ঢাকা, মঙ্গলবার, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৬ নভেম্বর ২০২৪, ২৪ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

মুক্তমত

মেট্রোরেল বিতর্ক: যুক্তিতর্ক, বিরোধিতা ও বাস্তবতা

মোফাজ্জল হোসেন সুমন, অতিথি লেখক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২১৩৫ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১১, ২০১৬
মেট্রোরেল বিতর্ক: যুক্তিতর্ক, বিরোধিতা ও বাস্তবতা

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতর দিয়ে মেট্রোরেলের লাইন যাবে কি যাবে না এ নিয়ে বেশ কয়েকদিন যাবত পক্ষে-বিপক্ষে লেখা দেখছি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় যেহেতু কারও একক সম্পত্তি নয় বরং এই পরিবারের সদস্য হিসেবে এবং অনেকের আবেগের জায়গা হিসেবে পক্ষে-বিপক্ষে সবাই মত দিতেই পারেন, সেটা খুব স্বাভাবিক এবং প্রত্যাশিত।



পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ, ব্যস্ততম মেট্রোরেল স্টেশন, বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে আসা-যাওয়ার ফলে আমার নিজের কিছু অভিজ্ঞতা আছে; সেই আলোকেই কিছু কথা বলবো, বিবেচনার ভার আপনাদের। প্রথমে আসছি, যারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিতর দিয়ে মেট্রোরেলের লাইনের যারা বিরোধিতা করছেন তাদের যুক্তিগুলোতে। গত কয়েকদিনে তাদের অনেকের লেখা পড়ে আমার কাছে যেটা মনে হয়েছে তারা যে যুক্তিগুলো দেখিয়েছেন সেগুলো হচ্ছে:

১. মেট্রোরেলের ফলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের যে রাজনৈতিক ঐতিহ্য রয়েছে সেটা হুমকির সম্মুখীন হবে।
২. মেট্রোরেলের ফলে প্রচণ্ড শব্দ দূষণ হবে যার ফলে শিক্ষার্থীদের পড়াশোনা, গবেষণায় প্রচণ্ড ব্যাঘাত ঘটবে।
৩. মেট্রোরেলের ফলে মারাত্মক পরিবেশ দূষণ হবে।
৪. রাজু ভাস্কর্যের সৌন্দর্য বিলীন হয়ে যাবে।

মেট্রোরেলের ফলে যদি সত্যি এ ধরনের বিপর্যয় ঘটে একজন বিবেকবান মানুষ হিসেবে এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পরিবারের একজন হিসেবে আমার কেন কারোই এই মেট্রোরেলের পক্ষে কথা বলা উচিত হবে না এবং সরকারেরও উচিত হবে না বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্য দিয়ে মেট্রোরেল চালু করা।

এবার দেখা যাক তারা যে যুক্তিগুলো দিচ্ছেন বা যে শঙ্কাগুলো করছেন সেটা কতটুকু যৌক্তিক।

১. ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে অন্য যেকোন বিশ্ববিদ্যালয়ের যে পার্থক্য সেটি হচ্ছে তার রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের ভূমিকায়। ’৫২-এর ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে মহান মুক্তিযুদ্ধে, যেকোন প্রগতিশীল আন্দোলন, ’৯০-এর স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে এ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের যে ভূমিকা তা অনস্বীকার্য। এটা বিশ্ববিদ্যালয়ের সামগ্রিক চেতনা, তো এই সামগ্রিক চেতনার সাথে মেট্রোরেল যেখানে একটি উন্নয়নমূলক ইস্যু সেটা কিভাবে সাংঘর্ষিক সেটা অবশ্য তাদের লেখায় আমি বুঝিনি। এটা কোনভাবেই সাংঘর্ষিক হওয়ার কথাও না।

২. বলা হচ্ছে মেট্রোরেলের ফলে প্রচণ্ড শব্দ দূষণ হবে যার ফলে একাডেমিক কার্যক্রমে ব্যাঘাত ঘটবে! অন্যান্য যোগাযোগ ব্যবস্থার সাথে মেট্রোরেলের পার্থক্য এখানেই- এতে কম শব্দ দূষণ হয়। ইউরোপ, আমেরিকায় আমি এরকম অসংখ্য বিশ্ববিদ্যালয়ের উদাহরণ দেখাতে পারবো যে, বিশ্ববিদ্যালয়ের মাঝখান দিয়ে মেট্রোরেল চলে গেছে এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীদের সুবিধার্থে বিশ্ববিদ্যালয়ের মাঝখানে অনেক স্টপেজ করা হয়েছে। আমি বর্তমানে আছি জার্মানিতে, আমার বাসার পাশেই আছে ডুইসবুর্গ-এসেন ইউনিভার্সিটি যার লাইব্রেরির প্রায় ১৫০ মিটার দুরত্বেই মেট্রোরেলের স্টেশন। কই তাদের তো পড়াশুনায় কোনো ব্যাঘাত ঘটছে না। আমার বাসার কোল ঘেঁষে মেট্রোরেল চলে গেছে এবং এখানে বিশ্ববিদ্যালয়ের দুটি ডর্ম রয়েছে, আমাদের কারো তো কোন অসুবিধা হচ্ছে না! এখানে মুলহাইমে একটি নতুন বিশ্ববিদ্যালয় হচ্ছে; ছাত্রদের সুবিধার কথা বিবেচনা করে মাত্র ৪০ সেকেন্ড দ‍ূরত্বে দুটি মেট্রোরেলের স্টেশন করা হচ্ছে যাতে তাদের এক ফ্যাকাল্টি থেকে আরেক ফ্যাকাল্টিতে যেতে বেশি সময় না লাগে।

আমার জীবনের অন্যতম সেরা সময় কেটেছে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে। এই হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণকেন্দ্র হার্ভার্ড স্কয়ারেই রয়েছে সাবওয়ে স্টেশন। আমি থাকতাম এলিয়ট হাউজে, এই মেট্রো স্টেশন থেকে মাত্র ৩০০ মিটার দূরত্বে, পাশেই ক্রিকল্যান্ড হাউজ (ফেইসবুকের প্রতিষ্ঠাতা মার্ক জুকারবার্গ এই হলের-ই আবসিক ছাত্র ছিলেন), ৫০০ মিটার দূরত্বেই লাইব্রেরি, সায়েন্স সেন্টার, জন এফ কেনেডি স্কুল অব গভর্নমেন্ট।

২০১৩ সালে এক জরিপে দেখা গেছে কেবল এই স্টেশনেই সপ্তাহে প্রায় ২৩,১৯৯ জন যাত্রী আসা যাওয়া করে। বিশ্বের সেরা বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে অন্যতম এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী কিংবা শিক্ষকরা তো কোনদিন এই অভিযোগ করেনি যে, এই স্টেশনের জন্য তাদের শিক্ষা কিংবা গবেষণায় অসুবিধে হয়। নীচের ছবি দুটোতেই দেখা যাচ্ছে মেট্রো স্টেশন থেকে এই দুই জায়গার দূরত্ব।

নিচের যে ছবিটি দেখা যাচ্ছে সেটি ট্রিনিটি কলেজ, ডাবলিনের ছবি। A অক্ষর দিয়ে চিহ্নিত যে বিল্ডিংটা দেখা যাচ্ছে, সেটা কম্পিউটার সায়েন্স ডিপার্টমেন্টে রিসার্চ ল্যাব। এই বিল্ডিং-এর ঠিক উপর দিয়ে চলে গিয়েছে ডাবলিনের মেট্রোরেইল ‘ডাটর্' এর লাইন। E অক্ষর দিয়ে চিহ্নিত করা বিল্ডিংটা হচ্ছে পিয়াসর্‌ স্ট্রিট স্টেশন। অনেক রাত পর্যন্ত যারা ল্যাবে কাজ করে তাদের জন্য এ স্টেশন আশীর্বাদ স্বরূপ।

এই ট্রেনের কারণে কিন্তু ট্রিনিটি কলেজ ডাবলিনের ছাত্রদের পড়ালেখায় সমস্যা হয়েছে বলে কখনও দাবি ওঠেনি। ছবিতে পাশেই F অক্ষর দিয়ে চিহ্নিত করা যে বিল্ডিংটা দেখছেন, ওটা সায়েন্স গ্যালারি। ওখানে সব সময় এক্সিবিশন চলতে থাকে। ট্রেনটা কিন্তু ওটারও উপর দিয়ে গিয়েছে। তাতে এক্সিবিশনেরও কোনো সমস্যা কখনও হয়নি। C অক্ষর দিয়ে চিহ্নিত বিল্ডিংটা জিম। জিমেও কখনো সমস্যা হয় বলে জিমের সদস্যরা অভিযোগ করেনি বরং স্টেশন কাছে থাকায়, D দিয়ে চিহ্নিত রাস্তার উপর একটা দৃষ্টিনন্দন সেতু রয়েছে যা ধরে দ্রুত ট্রেনে চাপা যায়।

এছাড়া পড়ালেখা বা গবেষণার ক্ষেত্রেও তেমন কোনো সমস্যার কথা কেউ কোনদিন বলেনি। কম্পিউটার সায়েন্সের পাশেই যে ফিজিক্স ডিপার্টমেন্ট দেখছেন (B অক্ষর দিয়ে চিহ্নিত), ওখান থেকে পাশ করে আর্নেস্ট ওয়াল্টন ফিজিক্সে নোবেল জিতেছেন। এবার ২০১৫-তে মেডিসিনে নোবেল পাওয়া প্রফেসার উইলিয়াম ক্যাম্বেলও পাশ করেছেন পাশেরই আরেকটা বিল্ডিং-এ ক্লাস এবং ল্যাব করে। অতএব, মেট্রোরেলের ফলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের পড়ালেখা বা ক্লাস করাতে সমস্যা হবে এ শঙ্কা কেবল অমূলকই না ভিত্তিহীনও বটে।

তবুও আপনাদের যাদের কাছে মনে হয় মেট্রোরেল এক বিশাল শব্দদানব, তাদের জন্য আমি বিশ্বের বিখ্যাত বিখ্যাত শহরের ব্যস্ততম মেট্রোরেলে শব্দের পরিমাণ কী রকম সেটা শোনানোর জন্য একটি লিঙ্ক দিচ্ছি, সেখান থেকে আপনি ব্যস্ততম এবং সবচেয়ে বেশি শব্দ যেখানে হয় তা শুনতে পাবেন এবং সেটা শুনেই তুলনা করবেন আমাদের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মেট্রোরেল গেলে কতটুকুই বা শব্দ হবে আর এতে করে কি-ই বা এমন ব্যাঘাত ঘটবে। আমরাতো সেই রাস্তায় প্রতিদিন প্রাইভেটকার, সিএনজিচালিত অটোরিকশা, রিকশা এবং আরও গণপরিবহনের শব্দ শুনছি-ই।
http://www.soundsnap.com/tags/subway

৩. পরিবেশ দূষণ এবং রাজু ভাস্কর্যের সৌন্দর্য। হুম এটা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। তবে সেটা সম্পূর্ণ নির্ভর করবে ব্যবস্থাপনার ওপর। মেট্রোরেল এমন কোনো কালো ধোঁয়া নির্গত করে না, যে কারণে পরিবেশ দূষণ হবে। তবে আমরা বাংলাদেশে দেখেছি রেল লাইনের ধার ঘেঁষে ফুটপাতে ছোট ব্যবসায়ী এবং মাদকসেবীদের একটি আড্ডা গড়ে ওঠে যা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন এবং সিটি কর্পোরেশনের সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে। আন্দোলন যদি করতেই হয় তবে সেটার জন্য করুন, এর জন্য মেট্রোরেলের কেন বিরোধিতা?



মোফাজ্জল হোসেন সুমন:
সাবেক সভাপতি, ঢাকা ইউনিভার্সিটি ডিবেটিং সোসাইটি (ডিইউডিএস)। বর্তমানে জার্মানিতে ইউজিবিলিটি ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে অধ্যয়নরত।


বাংলাদেশ সময়: ২১৪৮ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১১, ২০১৬
এমজেএফ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।