হাজার হাজার অনলাইন সংবাদমাধ্যম এখন বাংলাদেশে। রাস্তায় সিএনজি অটোরিক্সা, রিক্সার পেছনে তাকালে সহজেই তা চোখে পড়ে।
কেউ কেউ বলেন অখ্যাত অনলাইনগুলো মূলধারার অনলাইনগুলোর নাম খারাপ করছে।
দিন কয়েক আগে একজন ব্যাংক কর্মকর্তার সঙ্গে কথা হচ্ছিলো। বেশ খেদ ঝড়িয়েই বলছিলেন, অনলাইন পত্রিকার নাম ডুবালো আন্ডার গ্রাউন্ড অনলাইনগুলো।
তার কথায় সায় দিইনি। তবে বিষ্মিত হলাম ‘আন্ডারগ্রাউন্ড’ শব্দে। বেশতো সংবাদপত্রের তকমাটি অনলাইন সংবাদমাধ্যমেও লেগে গেলো। তবে অনলাইন ভার্চুয়াল জগতে মাধ্যম। এ ক্ষেত্রে ‘আন্ডারগ্রাউন্ড’ কতটা যাবে সেটা নিয়ে আলোচনা হতে পারে।
সে দিকে না গিয়ে ব্যাংক কর্মকর্তার কাছে জানতে চাইলাম- তিনি কোন অনলাইন সংবাদমাধ্যম পড়েন। বললেন, নিয়মিত বাংলানিউজ আর বিডিনিউজই দেখা হয়।
মনে হলো যতই অনলাইন হোক সত্যিকারের পাঠক তাহলে মূলধারায় বিচরণ করতেই পছন্দ করে।
চারবছরের অনলাইন সাংবাদিকতায় কাজের পাশাপাশি কৌতুহলী চোখ ছিলো ভুঁইফোড় অনলাইনগুলোর ওপরও। এগুলো কিভাবে চলছে? কারা চালাচ্ছে? এগুলোর কাজ কি? এ নিয়ে দেখতে দেখেতে কিছু পর্যবেক্ষণও তৈরি হয়েছে। সেগুলো শেয়ার করতেই এই লেখার অবতারণা।
দেখেছি একটি কক্ষে দু-তিনটি কম্পিউটার বসিয়ে স্রেফ নিউজ কপি-পেস্ট করাই এদের কাজ। ঢাকা শহরের দেয়ালে এবং অটো রিকশার পেছনে এসব অনলাইনের বিজ্ঞাপন দেখে মনে হবে না জানি কত কীই না তারা করে! কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে অনেকেরই ঠিকানায় গিয়ে অফিস পাওয়া যাবে না। কারো বাসাই তাদের অফিস। আর কারো যদি অফিস থাকেও তা আসলে ছোট্ট একটি রুমে দু-একটি কম্পিউটার বসিয়ে চলছে।
এ অখ্যাত অনলাইনগুলোর কথিত সম্পাদকরা অনলাইন পত্রিকা (!)র সুবাদে গাড়িতে প্রেস কার্ড লাগিয়ে ঘোরেন। পেশায় টেন্ডারবাজি করলেও বিশেষ বিশেষ জায়গায় এরা প্রযোজনমতো নিজেদের সাংবাদিক হিসেবে জাহির করে বাড়তি সুবিধা নিতে চান। কিছু কিছু সাইটের কাজই রীতিমতো ব্ল্যাকমেইল করা।
এতো গেলো আন্ডারগ্রাউন্ড অনলাইনের কথা। মূল ধারার দুটি অনলাইন সংবাদমাধ্যম ছাড়াও গুটি কয় অনলাইন সংবাদ মাধ্যম রয়েছে যাদের নাম প্রনীধানযোগ্য এবং তারা ধীরে ধীরে নিজস্ব পাঠক সৃষ্টি করছে।
দ্য রিপোর্ট, বাংলামেইল, নতুন বার্তা এবং রাইজিং বিডি নামের অনলাইনগুলোও ধীরে ধীরে এগিয়ে যাচ্ছে। এগুলো প্রাতিষ্ঠানিক একটি কাঠামোয় চলছে। পেশাদার সাংবাদিকরাই এগুলোতে কাজ করছেন। তবে আকারে বড় না হওয়ায় এখনো এরা সংবাদের কনটেন্ট তৈরিতে প্রধান দুটি অনলাইনের চেয়ে অনেক পিছিয়ে। এবং কনটেন্ট ব্যবহারে এদের পরনির্ভরশীলতা আছে।
এছাড়াও দুই-একটি অনলাইনের নাম উল্লেখ করা যায় যারা কোনো কোনো বড় শিল্প প্রতিষ্ঠান বা কোম্পানির অর্থায়নে চলছে। কিন্তু এদের পেশাদারিত্ব অনেকটা শুন্যের কোটায়। এ ধরনের প্রতিষ্ঠান স্রেফ কাটপেস্টের কারবার চালিয়ে যাচ্ছে। আর শিল্প প্রতিষ্ঠানের মালিকপক্ষ ‘একটি অনলাইন আছে’ এই ভাবনায় এসব অপচর্চায় মনোযোগ দিচ্ছে না।
এবার আসা যাক জাতীয় দৈনিকগুলোর অনলাইন ভার্সনের বিষয়ে। দেশের সংবাদপত্রের পাঠকদের বড় অংশ এখন অনলাইনে চলে যাওয়ায় পত্রিকাগুলোও তাদের ওয়েবসাইটের দিকে বাড়তি নজর দিয়েছে।
বর্তমানে দেশের প্রথম সারির প্রায় সব কাগজের দৈনিকগুলো তাদের অনলাইন ভার্সন চালু করেছে। নিজেদের কাগজে বিজ্ঞাপন দিয়ে বলছে যে তরতাজা সংবাদ এখন তাদের অনলাইনে পাওয়া যাচ্ছে।
কিন্তু পর্যবেক্ষণ বলছে, এসব দৈনিক অনলাইন অনেকটা দৈনিক স্টাইলেই চলে। সকাল বেলা যখন সংবাদপত্র প্রকাশিত হয় তখন তার সব খবর অনলাইনে দেওয়া হয়। কিন্তু পরে সারা দিনে যেসব খবর ব্রেক করে তার খুব কমই অনলাইন ভার্সনে পাওয়া যায়। আর এক্ষেত্রে অনলাইনে বড় ধরনের কর্মী বাহিনী না থাকার কারণে এরা পুরোপুরি মূলধারার অনলাইন বা নিউজপোর্টালগুলোর খবর কাট পেস্ট করে চলে।
কাগজের অনলাইন ভার্সনগুলো প্রথম শ্রেনীর নিউজপোর্টালের সংবাদ প্রায় হুবহু বা একটু এদিক ওদিক করে তাদের সাইটে আপলোড করছে। অর্থ্যাৎ নিউজপোর্টালগুলো যে সংবাদ ব্রেক করছে সেখান থেকে নিয়ে কাগজের দৈনিকগুলোর ওয়েবসাইট তা আপলোড করছে মাত্র। আর এটাকেই তারা বলছে তরতাজা সংবাদ!
কৃর্তৃপক্ষ না মানলেও এসব দৈনিক পত্রিকার অনলাইন বিভাগে যারা কাজ করছেন তারা অনায়াসে বিষয়টি স্বীকারও করে নেন। তাদের কাজ সারাক্ষণ কম্পিউটার খুলে বসে থাকা। অনলাইন নিউজ পোর্টালে কোনো খবর প্রকাশিত হলে তা কাট করে নিজেদের সাইটে পেস্ট করা। তবে এক্ষেত্রে তারা ‘নিজস্ব প্রতিবেদক’ কথাটি লিখতে ভোলেন না।
শীর্ষ একটি জাতীয় দৈনিক পত্রিকার অনলাইন ইনচার্জ নাম প্রকাশ না করে জানাচ্ছিলেন, প্রতিদিন গড়ে ১২০টি করে খবর তারা বাংলানিউজ থেকে কপি পেস্ট করেন।
জানতে চাইলাম, তারা নিজেদের পত্রিকার রিপোর্টারের কাছ থেকে নিউজগুলো পান কি না। তিনি বললেন-অনলাইনের জন্য নিউজ আমাদের কাগজের রিপোর্টারদের কাছ থেকে ফোনে নেওয়া যায় না। অফিস থেকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছিলো অনলাইনে আগে রিপোর্ট দিতে কিন্তু কাগজের রিপোর্টাররা এটাকে অতিরিক্ত দায়িত্ব মনে করেন। শেষ পর্য্যন্ত কাগজের অনলাইন ভার্সনের ভরসা মূল ধারার নিউজপোর্টালগুলোই।
দেশের সর্বাধিক প্রচারিত দৈনিকের একাধিক রিপোর্টারকেই দেখেছি তাদের অনলাইন থেকে কেউ নিউজ নেয়ার জন্য ফোন দিলে খুবই বিরক্ত হন। তাদের কথা, আমরা কাগজে কাজ করে অনলাইনের জন্য বাড়তি সার্ভিস কেনো দেবো?
আরেকটি বিষয় প্রায়শঃই দেখা যায়। অ্যাসাইনমেন্ট কাভার করতে গেলে, শোনা যায় রিপোর্টাররা ফোনে জানিয়ে দিচ্ছেন, বাংলানিউজে প্রকাশিত হয়েছে, ওখান থেকে নিয়ে নেন।
অনলাইনের জন্য আলাদা রিপোর্টার না থাকায় তাদের নিউজগুলো হয়ে যাচ্ছে বাই প্রোডাক্ট। এতে বলা যায় আন্ডারগ্রাউন্ড অনলাইনগুলো যেমন মূলধারার নিউজপোর্টালগুলোর ওপর নির্ভরশীল তেমনি কাগজের দৈনিকগুলোর অনলাইনভার্সনও।
কাজেই দৈনিকগুলো তাদের কাগজে বিজ্ঞাপন দিয়ে যতই বলুক তাৎক্ষণিক সংবাদ তাদের অনলাইনে পাওয়া যাচ্ছে সচেতন পাঠকেরও বুঝতে অসুবিধা হয় না যে এসব নিউজ তাদের বাই প্রোডাক্ট। অপ্রিয় হলেও এটা সত্য যে শীর্ষ কাগজগুলোর অনলাইন ভার্সন যতটা চলছে তা তাদের মূল কাগজের জনপ্রিয়তার কারণেই।
এবার আসা যাক টেলিভিশন চ্যানেলগুলোর অনলাইন ভার্সনের বিষয়ে। অনলাইনের জয় জয়কার দেখে কয়েকটি টেলিভিশনের কর্তৃপক্ষও এদিকে নজর দিচ্ছে। এটা আশার কথা।
গতবছর একটি টিভি চ্যানেলের বার্তা প্রধান কথা প্রসঙ্গে বলছিলেন, তারাও নিউজপোর্টাল করছেন। অনলাইনের জন্য ডেস্কে দেড় ডজন লোকও নিয়েছেন। আমি বললাম-রিপোর্টার কয়জন? বললেন-রিপোর্টার কেন? টিভির রিপোর্টারতো আছেই, ফোনে তাদের কাছ থেকেই ডেস্কের লোকজন ফোন করে খবর নেবে। আমি বললাম-যা বিনিয়োগ করলেন অনলাইনের জন্য তাই লস হবে। তিনি তখন আমার উপর মন খারাপ করে বললেন-একটা জিনিসের শুরুতেই আমি তার আগ্রহ নষ্ট করছি।
বছর না যেতেই গত মাসে তিনি বললেন-আসলে তোমার কথাই ঠিক ছিল। টিভির রিপোর্টারদের নির্দেশ দেয়ার পরও তারা স্বপ্রণোদিতভাবে অনলাইনে নিউজ দেয় না। তাছাড়া দিতে পারেও না কারণ তাদের প্রথম টার্গেট থাকে টিভিতে স্ক্রল দেয়ার এরপর চিন্তা থাকে নিউজটি ধরানোর।
পত্রিকার মতো টিভির অনলাইনগুলোও একপর্যায়ে নির্ভরশীল হয়ে পড়ে নিউজপোর্টালগুলোর ওপর। অর্থ্যাৎ তাদের অনলাইনে যে নিউজগুলো যাচ্ছে তাও বাই প্রোডাক্ট অথবা কাট পেস্ট।
সঠিক পরিকল্পনা না থাকায় এসব টিভির অনলাইনও শক্ত ভিত্তির উপর দাঁড়াতে পারছে না। অথচ আল জাজিরা কিংবা পাশ্ববর্তী দেশের এনডিটিভির অনলাইনে তাদের টিভির দর্শকের চাইতে অনলাইনে বেশি পাঠক।
এই লেখা নিয়ে যে কোনো মন্তব্য পাঠাতে লিখুন- aditya.arafat1@gmail.com এই ঠিকানায়।
বাংলাদেশ সময়: ১৭০৬ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২৬, ২০১৪