ঢাকা, বুধবার, ২৮ কার্তিক ১৪৩১, ১৩ নভেম্বর ২০২৪, ১১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

মুক্তমত

শুনলেন না শেখ হাসিনা

ফজলুল বারী, কন্ট্রিবিউটিং এডিটর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৫০১ ঘণ্টা, আগস্ট ২৭, ২০১১
শুনলেন না শেখ হাসিনা

শেখ হাসিনা শুনলেন না। সাফ বলে দিয়েছেন, এখন কারো কথা শুনবেন না তিনি।

অর্থাৎ আবুলগং সহ দেশ-কেবিনেট যেভাবে আছে সেভাবেই চলবে। কারণ তিনি মনে করেন দেশ ভালো চলছে! সরকার-মন্ত্রীরা ভালো কাজ করছে!  অর্থাৎ তিনিই পরীক্ষার্থী-পরীক্ষক সব!
 
অতএব আর দেশ-সরকারের পরিস্থিতি নিয়ে আমজনতার কথাবার্তা বলার অরণ্যে রোদনের হা-হুতাশ করার আর কী দরকার? মানুষের কথাগুলো শুনলে ভালো হতো না? এই মানুষজন কী তার শুভাকাঙ্খী ভোটার মানুষ না?
 
ফেইসবুকসহ সামাজিক যোগাযোগের কয়েকটি নেটওয়ার্কে দেখলাম ‘সেই নাগরিক ক’জনা’র আহবানের সমর্থনে শহীদ মিনারে ঈদ উদযাপনের জোর ক্যাম্পেইন চলছে।
 
সত্যি কি তা ঘটবে শহীদ মিনারে? না পুলিশ আগে থেকে দখল-অবরুদ্ধ করে রাখবে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার! কাউকে সেখানকার ত্রি-সীমানায় ঢুকতে দেবে না! অথবা কী সেখানে হামলা-তাণ্ডব চালাবে ছাত্রলীগ নামধারী কোন ষণ্ডা কিসিমের গ্রুপ! অথবা পরিবহন শ্রমিক নামধারী গণবিরোধী মস্তান মন্ত্রী শাজাহান খানের পেটোয়া বাহিনী! শহীদ মিনারে ঈদ! শান্তিপূর্ণ অথবা তাণ্ডবের? খাসা নজিরবিহীন কিছু ছবি তৈরি করবে!
 
অথবা এসবের কিছুই হবে না! কারণ ঈদের ছুটিতে এমনিতে ফাঁকা ফাঁকা থাকবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস। আল্লাহর কাছে সবাই সেই দোয়াই করুন। যাতে তেমন কিছুই না হয়। কারণ ব্যর্থ চিহ্নিত যোগাযোগমন্ত্রী আবুলের পদচ্যুতির দাবিতে শহীদ মিনারে যারা কর্মসূচি দিয়েছেন তারা সবাই মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের মানুষ। তাদের ওপর পুলিশের লাঠির বাড়ি পড়লে তা কিন্তু আমাদের সবার গায়েও গিয়ে পড়বে। আরও বিভক্ত হবে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের মানুষ।
 
যেমন তেল গ্যাস, আদিবাসী, সংবিধান সংশোধন ইস্যু মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তিকে এরমাঝে বিভক্ত করে ফেলেছে। তেল গ্যাস ইস্যুতে ঢাকায় যারা হরতাল করেছে পুলিশ বেধড়ক পিটিয়েছে যাদের হাড়গোড় ভেঙ্গে দিয়েছে তারা সবাই মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের মানুষ। সংখ্যায় কম দেখা গেছে! তলে তলে একটা জরিপ চালালে আসলে জানা যেত জনমতের আসল শক্তি।
 
আদিবাসী ইস্যুটির চলতি সঙ্কট সৃষ্টির পর এরমাঝে স্ব স্ব এলাকার আদিবাসী মূলধারা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছেন প্রমোদ মানকিনসহ পাহাড়ের অপর তিন এমপি। শারীরিক লাঞ্ছনার ভয়ে আদিবাসীদের কোন সামাজিক অনুষ্ঠানেও তারা আর যোগ দিতে পারেন না।

অর্থাৎ নেক্সট ইলেকশনে নিশ্চিত হারছেন এরা। অথবা ওই সব এলাকার ভোট আওয়ামী লীগ আর দরকারি মনে করছে না! আদিবাসী ইস্যু আওয়ামী লীগ সমর্থক নাগরিক-সুশীল সমাজ-সাংস্কৃতিক সংগঠনসমূহের নেতা-কর্মীদেরও বিভক্ত-বিরক্ত করে ফেলেছে।
 
আমিনীদের খুশি করতে সংবিধানে বিসমিল্লাহ আর রাষ্ট্রধর্ম বহাল রেখে ঘরের অধ্যাপক কবীর চৌধুরীদের অসন্তুষ্ট অপাংক্তেয় করে কী লাভ হয়েছে? আওয়ামী লীগের পক্ষে কী বিএনপির ব্রান্ড আমিনীদের খুশি করা বা রাখা সম্ভব? অর্পিত সম্পত্তি ইস্যুতে চলতি সরকারি বিল পাশ হলে দেশের হিন্দু সম্প্রদায় আর সঙ্গে থাকবে না বলে দিয়েছেন আওয়ামী লীগ নেতা সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত।
 
চিটাগাং’এর মেয়র ইলেকশনেও দেখা গেছে হিন্দু সম্প্রদায় আর আগের মতো আওয়ামী লীগের পক্ষে এক চেটিয়া নেই। চা শ্রমিকরা মুখ ঘুরিয়ে নিতে শুরু করায় গত ইউপি-পৌরসভা ইলেকশনে বৃহত্তর সিলেট অঞ্চলে আওয়ামী লীগ বিপুল হেরেছে। অথচ বঙ্গবন্ধুর জমানা থেকে চা শ্রমিকরা ছিলে আওয়ামী লীগের ভোটব্যাংক। বঙ্গবন্ধু তাদের ভোটাধিকার আদায় করেন।

শেয়ার মার্কেটে ফতুর লোকজনের পরিবার কী আর নেক্সট ইলেকশনে আওয়ামী লীগকে ভোট দেবে? বাজার পরিস্থিতিতে নাকাল লোকজন? নিত্য ভোগ্যপণ্যের কোনটি আমজনতার ক্রয়সীমার মধ্যে? জিনিসপত্রের দাম নিয়ে কতটি পোস্টার হবে নেক্সট ইলেকশনে? এর কোন জবাব দেবার মুখ আর আছে কী?

যেদেশে বছরে ২২-৩০ হাজার লোকজন শুধু সড়ক দূর্ঘটনায়  মারা যায়, সে সব ভিকটিম পরিবারগুলোকে উপহাস করে বেহায়া-বেশরমের মতো মন্ত্রীরা কান্ডজ্ঞানহীন-বোধ-বিবেকহীনের মতো ‘ঠিক আছে ঠিক আছে’ বলে চিল্লান, বিপক্ষের লোকজনের বিরুদ্ধে লেলিয়ে দেন মস্তান, এসবকে কী ভালো কাজ-ভালো চলা বলা চলে?
 
ব্যর্থ মন্ত্রীদের বিষয়ে আলোচনা-সমালোচনা করা হয়েছিল সংসদে। সরকার নিজে সারাদিন সংসদকে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু করতে বলে আর ওখানকার কারো কথা পছন্দ না হলে সবাইকে খামোশ করে দেয়! অতএব তোফায়েল-সুরঞ্জিত-কাদের-ইনু-মেনন-তারানা সব এরমাঝে খামোশ! কারো মুখে আর কোন রা’ নেই!
 
বরঞ্চ এমন গরম কথাবার্তায় ভবিষ্যত মন্ত্রিত্বের সম্ভাবনা ফিকে হয়ে যাবার ডরে থরথর সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত মাঝে জোশে বলেছেন, ‘যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের চাইতে বেশি গুরুত্বপূর্ণ গ্রেনেড হামলার বিচার’! পাওয়ারের লোভে যদি মুক্তিযুদ্ধ কারো কাছে সেকেন্ডারি হয়ে যায়, বিএনপির লোকজনের সঙ্গে তাদের পার্থক্য কোথায়?
 
এরআগে একবার নাজুক আইনশৃংখলা পরিস্থিতির কথা বলতে গিয়ে খামোশ বনেছেন সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম। মাঝে কিছুদিন তিনি কোন ফ্লোর পাচ্ছিলেন না। আওয়ামী লীগ-বিএনপির নানান খুচরো সংগঠনগুলো আবার কার সঙ্গে নেত্রী বা ম্যাডামের সম্পর্ক ভালো না খারাপ এসব দেখে দেখে ফ্লোর দেয়! মোহাম্মদ নাসিম আবার ফ্লোর ফেরত পেয়ে বলেছেন সরকারের কোন সমালোচনা থাকলে তা দলীয় ফোরামে আলোচনা করা ভালো! দেশের মানুষ যা বাইরে আলোচনা করছে তা নিয়ে পার্লামেন্টে আলোচনা হবে না? তা সবকিছুতে যদি সারাদিন আহা বেশ বেশ, রাস্তাঘাতের অবস্থা বেশ, জিনিসপত্রের দাম বেশ, আইন-শৃংখলা সব বেশ-মহা বেশ বলার জন্যে যদি পার্লামেন্ট রাখতে হয়, তাহলে সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট হাফেজ আল আসাদের পার্লামেন্টের সঙ্গে বাংলাদেশের পার্লামেন্টের পার্থক্য কোথায়?
 
এমন দলীয়-মহাজোটীয় মন্ত্রী-এমপির খামোশ অবস্থার মুখে হঠাৎ অন্য কথা বললেন উপদেষ্টাদের একজন! প্রধানমন্ত্রীর স্বাস্থ্য, পরিবার কল্যাণ ও সমাজ কল্যাণ বিষয়ক উপদেষ্টা অধ্যাপক ডা. সৈয়দ মোদাচ্ছের আলী বৃহস্পতিবার ঢাকায় এক অনুষ্ঠানে বলেছেন, ‘দারোয়ানের কাজ যেমন মালিকককে রক্ষা করা তেমনি মন্ত্রী ও সংসদ সদস্যদের কাজ জনগণকে রক্ষা করে। জনগণই আমাদের মালিক। জনগণের কথা মতোই সরকারকে চলতে হবে। ’

উপদেষ্টা মোদাচ্ছের বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জনগণের জন্যে যে পরিমান কাজ করেছেন, মন্ত্রী বা সংসদ সদস্যদের কেউ তার ৬০ ভাগও করেনি। যদি কেউ বলতে পারে- আমি করেছি, তাহলে আমি তার অধীনে কাজ  করবো। ’

যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেনের দিকে ইঙ্গিত করে তিনি বলেন, ‘এখন রাস্তা সংস্কারের ব্যাপারে বলা হচ্ছে বৃষ্টির কারণে সমস্যা। তাহলে প্রশ্ন থাকবে বৃষ্টির আগে কোথায় ছিলেন? এছাড়া এসব রাস্তার ব্যাপারে দেখতে হবে এ রাস্তাগুলো কোন ঠিকাদার দিয়ে করা হয়েছিল। ’

তিনি বলেন, ‘অনেকে সাংবাদিকদের প্রথমে এক ধরনের কথা বলে পরে আবার অস্বীকার করেন। তখন দুর্বলতা আরও বেশি বোঝা যায়। তখন বলা হয়, সাংবাদিকরা ভুল ব্যাখা দিচ্ছে। আসলে সাংবাদিকদের সঙ্গেও আমাদের ভেবেচিন্তে কথা বলতে হবে। ’

চমকে যাবার মতো কথা বৈকি! তা উপদেষ্টা এসব কথা বলেছেন বৃহস্পতিবার পার্লামেন্টে আর দলীয় সাংবাদিক ফোরামে প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের আগে না পরে? ওই দুই অডিয়েন্সে প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য শোনার পর উপদেষ্টার বক্তব্যের ধারাটি বহাল থাকবে কী? আমাদের উপদেষ্টারাতো আবার নিয়োগকর্তার কথাবার্তার ধারা মতিগতি দেখে উপদেশ দেন! শেখ হাসিনার এই উপদেষ্টা অবশ্য অন্য অনেকের মতো ক্ষমতার গন্ধে নাজিল হননি। অনেকদিন ধরে শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত চিকিৎসক। ডাক্তারির পাশাপাশি লেখালেখি করেন। অনেক আগে ঢাকা মেডিক্যালে  নিজের চেম্বারে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ছবি টাঙ্গানোকে কেন্দ্র করে বিএনপির আক্রোশের মুখে পড়েন। এরপর বিএনপি ক্ষমতায় ফিরলে দেশান্তরী থাকতে হয় ভারতে। মিডিয়ার লোকজনের সঙ্গেও তাঁর ভালো সম্পর্ক।

কিন্তু বৃহস্পতিবার (২৫-০৮-২০১১) উপদেষ্টা  অধ্যাপক ডা. সৈয়দ মোদাচ্ছের আলীর উপদেশের দিনেই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলে দিয়েছেন, মন্ত্রিসভার কোনো রদবদল হচ্ছে না। ‘মন্ত্রীরা তো ভালো কাজই করছেন। তারা কাজ করে যাচ্ছেন। ’ বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়ন ও ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের যৌথ ইফতার অনুষ্ঠানে শেখ হাসিনা বলেন, ‘এমন কোনো সমালোচনা করবেন না, যাতে এই সরকার দুবর্ল হয়। প্রতিপক্ষ সেই সুযোগ নিতে পারে। `

তা মন্ত্রী আবুল, ফারুক, শাহজাহান খান এদের কাজকর্ম যদি ভালো’র মডেল হয় তাহলে দেশের রাস্তাঘাটের এ অবস্থা কেন? কেন ঈদের আগে এভাবে জরুরি মেরামতের জন্য প্রধানমন্ত্রীকে উদ্যোগী হয়ে বাড়তি ৬৯০ কোটি টাকা ব্যবস্থা করতে হয়েছে?
প্রধানমন্ত্রী বললেন, উনি বলার পরই ময়মনসিংহ চলে গেছেন মন্ত্রী আবুল! প্রধানমন্ত্রী বললে উনি কোথাও যান। না বললে যান না! বাহ! বানিজ্যমন্ত্রী ঘুরে ঘুরে জিনিসপত্রের দাম বাড়ান বাজারের? অর্থমন্ত্রী কথা বলে বলে দরপতনের টর্নেডো শেয়ার বাজারে। দেশের পরিবহন সেক্টরকে ভোটার জনগণের বিরুদ্ধে দাঁড় করান, বেপরোয়া করে তোলেন নৌমন্ত্রী শাহজাহান খান! এদের ব্যাপারে মানুষের মনের কথাগুলো শুনলে ভালো করতেন প্রধানমন্ত্রী।

মানুষের পক্ষে থাকলে শত্রু শক্তিশালী হতে পারে না। মানুষের বিপক্ষে চলে যাওয়া মন্ত্রীদের আঁকড়ে থাকা সন্দেহের সৃষ্টি করতে পারে। সে সন্দেহের চোরাপথে শক্তি বাড়াতে পারে শত্রুপক্ষ। শেখ হাসিনার উপদেষ্টাদের বলছি, মানুষের মনের কথাগুলো নেত্রীকে একটু শোনানোর চেষ্টা করুন। নতুবা ঠিকমতো উপদেশ দিতে না পারার দায়টা কিন্তু ঘাড় ছুঁয়ে যেতে পারে একদিন।

ফজলুল বারীঃ সিডনি প্রবাসী সাংবাদিক।

বাংলাদেশ সময় ১৪৫৩ ঘণ্টা, আগস্ট ২৭, ২০১১

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।