনেটের রিপাবলিকানদের ভিতরে অভ্যন্তরীণ উত্তেজনাও থাকবে বরাবর। সেইসঙ্গে আমরা আশাব্যঞ্জক চিত্রও পেয়েছি। যাতে ওয়াশিংটনের রাস্তায় নানান দলের ভিড় ও তৎপরতাও ভেঙ্গে দিয়েছে এই মধ্যবর্তী নির্বাচন।

অবশ্য হোয়াইট হাউস ও কংগ্রেসের রিপাবলিকানরা সিদ্ধান্ত নিতে পারত যে, এ নির্বাচনের মানে হবে উভয় পক্ষের স্বার্থের দিক থেকে একটি কমন গ্রাউন্ড খুঁজে বের করা।

ট্যাক্স আইন সংস্কার, অবকাঠামো ও বাণিজ্য ইস্যুতে দুই পক্ষের মধ্যে এই সমঝোতা হতে পারতো। অবশ্য এখনো যদি সব রাজনৈতিক নেতারা এক হন তাহলে সংস্কার প্রশ্নে সমঝোতা চুক্তি হতে পারে।  

তবে এই আশাব্যাঞ্জক চিত্র আগের মতোই। যেমন ২০১২ সালের নির্বাচনে হারার পরও রিপাবলিকানরা ভিন্ন ধরনের রাজনীতি গ্রহণ করেনি। ফলে এ মধ্যবর্তী নির্বাচনে বড় ধরনের জয়ের পরও তারা হয়ত তাদের নীতির পরিবর্তন করবে না। কাজে এখন রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে ওবামা যে মূল্য দিতে চাইছে তারা এর চেয়ে বড় ধরনের রাজনৈতিক মূল্য দাবি করতে পারে। কিন্তু সিনেটের রিপাবলিকানদের মধ্যে যে অভ্যন্তরীণ বিভাজন ও মত পার্থক্য রয়েছে তাতে ডেমোক্র্যাটদের সঙ্গে আলোচনা কঠিন হয়ে যাবে। চা খাওয়া রিপাবলিকান আর প্রতিষ্ঠিত রিপাবলিকান এ দুই পক্ষের মধ্যে সরকারের আকার ও ভূমিকার মতো কিছু বেসিক ইস্যু নিয়ে মতবিরোধ হতে পারে। ইতিমধ্যে এক্সপোর্ট-ইম্পোর্ট ব্যাংক নিয়ে বিতর্ক হওয়ার পর এসব ইস্যু আরো পরিষ্কার হয়ে উঠেছে।        

কংগ্রেস ও সিনেটের রিপাবলিকানরা বিভিন্ন রাজনৈতিক সুবিধা পাওয়া নিয়ে ব্যস্ত। মানে যেটা রেড স্টেটে বিক্রি হবে সেটা ব্লু স্টেটে বিক্রি হবে না। এই হলো রিপাবলিকানদের সুবিধার হিসাব নিকাশ। আর সিনেট রিপাবলিকানরা বুঝে ফেলেছে, ২০১৪ সালের এই নির্বাচন তাদের জন্য যেমন কাজ করেছে কিন্তু ২০১৬-তে এটি তাদের বিরুদ্ধে কাজ করবে। হয়ত তখন ডেমোক্র্যাটদের শুধু একটির তুলনায় রিপাবলিকানদের থাকবে ২৪টি আসন। আর ওবামা যে সাতটি আসনে দুবার ও ‍দুটিতে একবার জিতেছিলেন সেগুলো রক্ষায় তারা মরিয়া হয়ে কাজ করবে। ডেমোক্র্যাটদের এলাকাগুলোয় জিতে আসা তাদের জন্য বেশ কঠিনই হবে। সেকারণে এ মুহূর্তে হোয়াইট হাউস ও কংগ্রেসের মতোই হোয়াইট হাউস ও সিনেটের মধ্যে আলোচনা হবে অনেক গুরুত্বপূর্ণ।   

তিন.
‘বুধবার অনুষ্ঠিত মধ্যবর্তী এ নির্বাচন প্রেসিডেন্ট ওবামার পররাষ্ট্রনীতিকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে। ’ কিন্তু এ বক্তব্যের চাইতে অনেক কমই ক্ষতিগ্রস্ত হবে ওবামার পররাষ্ট্রনীতি। ওবামার এখন খুবই কঠিন কাজ আঞ্জাম দেয়ার কথা। কারণ রিপাবলিকানরা সিনেটের নিয়ন্ত্রণ নেবে। ওবামার যারা পছন্দের তারাও প্রশাসনের নিশ্চয়তাবিধান ও কর্মকর্তাদের কঠিন কৌশলের মুখোমুখী হবেন। অনেক বিরোধী কমিটির সামনে এই কর্মকর্তারা প্রমাণ টমানও হাজির করবেন।
কিন্তু এর মানে এ না যে, যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতির প্রাথমিক অবস্থান হোয়াইট হাউস থেকে পরিবর্তন হয়ে একেবারে ক্যাপিটাল হিলে (সিনেট) চলে যাবে। কারণ পররাষ্টনীতি নির্ধারণে ব্যাপক স্বাধীন ক্ষমতা রয়েছে প্রেসিডেন্টের (ওবামার)। মানে সুনির্দিষ্ট সাংবিধানিক কর্তৃত্ব এবং উদ্যোগ নেয়ার ক্ষমতার কারণে অভ্যন্তরীণ নীতি নির্ধারণের চেয়ে পররাষ্ট্রনীতিতে প্রেসিডেন্টের ক্ষমতা অনেক বেশি। অন্যরা জাস্ট ভেটো দিতে পারেন। সর্বশেষ ১৯৮৬ সালে কংগ্রেস পররাষ্ট্রনীতিতে পরিবর্তন এনেছিল।  

যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতিতে সিনেটের নিয়ন্ত্রণ রয়েছে। এতে যে সুনির্দিষ্ট প্রভাব পড়বে সেটি বিভিন্ন ইস্যু ও পরিস্থিতির ফলে ভিন্ন হতে পারে। যখন ওবামার জন্য কংগ্রেসের দরকার আছে অাবার তাতে রিপাবলিকানদের সঙ্গে তার একজায়গায় বা সমঝোতায় আসার নীতিও আছে তাহলে তখনই অগ্রগতি সম্ভব।
সমঝোতা সম্ভব। বাণিজ্য তরান্বিতকরণ কর্তৃত্ব নিয়ে সম্ভাব্য সমঝোতা অন্যতম ইস্যু। কিন্তু ওবামার জন্য কংগ্রেসের সহযোগিতা জরুরি হলেও তার নীতি যখন সিনেটের রিপাবলিকানদের থেকে আলাদা হয়ে যায় সেক্ষেত্রে তখন ওবামা নিজেই তার কার‌্যকর ক্ষমতা প্রয়োগ করতে পারেন। যেমন অভিবাসন আইনের সংস্কার ও ইরানের সঙ্গে পরমাণু বিষয়ক সমঝোতার জন্য দেশটির উপর থেকে অবরোধ তুলে নেয়া জরুরি।   

এছাড়া আরো কিছু ইস্যু আছে, যাতে পরিবর্তন আনতে সিনেটের অল্পবিস্তর নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা রয়েছে। বিশেষ করে রিপাবলিকান ও ডেমোক্র্যাট—দুই পক্ষই এখন প্রতিরক্ষা ব্যয়ের ওপর চাপ শিথিল করার উপায় বের করে আনতে চায়। কিন্তু উপায় তারা কিভাবে বের করবে তা নিয়ে তারা একমত হতে পারছে না।

সিনেট চাচ্ছে সমুদ্র বিষয়ক আইনের মতো চুক্তিগুলোতে একমত হওয়া। কিন্তু বেশিরভাগ রিপাবলিকানই এ বিষয়ে ওবামার ব্যাপারে সন্দিহান। সেইসঙ্গে ইরাক ও সিরিয়ার ব্যাপারে যা কিছু হয়েছে সে বিষয়েও অধিকাংশ আমেরিকানরা ওবামাকে সন্দেহ করছে।

ফলে আইসিসের (ইসলামিক স্টেট ইন ইরাক এন্ড সাম) সঙ্গে ওবামা যে কৌশল নির্ধারণ করেছেন তাতে তারা যে ভুল দেখতে পেয়েছে তার সমালোচনা তারা করবেই। কিন্তু যে মধ্যবর্তী নির্বাচন হয়ে গেছে এরপরেও পররাষ্ট্রনীতিতে নতুন কোনো ধরনের আইন বা নীতির পরিবর্তন হচ্ছে না।

লেখক: কাউন্সিল অন ফরেন রিলেশন্স এর মার্কিন পররাষ্ট্রনীতি বিষয়ক বিশ্লেষক

অনুবাদক: শাহাদাৎ তৈয়ব 

বাংলাদেস সময়: ১৬৫৫ ঘন্টা, নভেম্বর ৯, ২০১৪

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।