ঢাকা, শুক্রবার, ১২ পৌষ ১৪৩১, ২৭ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৪ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

মুক্তমত

গণমাধ্যম থেকে যা কিছুর প্রত্যাহার চাই

সুমি খান, অতিথি কলামিস্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৯৫৫ ঘণ্টা, জুলাই ৪, ২০১১
গণমাধ্যম থেকে যা কিছুর প্রত্যাহার চাই

সাম্প্রতিক সময়ে নারীর প্রতি সহিংসতা বেড়েছে অনেক। অনেক দায়িত্বশীলতার সাথে নির্যাতিত নারীদের তথ্য উপস্থাপন করছে গণমাধ্যম।

তবু নিয়মিত প্রকাশিত এবং প্রচারিত নারী নির্যাতনের সংবাদ এবং তার শিরোনাম নিয়ে কলম ধরতে হলো। ‘প্রেমে রাজী না হওয়ায় গণ ধর্ষণ’-  শিরোনামটি বেশ প্রচলিত বাক্যচয়ন। তবে চরম মানবতাবিরোধী। বলতে হয়- পরিস্কার ভাবে নারীস্বার্থ বিধ্বংসী।
 
ভোলার পূর্ব ইলিশা ইউনিয়নের বখাটে যুবক মমিন ২৫ জুন সন্ধ্যায় তার সহযোগী রিপন, আফসার, সোহেলসহ সাত আটজনকে সাথে নিয়ে এক কলেজ ছাত্রীকে  গণধর্ষণ করেছে। নির্যাতিত তরুনীর পরিবারের লোকজন লোকলজ্জার ভয়ে সাতদিন বাড়ি থেকে বের হন নি।
 
এই আমাদের সমাজ। যে সমাজে লাঞ্ছিত, নিপীড়িত পরিবারকে লজ্জিত হতে হয়; ফতোয়াবাজ, প্রভাবশালীদের চাপে একঘরে হতে হয়। আর দুর্বৃত্তের দল বুক ফুলিয়ে ঘুরে বেড়ায়। স্থানীয় চেয়ারম্যান মেম্বার নির্যাতিত এবং আহত তরুণীকে দেখে গেলেও নির্যাতনকারী মমিন এতোটাই প্রভাবশালী, তার বিরুদ্ধে এখনো মামলা হয়নি।

চার পাঁচ মাস ধরে এই কলেজ ছাত্রীকে উত্যক্ত করতো বখাটে  মমিন। পুত্রের বখাটেপনার বিষয়টি তার বাবাকে জানানোর পর আরো ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে মমিন। এলাকার প্রভাবশালী মাহবুব তালুকদার এর ‘গুণধর’ এবং ‘প্রভাবশালী’ পুত্র বলে কথা!!

৩ জুলাই বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম এ প্রচারিত রিপোর্টে  আরো প্রকাশ, মমিনের ‘প্রেমের প্রস্তাবে’ রাজী না হবার কারণে এ আক্রমন। সেদিন পরানগঞ্জ বাজার থেকে এ তরুণী রিক্সায় করে বাড়ি ফেরার পথে মমিন ধারালো ছুরি ঠেকিয়ে তাকে রিক্সা থেকে নামিয়ে নেয়। ভীত সন্ত্রস্ত তরুণী দৌড়ে পালাতে চাইলে তাকে মাটিতে ফেলে লাঠিপেটা করে তার বাম পা ভেঙ্গে দেয় মমিন।
কতোটা বর্বর হলে আহত, রক্তাক্ত তরুনীর মুখে রুমাল গুঁজে পাশের বাগানে নিয়ে পরদিন সকাল পর্যন্ত নির্যাতন করে মমিন ও তার সহযোগীরা।
২৬ জুন অজ্ঞান অবস্থায় এ তরুণীকে উদ্ধার করে হাসপাতালে ভর্তি করে তার স্বজনেরা। তার জ্ঞান ফিরার পর সব জানতে পারেন তরুণীর স্বজনেরা।
দরিদ্র কৃষকের ৭ সন্তানের মধ্যে কনিষ্ঠতম এই তরুণী পাঙ্গাশিয়া স্কুল এন্ড কলেজের একাদশ শ্রেনীতে পড়তো। এখন কী হবে তার পড়ালেখার?
প্রত্যন্ত গ্রামের এ তরুণীর কাছে কান্নাই একমাত্র আশ্রয়। এ তরুণী জানেনা কার কাছে বিচার চাইবে, তার ভবিষ্যৎ ই বা কী!

কন্যার প্রতি এ অন্যায়ের বিচার চান বাবা-মা। বিবেকবান প্রতিটি মানুষ মমিনের শাস্তি দাবি করবেন।

এভাবে অনেক সময়ে এসিড  নিক্ষেপসহ সব রকমের ভয়াবহতার শিকার হতে হচ্ছে স্কুল কলেজের ছাত্রীদের। দেশের নীতিনির্ধারকদের কাছে সব ই হয়তো গুরুত্বহীন। আমার কাছে প্রতিটি  বিষয় অনেক গুরুত্বপূর্ণ। তবে একই সাথে এ তথ্য প্রকাশের পদ্ধতিও গুরুত্বপূর্ণ।

যা নারীর অবস্থান আরো বিপন্ন করে তুলছে। শিরোনামের মাধ্যমে দুর্বৃত্তায়নকে প্রশ্রয় দিচ্ছে অনেক সংবাদমাধ্যম। এক্ষেত্রে আরো দায়িত্বশীলতা প্রয়োজন।
গণমাধ্যমের শিরোনামদাতা  অগ্রজ সাংবাদিকদের প্রতি আমার  বিনীত প্রশ্ন ‘প্রেমের প্রস্তাব’ বা ‘প্রেমে’ ‘রাজী না হওয়া’ বা ‘প্রেমে ব্যর্থতা ’ কি দুবৃত্তায়নের অজুহাত হতে পারে?

প্রত্যন্ত জনপদে একটি মেয়ে ‘ইজ্জত রক্ষার জন্যে দৌড়ে পালানোর চেষ্টা করে’। এ ভাষা কোন সভ্য সমাজের ভাষা হতে পারেনা। কাউকে প্রথম দেখায় ভালো লাগা আর ব্যক্তিগত সম্পদ মনে করা এক কথা নয়।

প্রেম নিয়ে যুগে যুগে কালে কালে অনেক সাহিত্য রচিত হয়েছে। রাধা কৃষ্ণ, আনারকলি- সেলিম, শাহজাহান- মমতাজ অথবা দেবদাস-পার্বতী . . . . . এরকম  অনেক কিংবদন্তী মুখে মুখে আছে।

পথের ধারে  স্কুলগামী একটি মেয়েকে দেখেই তাকে ‘ব্যক্তিগত সম্পদ’ ভেবে তাকে যা ইচ্ছে তা বলা। তাতে সায় না দিলে  তার উপর বর্বর নির্যাতন করে সারা জীবনের জন্যে পঙ্গু করে দেয়া । এ যে চরম অন্যায়- তা বুঝিয়ে দিতে হবে অসচেতন অবিবেচক এবং অমানবিক ‘প্রভাবশালী’দের।

নারী পুরুষ সম্মিলিত ভাবে বিশ্বকে এতোদূর এগিয়ে এনেছে। পারস্পরিক সহমর্মিতা এক্ষেত্রে খুব গুরুত্বপূর্ণ। কাউকে ভালোবাসলে তার সাথে নিষ্ঠুরতা করা যায়না। এবং জোর করে ভালোবাসা আদায় করা যায়না - যতো অপ্রিয় ই হোক এ সত্য মানতে হবে সবাইকে।

মনোজগতে সচেতনতা সৃষ্টির এ কাজ গণমাধ্যমকেই করতে হবে। সুস্থ সমাজ গড়ার স্বার্থে গণমাধ্যমকর্মীদের হাতে হাত রেখে কর্ম এবং ভাবনায় একনিষ্ঠ হওয়া প্রয়োজন।

প্রতিটি নির্যাতিতের কন্ঠে কন্ঠ মিলিয়ে বলছি-  গণমাধ্যমে আমরা দায়িত্বশীল শিরোনাম চাই। নারীর প্রতি সহিংসতা সংক্রান্ত সংবাদের  শিরোনাম এবং বাক্যচয়নের ক্ষেত্রে  নীতিনির্ধারকদের  অনেক সতর্কতা এবং দায়িত্বশীলতা আশা করছি।

বাংলাদেশ সময় ১৯৪১ ঘণ্টা জুলাই ০৪, ২০১১

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।