ঢাকা, বুধবার, ১২ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ নভেম্বর ২০২৪, ২৫ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

মুক্তমত

দৃপ্ত শপথের সেই মুজিবনগর সরকার

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৯৪৫ ঘণ্টা, এপ্রিল ১৭, ২০১৬
দৃপ্ত শপথের সেই মুজিবনগর সরকার

বিস্মৃতির মহাকাব্য অনেক বিষয় নিয়ে লেখা সম্ভব হলেও মুজিবনগর দিবস নিয়ে লেখা সম্ভব নয়। যেই দিনটিতে বাংলাদেশের স্বাধীনতার সূর্য আনুষ্ঠানিকভাবে উদিত হয়েছিল, সেই দিনটি বিস্মৃতির অন্তরালে যাবে এটি কখনও সম্ভব নয়।

বিশেষ করে যারা অত্যাচার-নিপীড়নের নাগপাশ থেকে মুক্তির স্বপ্নে, দেশমাতৃকার স্বাধীনতার স্বপ্নে বিভোর ছিলেন, যারা দখলদার হানাদারদের পবিত্র মাতৃভূমির মাটি থেকে বিতাড়িত করতে চেয়েছিলেন, তাদের কাছে ওই দিনের ঘটে যাওয়া প্রতিটি ঘটনাই এমন মহার্ঘ্য রূপে আর্বিভূত হয়েছিল যে, তা বিস্মৃত হওয়া কল্পনাতীত একটি বিষয়ই বটে।

১৭৫৭ সালের ২৩ জুন পলাশীর আম্রকাননে বাংলার যে স্বাধীনতার সূর্য অস্তমিত হয়েছিল তার ঠিক ২১৪ বছর পরে, ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল কুষ্টিয়ার মেহেরপুরের মুজিবনগরের আরেক আম্রকাননে বাংলার সেই অস্তমিত স্বাধীনতার সূর্য আবারও উদিত হয়ে বাংলাদেশ নামক ভূখণ্ডটিকে স্বাধীন দেশ হিসেবে বিশ্বের মানচিত্রে জায়গা করে দিলো। তাই ১৭ এপ্রিলকে ভুলে যাওয়ার চেষ্টা করা মানে নিজের আত্মপরিচয়কেই ভুলে যাওয়া, নিজের সঙ্গে নিজেরই প্রতারণা করা। দুর্ভাগ্য, এদেশে এখনও অনেকে আছেন যারা মহান ১৭ এপ্রিলের মুজিবনগরের ঘটে যাওয়া ঘটনাকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করেন। তাদের সেটা করার যৌক্তিকতাও আছে কিন্তু। তারা মননে-সৃজনে আর কর্মে সব সময়ই পাকিস্তানি ভাবধারায় বিশ্বাসী। পাকিস্তানের পরাজয়ের মূল ভিত্তি তৈরি হয়েছিল যেই মুজিব নগরের ঘটনার প্রেক্ষিতে, তাকে তো তারা তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করবেনই। বিএনপিসহ কয়েকটি রাজনৈতিক দলকে আমরা দেখি ২৬ মার্চের মহান স্বাধীনতা দিবস, ১৬ ডিসেম্বরের বিজয় দিবস নামেমাত্র পালন করতে। কিন্তু যেখান থেকে এই দেশ মাতৃকার যাত্রা শুরু সেই বিপ্লবী সরকারের ১৭ এপ্রিলের শপথ গ্রহণ দিবসটি তো তাদের উৎযাপন করতে দেখা যায় না! যেন মুজিবনগর দিবসটি হারিয়ে গেছে তাদের স্মৃতির অন্তরালে! এই নিয়ে যদি তাদের যদি প্রশ্ন করি কী জবাব দেবেন তারা?

১৭ এপ্রিল আমাদের জীবনে আকস্মিকভাবে আসেনি। ‘৪৮, ‘৫২, ‘৫৪, ‘৬২, ‘৬৬, ‘৬৯, ‘৭০, এর পথ বেয়ে আসে ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল। দীর্ঘকাল ব্রিটিশদের কাছে বন্দি থাকার পর বাঙালি ভেবেছিল মুক্তি মিলেছে তাদের। পরাধীনতার গ্লানি আর সইতে হবে না। কিন্তু না, তারা আবারও বন্দি হয়ে পড়ে পাকিস্তানি শাসকদের হাতে। সেই বন্দিত্ব থেকে মুক্তি পেতে হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি আমাদের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পুরো জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করেছিলেন। তার ডাকে সারা দিয়ে জীবনবাজি রেখে মরণপণ লড়াই-সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল গোটা জাতি। দীর্ঘ আন্দোলনের জোয়ারে ধীরে ধীরে বাঙালির হৃদয়ে আঁকা হয়ে যায় একটি লাল-সবুজ পতাকা, একটি স্বাধীন সার্বভৌম দেশের ছবি।

৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে বাঙালি জাতির মুক্তিরদূত বঙ্গবন্ধু যে ভাষণ দিয়েছিলেন, ওই ভাষণেই ‘এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’ কথাটি উচ্চারণের মধ্য দিয়েই একটি স্বাধীন দেশের ঘোষণা করেছিলেন তিনি। এটাকে অনেক দেশবিরোধী চক্র এখন স্বাধীনতার ঘোষণা হিসেবে মানতে নারাজ। খোলা ময়দানে লাখো লাখো জনতার সামনে ‘এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’ কথাটি বলার মধ্যে দিয়েই যে আমাদের জাতির পিতা স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছিলেন তা একটি শিশুও বুঝতে পারে। কিন্তু যারা পারেনি তারা হয় উন্মাদ, নয় ধূর্ত। স্বাধীনতার ঘোষণা যে বঙ্গবন্ধু আগেই দিয়েছিলেন সেই বিষয়ে আরেকটি ঘটনার কথা বলা যেতে পারে। ইয়াহিয়া খান ১৫ মার্চ ঢাকা এসেছিলেন, তখন বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘বাংলাদেশ আর পাকিস্তানের অংশ নয়। আর ইয়াহিয়া বিদেশি প্রেসিডেন্ট হিসেবে আমাদের রাষ্ট্রীয় অতিথি’। তার এই বক্তব্যের মধ্য দিয়েই তিনি বাংলাদেশকে স্বাধীন দেশ হিসেবে পরিচিত করিয়ে দেন। সে যাই হোক, ৭ই মার্চের স্বাধীনতা সংগ্রামের ঘোষণায় পাকিস্তানি শাসকচক্র দিশেহারা হয়ে যায়। প্রতিশোধ স্পৃহা জেগে ওঠে তাদের মাঝে। আর তাই ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানি হানাদাররা শোষিত ও নির্যাতিত মানুষের স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষাকে রক্তের সমুদ্রে ভাসিয়ে দিতে শুরু করেছিল ভয়ঙ্কর নিষ্ঠুর গণহত্যা। মৃত্যু, ধ্বংস, আগুন আর আর্তনাদে বীভৎস হয়ে ওঠেছিল চারিদিক। বাঙালি জাতিকে এমন পরিস্থিতিতে শত্রুর মোকাবেলা করে বিজয় ছিনিয়ে আনার জন্য বঙ্গবন্ধু ওয়ারলেসের মাধ্যেমে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। এর পরপরই তাকে বন্দি করে পাকিস্তানে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। বঙ্গবন্ধু দূরদর্শী নেতা ছিলেন। তাই তিনি একদিকে ওয়ারলেসে স্বাধীনতার ঘোষণা রেকর্ড করে রেখেছিলেন, তেমনি একটি সরকার গঠনের পরিকল্পনাও করেছিলেন। তার সেই পরিকল্পনা অনুযায়ীই পরবর্তিতে মুজিবনগর সরকার গঠিত হয়েছিল।

আওয়ামী লীগের অন্যতম নেতা তাজউদ্দিন আহমদ ৩১ মার্চ ব্যারিস্টার আমীর উল ইসলামকে নিয়ে মেহেরপুর সীমান্ত দিয়ে ভারতে যান দেশের মানুষকে আত্মরক্ষা ও পাল্টা আক্রমণে ভারতের সাহায্য লাভের উদ্দেশে। দিল্লিতে গিয়ে তাজউদ্দিন বুঝেছিলেন কেবল আওয়ামী লীগের নেতা হিসেবে দেশের জন্য সহানুভূতি ও সমবেদনা ছাড়া তেমন কিছু তিনি আশা করতে পারেন না। ভারত সরকারের জন্য একটি প্রতিষ্ঠিত সরকারের সঙ্গে সম্পর্ক করা প্রয়োজনীয় ছিল। তাই তিনি ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে বৈঠকে বাংলাদেশের যে স্বাধীনতা ঘোষণা করা হয়েছে সেটা যেমন বলেছেন, তেমনি শেখ মুজিব‍ুর রহমানকে প্রেসিডেন্ট ও নিজেকে প্রধানমন্ত্রী রূপে পরিচয় করান। সেটাই ছিল বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকারের ধারণার সূচনা। কলকাতায় ফিরে এসে তিনি সরকার গঠনের প্রস্তুতি নেন। কিন্তু দলের অভ্যন্তর থেকেই আসতে থাকে নানারকম বাধা। সব বাধা অতিক্রম করেই ১০ এপ্রিল তাজউদ্দিন আহমদ অস্থায়ী সরকার ঘোষণা করেন। সেই ঘোষণায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে রাষ্ট্রপতি, সৈয়দ নজরুল ইসলামকে উপ-রাষ্ট্রপতি, তাজউদ্দিন নিজেকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ঘোষণা করেন। এই সরকারের মূল ভিত্তি ছিল ১৯৭০ সালের নির্বাচন। সেই নির্বাচনে বাংলাদেশের জনগণ ১৬৯টি আসনের মধ্যে আওয়ামী লীগ দলীয় ১৬৭ জন প্রতিনিধি নির্বাচিত করেছিল। কিন্তু ইয়াহিয়া সেই পরাজয় মেনে নেননি। সে যাই হোক, তাজউদ্দিন আহমদ সেই ঘোষণায় বলেছিলেন, “বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার অর্জনের আইনানুগ অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ ঢাকায় যথাযথভাবে স্বাধীনতা ঘোষণা করেন এবং বাংলাদেশের অখন্ডতা ও মর্যাদা রক্ষার জন্য বাংলাদেশের জনগণের প্রতি উদাত্ত আহ্বান জানান। ” ঐ ঘোষণা  আকাশবাণীসহ আরও কয়েকটি প্রচারমাধ্যমে তা প্রচারিত হয়েছিল। সেই ঘোষণায় কতটা আনন্দিত হয়েছিলাম তা আজও ভাষায় প্রকাশ করতে পারব না। তখন মনে হয়েছিল বারবার আমি, আমরা এখন থেকে স্বাধীন দেশের নাগরিক। বস্তুত, স্বাধীনতা যুদ্ধ পরিচালনা ও পাক হানাদার বাহিনীকে এই প্রিয় দেশ থেকে বিতাড়িত করে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঘোষিত এবং নির্দেশিত পথে মুক্তিযুদ্ধের বিজয় অর্জনের জন্য এই সরকার গঠন করা হয়েছিল।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জার্মানির সেনাবাহিনী ফ্রান্স দখল করে নিলে জেনারেল দ্য গলে লন্ডনে যেভাবে ফ্রান্সের প্রবাসী সরকার গঠন করেছিলেন, অনেকটা সেভাবেই বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে তার আদর্শের উত্তরসূরীরা কলকাতায় স্বাধীন বাংলাদেশের প্রবাসী সরকার গঠন করেছিলেন। এই সরকারের সাথে কম্বোডিয়ার প্রিন্স নরোদম সিহানুকের সরকার তুলনীয়। যার সাথে পলপটের খেমাররুজ যুক্ত ছিল। এদের সদর দপ্তর দীর্ঘকাল চীনের বেইজিংয়ে ছিল। কোনো কোনো সময় থাইল্যান্ডেও ছিল। সিহানুকের স্বাধীন কম্বোডিয়া সরকার একদিকে প্রবাসী ছিলেন অন্যদিকে দেশের বিস্তীর্ণ অঞ্চল তাদের দখলে ছিল, যেখানে তারা সরকার পরিচালনা করতেন। গণপ্রজাতন্ত্রী বালাদেশ সরকার বহুলাংশে এই সরকারের সঙ্গে তুলনীয়। সেই যাই হোক, প্রবাসী সরকার ১৪ এপ্রিল চুয়াডাঙ্গাকে রাজধানী করে সেখানে সার্বভৌম বাংলাদেশের স্বাধীনতা সনদ ঘোষণার ও স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের মন্ত্রিসভার শপথ গ্রহণের গোপন সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান বিশ্ববাসীকে দেখাতে চেয়েছিল বাঙালির স্বাধীনতা যুদ্ধ হচ্ছে ভারতের মাটিতে বসে। ইয়াহিয়ার এ প্রচার মিথ্যা প্রমাণ করতেই বাংলাদেশের মাটিতে স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানের সিদ্ধান্ত হয় ।   কিন্তু দুভার্গ্য, যে কোনোভাবেই হোক খবরটি পৌঁছে যায় পাকিস্তানি হানাদারদের কাছে।   এজন্য ১৩ এপ্রিল চুয়াডাঙ্গায় বিমান থেকে বৃষ্টির মতো বোমা বর্ষণ করে হানাদাররা। ফলে শপথ অনুষ্ঠান পিছিয়ে যায়। এবার খুবই সর্তকতার সঙ্গে শপথ অনুষ্ঠানের তারিখ ও স্থান নির্ধারণ করেন তাজউদ্দিন আহমদসহ বিশ্বস্ত কয়েকজন।

পাকিস্তানি বাহিনীর বিমান হামলার কথা বিবেচনায় রেখে বাংলাদেশের মানচিত্র দেখে সর্বোত্তম নিরাপদ একটি স্থান হিসেবে মেহেরপুরকে শপথ অনুষ্ঠানের স্থান হিসেবে তারা নির্ধারণ করেছিলেন। ভৌগোলিক সুবিধার জন্য সেখান থেকে স্বল্প সময়ে ভারতে প্রবেশ করা যাবে এবং ভারত থেকে শত্রুদের ওপর আঘাত হানাও  সহজতর হবে, এই চিন্তাই এক্ষেত্রে কাজ করেছে। ১৬ এপ্রিল পর্যন্ত কলকাতার ৮নং থিয়েটার রোডে বাংলাদেশের সরকারের অফিসের কেউ জানত না, কলকাতা থেকে শত শত মাইল দূরে বাঙালি জাতির সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ ইতিহাসের এক স্বর্ণালি অধ্যায় রচিত হতে যাচ্ছে। এই বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ এতোই কঠিন গোপনীয়তা অবলম্বন করেছেন যে, মন্ত্রিসভার অনেক সদস্যও তা ঘুণাক্ষরেও জানতে পারেনি। বাংলাদেশের অকৃত্রিম বন্ধু ইন্দিরা গান্ধীর হুকুমে ১৭ এপ্রিলের সকালে দমদম এয়ারপোর্টে গোপনে সজ্জিত হয়েছিল ভারতীয় যুদ্ধবিমান বহর। মেহেরপুর সীমান্তে ভারতীয় ভূখণ্ডে অবস্থান করছিল ভারতের সামরিক বাহিনী। মেহেরপুর আম্রকাননের দূর-দূরান্তে ঘাস-পাতা বিছানো জালের ছাউনিতে ভারতীয় বাহিনীর অ্যান্টি এয়ারক্রাফট গান মেহেরপুরের আকাশ নিরাপত্তার চাদরে মুড়িয়ে দিয়েছিল।

মেহেরপুরের অখ্যাত ভবেরপাড়া গ্রামের বৈদ্যনাথতলায় সাদামাটা পরিবেশে একটি আমবাগানে শপথ নিয়েছিল ঐতিহাসিক মুজিবনগর সরকার। শপথের দিনটি ছিল শনিবার। আমবাগানের চারিদিকে রাইফেল হাতে কড়া প্রহরায় ছিল বীর মুক্তিযোদ্ধারা। সকাল ৯টা থেকেই সেখানে নেতৃবৃন্দ ও আমন্ত্রিত অতিথিদের আগমন শুরু হয়ে গিয়েছিল। দেশি-বিদেশি প্রায় জনাপঞ্চাশেক সাংবাদিক ওই অনুষ্ঠানে এসেছিলেন। আম্রকানন লোকে লোকারণ্য হয়ে যায়। মুক্তিযোদ্ধারা শেষ মুহূর্তে খবর পেয়ে যে যেখানে ছিলেন পঙ্গপালের মতো যেন উড়ে আসতে থাকেন। আনন্দ-আবেগে উদ্বেলিত শত শত কণ্ঠের ‘জয় বাংলা’, ‘জয় বঙ্গবন্ধু’, ‘বীর বাঙালি অস্ত্র ধরো, বাংলাদেশ স্বাধীন করো’, গগন বিদারী স্লোগানে স্লোগানে আম্রকাননের আকাশ-বাতাস প্রকম্পিত হয়েছিল সেদিন। চৌকি পেতে তৈরি করা হয়েছিল শপথ মঞ্চ। মঞ্চের ওপর সাজানো ছয় খানা চেয়ার। আশেপাশের বাড়ি থেকে চৌকি , চেয়ার ও বাঁশ আনা হয়েছিল সেদিন।   উপরে শামিয়ানাও লাগানো সম্ভব হয়নি। ফলে খোলা আকাশেই মঞ্চ তৈরি করা হয়েছিল।

বেলা এগারটায় শুরু হয়েছিল শপথ অনুষ্ঠান। মঞ্চে উঠে এলেন তাজউদ্দিন আহমদ, তার পেছনে ক্যাপ্টেন সৈয়দ নজরুল ইসলাম, এম মনসুর আলী, এ এইচ এম কামরুজ্জামান, খন্দকার মোশতাক আহমদ ও জেনারেল এমএজি ওসমানী। তাদের গার্ড অব অনার দিয়েছিলেন তৎকালীন মেহেরপুরের এসডিপিও এসপি মাহবুব উদ্দিন বীরবিক্রম। অনুষ্ঠানের শুরুতেই বাংলাদেশকে ‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ’ রূপে ঘোষণা করা হয়েছিল। এরপর অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম একে একে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদ এবং স্বরাষ্ট্র, ত্রাণ ও পুর্নবাসন মন্ত্রী এ এইচ এম কামরুজ্জামান, অর্থমন্ত্রী এম মনসুর আলী,পররাষ্ট্রমন্ত্রী খন্দকার মোশতাক আহমদকে পরিচয় করিয়ে দেন। এরপর নতুন রাষ্ট্রের সশস্ত্র বাহিনীর প্রধান হিসেবে কর্নেল এমএজি ওসমানী এবং সেনাবাহিনীর চিফ অব স্টাফ পদে কর্নেল আবদুর রবের নাম ঘোষণা করেন। তারপর সেখানে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র পাঠ করেন অধ্যাপক ইউসুফ আলী। স্বাধীনতার এই ঘোষণাপত্রটিই হলো স্বাধীন বাংলাদেশের প্রধান আইনি দলিল যা আমাদের সংবিধান এবং সরকার গঠনের মূল ভিত্তি । একটি সত্য কথন হলো যে, মুজিবনগর সরকারের মন্ত্রিসভার একজন ছিলেন বির্তকিত। তিনি খন্দকার মোশতাক আহমেদ। জ্যেষ্ঠতার কারণে মুজিবনগর সরকারের প্রধান তারই হওয়া উচিত বলে মনে করতেন তিনি এবং সুযোগ বুঝে  তিনি পাকিস্তান ও সিআইএ’র হয়ে কনফেডারেশন গঠন করতে চেয়েছিলেন। খন্দকার মোশতাক কত বড় মীরজাফর আমরা জাতির জনকের হত্যার মধ্যে দিয়েই তা আরও স্পষ্ট বুঝতে পারি। সেই শপথ অনুষ্ঠানে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী দেশের স্বাধীনতা রক্ষায় সকলকে ঐক্যবদ্ধ লড়াইয়ের আহবান জানিয়েছিলেন।

শপথ গ্রহণ শেষে তাজউদ্দীন আহমদ তার বক্তব্যে বলেছিলেন, ‘আমরা যা করছি সবই মুজিবের নির্দেশে। ’ তিনি আরও বলেন, “পাকিস্তান আজ মৃত এবং অসংখ্য আদম সন্তানের লাশের তলায় তার কবর রচিত হয়েছে। সাড়ে সাত কোটি বাঙালি অজেয় মনোবল ও সাহসের মাধ্যমে স্বাধীন বাংলাদেশের জন্ম দিয়েছে এবং প্রতিদিন হাজার হাজার বাঙালি সন্তান রক্ত দিয়ে এ নতুন শিশুরাষ্ট্রকে লালিত-পালিত করছেন। স্বাধীন বাংলাদেশ আজ এক বাস্তব সত্য। ’’ তার বক্তব্য মুক্তিযোদ্ধাদের দেশের তরে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তে অনুপ্রাণিত করেছিল। এই শপথ অনুষ্ঠানে নতুন সরকারের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী দু’জনই বিশ্ববাসীর কাছে নতুন রাষ্ট্রের কূটনৈতিক স্বীকৃতি দান ও সামরিক সাহায্যের আবেদন জানিয়েছিলেন। এই শপথ অনুষ্ঠানটি বাঙালিদের নতুন করে বাঁচার স্বপ্ন যুগিয়েছিল। শত্রুর বিরুদ্ধে অস্ত্রহাতে লড়াইয়ে উজ্জীবিত হয়েছিলেন আমাদের বীর সৈনিকরা।

মুজিবনগর সরকার আত্মপ্রকাশের পরপরই হানাদার বাহিনী মেহেরপুর মহকুমা এলাকা দখল নিতে মরিয়া হয়ে ওঠে। বেশ কয়েকবার তারা ইপিআর ক্যাম্প দখলে নেওয়ার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়। অতিরিক্ত ঝুঁকির কারণে মুজিবনগর প্রশাসন সুবিধামতো মুক্তাঞ্চলে চলে যায়। পরে নিরাপত্তাজনিত কারণে ভারতের কলকাতা থেকে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করে প্রবাসী সরকার। এই প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার ছিল মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম প্রতীক। এই প্রবাসী সরকার অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধ, রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড, কূটনৈতিক প্রচার, বিশ্ব জনমত গঠন এবং এক কোটি উদ্বাস্তুর পুর্নবাসন কার্যক্রম সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা করে। সীমিত সামর্থ্য নিয়ে মুজিবনগর সরকার যে দক্ষতার সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধ ও প্রশাসন পরিচালনা করেছিল, তা যে কোনো সরকারের ক্ষেত্রে অবশ্যই অনুসরণীয়। তীব্র প্রতিকূলতার মধ্যে এই সরকার অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব, এক কোটির ওপর শরণার্থীর জন্য ত্রাণ ব্যবস্থা, দেশের অভ্যন্তর থেকে লক্ষ লক্ষ মুক্তিপাগল ছাত্র-জনতা যুবাদের প্রশিক্ষণ দিয়ে গেরিলা বাহিনী গঠন করে পাকিস্তানিদের মাঝে ত্রাসের সৃষ্টি, স্বাধীন বাংলা বেতারের মাধ্যমে জনগণকে উদ্বুদ্ধ রাখা এবংবিশ্বজনমত গঠনসহ বিভিন্ন অবিস্মরণীয় কীর্তি সম্পন্ন করে, যা সমকালীন ইতিহাসের বিচারে অতুলনীয়।

১০ এপ্রিল মুজিবনগর সরকার গঠন এবং ১৭ এপ্রিল এ সরকারের শপথগ্রহণ ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ । যুদ্ধের ওপরে এর প্রভাব ছিল সুদূরপ্রসারী। জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের নিয়ে গঠিত এই সরকার ছিল সর্ম্পূণ বৈধ একটি সরকার। মুজিবনগর সরকার গঠিত না হলে জনগণ যতই প্রশংসা করুক না কেন, আমরা আন্তর্জাতিকভাবে বিচ্ছিন্নতাবাদী অথবা বিদ্রোহী হয়ে পড়তাম। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার জন্য মুক্তিবাহিনী সংগঠন ও সমন্বয়, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সমর্থন আদায় এবং এই যুদ্ধে প্রত্যক্ষ সহায়তাকারী রাষ্ট্র ভারতের সরকার ও সেনাবাহিনীর সঙ্গে সাংগঠনিক সম্পর্ক রক্ষায় এই সরকারের ভূমিকা ছিল অপরিসীম।

এই সরকারের সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য ছিল, তারা জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আর্দশ, ইচ্ছা থেকে বিন্দুমাত্র টলেনি,কেবল খন্দকার মোশতাক ছাড়া। বঙ্গবন্ধু মুক্তিযুদ্ধের নয় মাস পাকিস্তানে বন্দি থাকলেও তার নামেই যুদ্ধ পরিচালিত হয়েছে। যুদ্ধের নয় মাস মুক্তিযোদ্ধাদের প্রাণে প্রাণে, রণাঙ্গনের রণে রণে, ধ্বনিত, প্রতিধ্বনিত হয়েছে বঙ্গবন্ধুর বজ্র কণ্ঠের সেই ঘোষণা,‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’। তার নির্দেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করে মুজিবনগর সরকার মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করেছে । তাদের দক্ষ নেতৃত্বগুণেই মুক্তিযোদ্ধারা শেখ মুজিবুর রহমানের চেতনা ও আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে ঐক্যবদ্ধ থেকে ‘জয় বাংলা, ‘জয় বঙ্গবন্ধু’ রণধ্বনি কণ্ঠে তুলে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন হানাদার বধে। রণাঙ্গনে হাসিমুখে তারা গেয়েছেন জীবনের জয়গান। ছিনিয়ে এনেছেন বিজয়ের সেই লাল সবুজ পতাকা।

কিন্তু সেই বিজয়ের পতাকাকে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট কলঙ্কিত করছিল খন্দকার মোশতাকসহ লোভী-তাপী, পথভ্রষ্ট কিছু নরপিশাচ। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশটি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর দক্ষ নেতৃত্ব ও পরিচালনায় যখন মাথা তুলে দাঁড়াচ্ছিল, তখন সেই নরপিশাচের দল আমাদের পিতাকে নির্মম-নিষ্ঠুরভাবে সপরিবারে হত্যা করে। সেই হত্যাকাণ্ডটি পৃথিবীর ইতিহাসে সবচেয়ে দুঃখজনক হত্যাকাণ্ড। যার ওপর ভর করে ওই পিশাচের দল স্বাধীন দেশে শান্তির নিঃশ্বাস নিতে পারছিল, তাকেই তারা হত্যা করলো বিবেকহীন নরখাদকের মতো। সেই মহাদুর্ভাগ্যজনক ঘটনার পর থেকেই এদেশের প্রগতির রথযাত্রা পেছনের দিকে যেতে থাকে। পাকিস্তানি ভাবধারায় বিশ্বাসী গোষ্ঠীর চক্রান্তে দেশে সৃষ্টি হয় মাৎস্যোন্যায়। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর সুযোগ্য কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রগতির স্থবির হয়ে পড়া রথযাত্রাকে আবারও সামনের দিকে নিয়ে যাচ্ছেন। মাৎস্যোন্যায়কে প্রতিহত করে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন শান্তি ও সমৃদ্ধির সোপানে।



লেখক:
সিনেট ও সিন্ডিকেট সদস্য, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
সাবেক সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ ছাত্রলীগ

 

বাংলাদেশ সময়: ০৯৩৯ ঘণ্টা, এপ্রিল ১৭, ২০১৬
আইএ/এইচএ/

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।