ঢাকা, মঙ্গলবার, ১১ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৬ নভেম্বর ২০২৪, ২৪ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

মুক্তমত

আমেরিকান মূল্যবোধে ধর্মীয় স্বাধীনতা এবং বহুত্ববাদের সহনশীলতা || মার্শা বার্নিকাট

মার্শা বার্নিকাট, বাংলাদেশে যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৯১৪ ঘণ্টা, জানুয়ারি ২৮, ২০১৬
আমেরিকান মূল্যবোধে ধর্মীয় স্বাধীনতা এবং বহুত্ববাদের সহনশীলতা || মার্শা বার্নিকাট মার্শা বার্নিকাট

ধর্মীয় স্বাধীনতা আমেরিকান জীবনের অবিচ্ছেদ্য একটি অংশ। এ স্বাধীনতা আমাদের রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সময় থেকেই রয়েছে।

  আদতে, অনেক ইউরোপীয় ব্যক্তি ও পরিবার ধর্মীয় নির্যাতন থেকে বাঁচার জন্য পালিয়ে আমেরিকায় এসে বসতি স্থাপন করেছিল। সে বিবেচনায় আমাদের সংবিধানের ‘বিল অফ রাইটস’- এ ‘প্রথম স্বাধীনতা’ হিসেবে এই মৌলিক অধিকার সন্নিবেশিত থাকা মোটেও আশ্চর্যজনক নয়।

ধর্মীয় স্বাধীনতার একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হচ্ছে সব ধর্মের মানুষ কোনো প্রকার ধর্মীয় বৈষম্য ছাড়া সমাজের সব কিছুতে অংশগ্রহণ করতে পারবে। ধর্মীয় বহুত্ববাদ একটি আমেরিকান মূল্যবোধ ও ঐতিহ্য, যা কেবল ধর্মীয় বৈচিত্র্যের প্রতি ‘সহনশীল’ করে তোলে না, একটি জাতীয় সম্পদ হিসেবেও একে আলিঙ্গন করে নেয় এবং বিভিন্ন ধর্মবিশ্বাসীদের মধ্যে একটি সেতুবন্ধন তৈরির সুযোগ করে দেয়।   দারিদ্র্য ও বৈষম্য কাটিয়ে উঠতে প্রতিদিন আমাদের দেশের প্রতিটি রাজ্যে খ্রিস্টান, ইহুদি, হিন্দু, বৌদ্ধ, শিখ এবং অন্যান্য বিচিত্র ধর্মের লোকেরা আমেরিকান হিসেবে আসে। এখানে তারা পুনর্বাসিত হয়। পরে আবার তারাই নিপীড়ন থেকে পালিয়ে আসা শরণার্থীদের সাহায্য করে। তাদের এসব কাজ যুক্তরাষ্ট্রের সিলে খোদাই করা আমাদের জাতীয় স্লোগান ‘অনেকের মাঝেও একাত্ম’রই প্রতিফলন।

বাংলাদেশে যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত হিসেবে আমেরিকার গল্পগুলো সবার সঙ্গে ভাগ করে নেওয়ার সুযোগ রয়েছে আমার। সে হিসেবে সাম্প্রতিক ঘটনাবলীর মধ্য থেকে উদাহরণ হিসেবে বলা যেতে পারে, আল-কায়েদা অথবা আইএসআইএল’র তৎপরতার কথা। তাদের হামলার পর আমি প্রায়ই আমেরিকান মুসলমানদের অধিকার সম্পর্কে উদ্বেগের কথা শুনতে পাই।   আমি সুস্পষ্ট করে বলতে চাই, মুসলমানদের বিরুদ্ধে সহিংসতা অথবা বৈষম্য আমেরিকান নীতির পরিপন্থী এবং গ্রহণযোগ্য নয়। এই নীতি যুক্তরাষ্ট্র সরকারের ছিল এবং থাকবে। চলতি বছরের শুরুতে প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা যেমনটি বলেছিলেন, ‘আমাদের দেশের জন্ম থেকেই ইসলাম এর একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে আছে। মুসলিম আমেরিকানরাও এর বাইরে নয়। ’

ক্যালিফোর্নিয়ার সান বার্নারডিনোতে সাম্প্রতিক হামলার পর ওবামা জাতির উদ্দেশ্যে তার ওই ভাষণে সুস্পষ্ট করে বলেন, ‘আইএসআইএল ইসলামের প্রতিনিধিত্ব করে না। তারা অপরাধী, খুনি ও হন্তারক সংস্কৃতির অংশ...। সারাবিশ্বের মুসলমানদের যেমন দায়িত্ব রয়েছে চরমপন্থার দিকে নিয়ে যায় এমন বিপথে তাড়িত করার ধ্যান-ধারণা প্রত্যাখ্যান করা, তেমনি সব ধর্ম বিশ্বাসের আমেরিকানদেরও দায়িত্ব যেকোনো বৈষম্য প্রত্যাখ্যান করা। ধর্মীয় বিশ্বাসের ওপর ভিত্তি করে আমরা কাকে দেশে প্রবেশ করতে দেবো, এ ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষার ধারণাও প্রত্যাখ্যান করা আমাদের দায়িত্ব।   আমেরিকান মুসলমানদের সঙ্গে ভিন্ন আচরণ করতে হবে, এই ধরনের প্রস্তাবও প্রত্যাখ্যান করা আমাদের দায়িত্ব।   কারণ আমরা যখন ওই পথে হাঁটি, তখন আমরা হেরে যাই। ’

একটি বিষয় আমরা পরিষ্কারভাবে জেনে নিই, একটি সফল জাতি হিসেবে গড়ে উঠতে আমেরিকার কাছে ধর্মীয় স্বাধীনতা যেমন একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, তেমনিভাবে বুঝতে হবে, এই অধিকারগুলো কেবল আমেরিকান জনগণের জন্যই নয়। মানবাধিকারের সার্বজনীন ঘোষণাপত্র এবং নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকার সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক চুক্তি ধর্মবিশ্বাস পছন্দ করার স্বাধীনতা, কারো বিশ্বাস পরিবর্তন, ধর্মীয় ভিন্নমত পোষণ, বিশ্বাস নিয়ে জনসম্মুখে কথা বলা, প্রার্থনার জন্য একত্রিত হওয়া এবং সন্তানকে ধর্মীয় বিশ্বাস শিক্ষা দেওয়ার অধিকারকে সংরক্ষণ করে। প্রকৃতপক্ষে, এই দেশে ধর্মীয় স্বাধীনতাকে আমরা এতোটা মূল্য দিই বলেই যুক্তরাষ্ট্র কংগ্রেস ধর্মীয় স্বাধীনতার অগ্রগতিকে দেশের বৈদেশিক নীতিতে প্রাধান্য দিয়েছে এবং এর পররাষ্ট্র দফতরের অধীনে একটি আন্তর্জাতিক ধর্মীয় স্বাধীনতা বিষয়ক অফিস প্রতিষ্ঠা করেছে। আমাদের রয়েছে আন্তর্জাতিক ধর্মীয় স্বাধীনতা বিষয়ক অ্যাম্বাসাডর-অ্যাট-লার্জ এবং নিকট প্রাচ্য ও দক্ষিণ/মধ্য এশিয়াতে ধর্মীয় সংখ্যালঘু বিষয়ক বিশেষ উপদেষ্টা, যারা এই অবিচ্ছেদ্য অধিকার বিষয়ে আমাদের প্রচেষ্টাকে এগিয়ে নিচ্ছেন।
 
এটা সত্য যে, বিশ্বের কিছু জায়গার মতো ধর্মীয় গোঁড়ামি সংক্রান্ত ঘটনা যুক্তরাষ্ট্রেও ঘটে থাকে। সংগত কারণেই বিদ্বেষপূর্ণ বক্তব্য ব্যাপক হারে ছড়িয়ে পড়ে।   কিন্তু এটি পুরো গল্পের ক্ষুদ্র একটি অংশ মাত্র।

যুক্তরাষ্ট্র বিষয়ে আরও সঠিক পর্যবেক্ষণ পাওয়া যেতে পারে এর দৈনন্দিন কার্যক্রমগুলোতে, যেগুলো সাধারণত আন্তর্জাতিক খবরে প্রকাশিত হয় না। এর আংশিক কারণ হলো, এই সহিষ্ণুতা ও পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধের ঘটনাগুলোর সংবাদমূল্য নেই, কেননা এগুলোই স্বাভাবিক। তেমনই সব ঘটনাবলীর মধ্যে রয়েছে অসংখ্য সরকারি কর্মকর্তা, ধর্মীয় নেতা এবং সুশীল সমাজের সব রকমের বৈষম্য প্রত্যাখ্যান। এরা সবাই তাদের সহযোগী নাগরিকদের সহায়তায় এগিয়ে এসেছেন। উদাহরণ হিসেবে আমরা বলতে পারি শতো শতো খ্রিস্টান চার্চ যেগুলো উদ্বাস্তুদের পুনর্বাসনে অর্থ সংগ্রহ করছে; হাজার আমেরিকান ইহুদি সিরীয় উদ্বাস্তুদের স্বাগত জানিয়ে লেখা চিঠিতে স্বাক্ষর করেছে; স্যান বার্নারডিনোতে ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য আমেরিকান মুসলমানদের গণ অর্থসংগ্রহ অভিযানে দুই লাখ ডলার সংগ্রহ, যেখানে সবচেয়ে আলোচিত সাত বছরের এক ছেলের জমানো সব টাকা টেক্সাসে ভাঙচুর হওয়া একটি মসজিদে দান করা। আসলে এসবই আমেরিকার সত্যিকারের গল্প।

বাংলাদেশ সময়: ১৯১৫ ঘণ্টা, জানুয়ারি ২৮, ২০১৬
এইচএ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।