ঢাকা, বুধবার, ২৮ কার্তিক ১৪৩১, ১৩ নভেম্বর ২০২৪, ১১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

মুক্তমত

মওদুদের বস্ত্র হারানোর ভয়!

ফজলুল বারী, কন্ট্রিবিউটিং এডিটর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৫১৫ ঘণ্টা, আগস্ট ১৮, ২০১১
মওদুদের বস্ত্র হারানোর ভয়!

বঙ্গবন্ধুকে ওপরে তথা মাথায় তোলায় বিপদে পড়েছেন ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ। তার চাকরি একরকম যায় যায় অবস্থা! এর মধ্যে তাকে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করা হয়েছে বগুড়ার গাবতলীতে।

নিজের কোম্পানিগঞ্জে হেরে সবশেষ খালেদা জিয়ার ছেড়ে দেওয়া ওই আসন থেকে জিতে এমপিত্ব বজায়-বহাল রেখেছেন মওদুদ। তার বিরুদ্ধে সংবাদ সম্মেলন করেছেন দলের দফতর সম্পাদক রিজভী আহমেদ। আরেক নেতা ঢাকার কোনো সভা-সমাবেশে সামনা-সামনি পেলে তাকে শারীরিকভাবে লাঞ্ছনারও হুমকি দিয়েছেন! এটা মওদুদ সাহেবের জন্য খুবই কঠিন-সিরিয়াস একটা অবস্থা আর কি!
 
বিপদের কারণটা বঙ্গবন্ধু! যিনি আমাদের জাতির পিতা। যিনি দেশে-বিদেশে  বাঙ্গালির আত্মপরিচয়ের উড্ডীন ঝাণ্ডা। অন্যদিকে বিএনপির রাজনৈতিক নীচতা-হীনমন্যতা! ১৫ আগস্ট এটিএন টিভি চ্যানেলের সঙ্গে সাক্ষাৎকারে মওদুদ আহমদ বলেছেন, ‘বঙ্গবন্ধুর অবস্থান জিয়ার চেয়ে অনেক ওপরে। সবার ওপরে। ইতিহাসের যার যে অবস্থান তা তাকে দেওয়া উচিত। ’ ব্যাস! আর যায় কোথায়! তিনি এর মধ্যে শারীরিক লাঞ্ছনার হুমকিপ্রাপ্ত! আমাদের দেশের পলিটিক্স, পলিটিশিয়ানদের শারীরিক লাঞ্ছনার হুমকি মানে, গায়ে হাততোলা, চড়-থাপ্পর, জুতোর স্পর্শ, অথবা বস্ত্রহরণ। আরেকটু ডাইরেক্ট বললে দিগম্বর!

এই বুড়ো বয়সে রোজা-রমজানের দিনে নিজের শেষ আশ্রয় বিএনপির ভেতর থেকে বস্ত্র হারানোর এমন একটা হুমকি! নিরাপত্তার অভাবের কারণে খালেদা জিয়ার জন্মদিনের নামে কেক কাটার অনুষ্ঠানে তিনি ছিলেন না। প্রতিদিন যে দেশ আর সংবিধান রক্ষায় নানান খুচরো সংগঠনের মঞ্চে তার প্রধান অতিথি হওয়ার অভ্যাস, তাও বন্ধ!

কিন্তু অবস্থা যেন সুবিধার মনে হচ্ছে না। রিজভী আহমদ প্রেস কনফারেন্স করেছেন মানে বলা চলে খালেদা জিয়ার ইচ্ছায় তা করেছেন। খবর বেরিয়েছে, এমন একটি মন্তব্য করায় খোদ খালেদা জিয়াও ক্ষেপেছেন মওদুদের ওপরে। তাই যদি হয় আসলেই বিপদ। এই বয়সে যাবেন কোথায় ব্যারিস্টার সাহেব? খুব তাড়াতাড়ি কোনো সামরিক অভ্যুত্থানের আশংকা বা সম্ভাবনাও দেখা যাচ্ছে না যে!
 
মওদুদ আহমদকে যারা চেনেন, তারা জানেন মুশকিল আসানের একটা ব্যবস্থা তিনি করে ফেলবেন। তার মতো কুশীলব কেন এখনও তাতে কামিয়াব হননি বা হতে পারছেন না, সেটিও একটি প্রশ্ন বটে! এমনিতে সবাই জানবেন বা মানবেন তাহলো মওদুদ সাহেব গায়ে পড়ে ওই কথা বলতে যাননি। পনের আগস্ট জাতীয় শোক দিবস উপলক্ষে সবাই চেয়েছিল একটা কিছু স্পেশাল বা এক্সক্লুসিভ রিপোর্ট।
 
মওদুদ আহমদও তেমন একজন রিপোর্টারের সওদা হয়েছেন। ক্যামেরা দেখলে তিনি আবার না করতে বা লোভ সামলাতে পারেন না! ক্যামেরার সামনে মুখ ফসকে সত্য কথাটি তার মুখ থেকে বেরিয়ে এসেছে। বিএনপি যে জাতের দল, সেখানে থেকে বা সে জাতের দলের নেতা হিসেবে তিনি তা বলতে পারেন না।

যদিও মুক্তিযুদ্ধের আগে তার শুরুটা অতটা আজকের মতো বিতর্কে মোড়ানো ছিল না। ব্যারিস্টার আমির উল ইসলামের জুনিয়র হিসেবে আইন-পেশা শুরু করেন মওদুদ। পল্লীকবি জসিম উদ্দিনের মেয়ের জামাই হন। জসিমউদ্দিন ছিলেন বঙ্গবন্ধুর বন্ধু। তাই তার মেয়ের জামাই হিসেবে বঙ্গবন্ধুর সেক্রেটারিয়েল দায়িত্বও পান। আবার বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর সন্দেহজনক তৎপরতা-সম্পর্কে গোয়েন্দা রিপোর্টের ভিত্তিতে গ্রেফতার হলে জসিমউদ্দীনের অনুরোধে তাকে ছাড়ানোর ব্যবস্থা করেন বঙ্গবন্ধু। সেই মওদুদের বাকি জীবনটা কি ছিল বঙ্গবন্ধুর প্রতি অকৃতজ্ঞতার? না কৃতজ্ঞতার?
 
বাংলাদেশের রাজনীতিতেও মওদুদ চরিত্রটি ফুলের মতো পবিত্র না। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের বেনিফেশিয়ারি বাংলাদেশের দীর্ঘ মেয়াদি দুই সামরিক জান্তার সঙ্গী ছিলেন তিনি। বাংলাদেশের সাংবিধানিক আবর্জনা শাসনতন্ত্রের পঞ্চম ও সপ্তম সংশোধনীর সঙ্গেও ছিলেন চিহ্নিত এই ব্যারিস্টার।
 
ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম করা থেকে শুরু করে ধর্মের নামে যত দুই নম্বরী, সাঈদাবাদের পীরের প্রতারণার জ্যোতি হিমেল পাউডারের মডেল হওয়া থেকে শুরু করে সব আকাম-কুকামের সঙ্গেই তিনি ছিলেন।

জিয়া হত্যার পর খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে এরশাদ বিরোধী আন্দোলন শুরু করেন, আবার খালেদাকে ফেলে চলে যেতেও তার সময় লাগেনি।  

এরশাদের শিল্পমন্ত্রী থেকে তার শ্রেষ্ঠ অবদান (!), ঢাকা শহরের মিশুক! স্বৈরাচারের চামচামির প্রতিযোগিতায় কাজী জাফর, শাহ মোয়াজ্জেমদের পেছনে ফেলে এরশাদ সরকারের উপরাষ্ট্রপতিও হয়েছেন। গণঅভ্যুত্থানে এরশাদ যখন পালাচ্ছে তখনও টেলিভিশনে সংবিধানকে সমুন্নত রাখার বয়ান চালিয়ে যাচ্ছিলেন। কিন্তু যখন বুঝতে পারেন এরশাদ আর নেই, তখন নিজেও পগারপার হন।

নব্বইয়ের সেই ৪ ডিসেম্বর ঢাকা শহরে ঘটে যাওয়া গণহত্যার রাতে পাবলিক এই মওদুদ আহমদকে অনেকে খুঁজেছে। ‘তাহাকে সেই রাতে পাইলে তাহার শরীর মুবারকের কি ঘটিত তাহা আল্লাহ রাব্বুল আল আমিন ছাড়া কেহ জানেন না!’

১৯৯১ সালে খালেদা জিয়া ক্ষমতায় গেলে সেই মওদুদ আহমদ আবার শেখ হাসিনার নেতৃত্বে খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে আন্দোলন করেন। ১৯৯৬ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে ইলেকশনে হেরে গেলে আবার গিয়ে যোগ দেন বিএনপিতে।
 
এরপর আর দলবদল করেননি মওদুদ। অথবা সুযোগ পাননি! ২০০১-২০০৬ মেয়াদের ক্ষমতার সময়ে ছিলেন খালেদা জিয়া সরকারের দাপুটে আইনমন্ত্রী! বঙ্গবন্ধুর খুনিদের ফাঁসি ঠেকিয়ে রাখা থেকে শুরু করে খালেদা জিয়াকে খুশি রাখার যা যা দরকার সব তিনি করেছেন।
 
এসব কারণে অনেকে তাকে ‘বাংলাদেশের রাজনৈতিক বে...’ জাতীয় খারাপ কথাও বলেন। অনেকের মতে খালেদা-তারেককে খুশি করতে বিচারপতিদের বয়স বৃদ্ধির মাধ্যমে বিচারপতি কেএম হাসানকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারপ্রধান করার ষড়যন্ত্র তত্ত্বটিও তার। কিন্তু ষড়যন্ত্রের এ ডোজটি বদহজম হয়ে যাওয়াতে আম-ছালা দুটিই গেছে বিএনপির।

তত্ত্বাবধায়ক সরকার সবার চোখে আঙুল দিয়ে মনে করিয়ে গেছে, গুলশানের বিশাল বাড়িটা মওদুদের না। ওটা তার দখল করা বাড়ি!
 
শেখ হাসিনা ক্ষমতায় আসার পর খালেদা জিয়ার সেনানিবাসের বাড়ি হারানোর আইনগত জটিলতার জন্যেও মওদুদ আহমদকে দায়ী করা হয়।
 
মওদুদের গুণের দিক হলো- বাংলাদেশের যে গুটিকয়েক রাজনীতিকের লেখালেখির সামর্থ্য-অভ্যাস আছে তিনি তাদের একজন। তার সব ক`টি বই দেশের বনেদি প্রকাশনা সংস্থা (ইউপিএল (ইউনিভার্সিটি প্রেস লিঃ) থেকে বেরিয়েছে। নিজেকে বাঁচিয়ে মাঝে মাঝে অনেক সত্য কথনও বেরিয়ে এসেছে তার লেখায়। এবার বঙ্গবন্ধু ইস্যুতে তিনি যা বলেছেন, আগেও কায়দা করে বলেছেন তার লিখায়। এভাবে এতটা সরাসরি বলেননি।

বঙ্গবন্ধুকে কখনো তার নিচে নামানোর ধৃষ্ট চেষ্টাটি করেননি জিয়াউর রহমানও। তাহলে বঙ্গবন্ধুকে ওপরে তুললে কেন গোস্বা হবেন খালেদা জিয়া? অথবা মওদুদের কাপড় খোলারও হুমকি দেবে বিএনপির কোনো একজন তৃতীয় বা চতুর্থ সারির নেতা? এ প্রশ্নতো মওদুদ আহমদেরই খুঁজে বের করতে হবে, তাই নয় কি?  কারণ এই দলটির নেতা-কর্মীদের এভাবেইতো তারা তৈরি করেছেন। বাংলাদেশের জাতির পিতা তারা মানেন না, জাতির পিতা নিহত হওয়ার দিনে খুশি-ফুর্তির উৎসব করেন!

বিএনপির তরুণ প্রজন্মের সঙ্গে কথা বললে মনে হবে বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনে কোনও ভূমিকাই ছিল না বঙ্গবন্ধুর। উনি পাকিস্তানিদের হাতে বন্দী ছিলেন অথবা আত্মসমর্পণ করেছেন, আরেকদল দেশ স্বাধীন করে ফেলেছেন! এমনিতো তাদের শেখানো হয়েছে তাই নয় কি? এই কিছুদিন আগেই না মুক্তিযুদ্ধের সময় মুজিব পরিবারের পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে বন্দী থাকার বিষয়টি নিয়ে উপহাস করেছেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর!
 
যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে কেন নিজেদের বিচার হয়ে যাচ্ছে মনে করেন এই দলের একশ্রেণীর নেতা-কর্মী? তাদের এমন করে কে-কারা গড়ে তুলেছে? মুক্তিযুদ্ধবিরোধী জামায়াত-শিবিরকে পাশে বসিয়ে তারা দেশের মানুষকে বলবেন- শেখাবেন মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত ইতিহাস? আজ বঙ্গবন্ধুর কথা মুখে নিয়ে বিপদে পড়েছেন বিএনপিরই প্রতিষ্ঠাকালীন এক সিনিয়র নেতা! আগামীতে মুক্তিযুদ্ধের নাম মুখে আনলে বিএনপির বাদবাকি মুক্তিযোদ্ধা নেতাদেরই কি হামলে-খাবলে ধরবে না এই অপরাজনীতির ছাত্ররা। এরা এখনই বলে, বাংলাদেশ যে আজও পিছিয়ে আছে বা এগুতে পারছে না, এর বড় কারণ নাকি মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক অতীত দিনের বস্তাপচা আলোচনা! অগ্রগতির আলোচনা সব কি শুধু সিঙ্গাপুরের ব্যাংক?  

লেখক : সিডনিপ্রবাসী সাংবাদিক

বাংলাদেশ সময়: ১৫০০ ঘণ্টা,  আগস্ট ১৮, ২০১১

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।