ঢাকা, শুক্রবার, ১২ পৌষ ১৪৩১, ২৭ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৪ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

মুক্তমত

৬৬তম একুশের ভাবনা

আমরা কি তোমাদের ভুলে গিয়েছি?

এরশাদুল আলম প্রিন্স, ল’ এডিটর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৩৪৯ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২১, ২০১৭
আমরা কি তোমাদের ভুলে গিয়েছি? অমর একুশে / ছবি: দীপু মালাকার

স্মৃতি সতত সুখের, সতত বেদনার। কখনও তা অহংকারের কখনও তা গ্লানির। তবু স্মৃতি ফিরে আসে বারবার আমাদের জীবনে- কখনও ব্যক্তির, কখনও-বা জাতির।

আমাদের জীবনে ফিরে আসে একাত্তর, ফিরে আসে বায়ান্ন, ফিরে আসে একুশ। আজও এসেছে, আসবে আগামীতেও।

কিন্তু কতোটা স্মৃতি নিয়ে ফিরে আসে একুশ? নাকি প্রতিনিয়তই কিছু স্মৃতি হারিয়ে যায় মহাকালের গর্ভে?

সব ঘটনাই ইতিহাস নয়, কিছু কিছু ইতিহাস। তাই প্রশ্ন আসে চর্চার। ব্যক্তির জীবনে স্মৃতি চর্চার প্রয়োজনীয়তা নেই। যা মনে আসার তা এমনিতেই আসবে। না আসুক তাতেও ক্ষতি নেই। জীবন তো আর স্মৃতির পথে হাটে না। সে পথ চলে ভবিষ্যতের পথে। কিন্তু জাতির জীবনে ইতিহাস চর্চার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। কারণ, একটি জাতির ভবিষ্যতের পথ রচিত হয় অতীতের পথ ধরে। যে জাতির অতীত গৌরবের তার ভবিষ্যতও গৌরবের; যদি বিভ্রান্ত পথভ্রষ্ট না হয়। একইভাবে যে জাতির অতীত গ্লানির, তার ভবিষ্যতও গ্লানিময় হবে; যদি অতীত থেকে শিক্ষা না নেয়। ফলে জাতীয় জীবনে ইতিহাস চর্চার প্রয়োজনীয়তা অস্বীকার করা যায় না।  

আমাদের অতীত গৌরবের। গৌরবের পথে হাঁটবো এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু ইতিহাসের পথ ধরে না এগোলেই যতো বিভ্রান্তি। এবং এখানেই আমাদের সবচেয়ে বড় ভয়। কারণ, আমাদের ইতিহাস চর্চায় ঘাটতি রয়েছে। তার চেয়েও বড় ভয়, এখানে ইতিহাসের বিকৃতি রয়েছে।  

৫২ সালের ভাষা আন্দোলন

আমাদের ইতিহাস একদিনে রচিত হয়নি। জাতিরাষ্ট্র হিসেবে আমাদের সূচনা ১৯৭১ সালে। কিন্তু আমাদের জাতীয়তাবাদের বিকাশ আরও আগে থেকেই। বলা যেতে পারে, বায়ান্নতে আমাদের বাঙালি জাতীয়তাবাদের আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু হয়। কিন্তু তারও আগে ইতিহাসের যতোই গভীরে যাই বাঙালি জাতীয়তাবাদের উপাদানের উপস্থিতি আমরা লক্ষ্য করি। এই বিবর্তন ও বিকাশের পথ ধরেই সংস্কৃতি ও জাতীয়তাবাদী চেতনায় আজ আমরা সমৃদ্ধ। এখানে একাত্তর একটি মাইল ফলক, বায়ান্ন আরেকটি।  

কিন্তু ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে যে সংগ্রাম, সেখানেও রাজপথে দেখি সেই বাঙালিকে। ব্রিটিশ খেদাও আন্দোলনে বাঙালি মুসলমানরা ছিলো অগ্রণী। ব্রিটিশ রাজত্বে সবচেয়ে লাঞ্ছনা আর বঞ্চনার শিকারও হয়েছে বাঙালিরাই। হয়তো সে কারণেই রাজপথে তারা ছিলো সবার আগে। ব্রিটিশ-বিরোধী আন্দোলনে আমরা যেমন গান্ধিকে দেখি, তেমনি তার পাশে সুভাষকে দেখি, দেখি সোহরাওয়ার্দী, শেরে বাংলাসহ আরও অনেককে। আবুল মনসুর আহমেদ আমাদের সংস্কৃতির যে বিন্যাস দেখিয়েছেন তার বয়স অন্তত হাজার বছরের। আমরা আজ কথায় কথায় বলি, ‘হাজার বছরের বাঙালি’। কিন্তু ইতিহাস চর্চার জায়গাটিতেই খটকা লাগে। সমৃদ্ধ ইতিহাস-ঐতিহ্যের দীর্ঘ পথে না হেঁটে নাতিদীর্ঘ পথের কানাগলিতে হোঁচট খাই। ফলে ইতিহাসের যোগসূত্র আমরা আবিষ্কার করতে পারি না। ঐতিহ্যের সুদীর্ঘ পথ একটু একটু করে হারিয়ে ফেলি।

আমাদের ‘বাঙ্গালা’ নামকরণের ইতিহাসই জাতীয়তাবাদের উত্তরণের এক সুদীর্ঘ পথ নির্দেশ করে। সে পথ ধরেই আমরা আজকের আধুনিক ‘বাঙালি’। অনেক সংগ্রাম ও বিবর্তনের পথ ধরেই আমরা আজকে এখানে এসে দাঁড়িয়েছি। ব্রিটিশ ভারতে যে বাঙালির জন্ম, সে ব্রিটিশ-বিরোধী লড়াই সংগ্রামে অংশ নিয়েছে। ব্রিটিশদের হাত থেকে দেশকে মুক্ত করেছে। সেই প্রজন্মই আবার পাকিস্তানি শাসকচক্র থেকে জাতিরাষ্ট্রের শুভ সূচনায় অংশ নিয়েছে। কাজেই অতীতের হাত ধরেই বর্তমানের শক্ত ভিত। রাজনৈতিক সংগ্রামের মধ্য দিয়েই জাতীয়তাবোধের চেতনা ধীরে ধীরে আমাদের মধ্যে প্রথিত হয়েছে। সেটি একটি ধারাবাহিক প্রক্রিয়া। সে  প্রক্রিয়ায় সব প্রজন্মেরই অবদান রয়েছে। কাজেই সব প্রজন্মের কাছে আমাদের আজকের যতো ঋণ।  

সাতচল্লিশের দেশভাগের পর বলা যায়, আমাদের জাতীয়তাবাদের আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু হয়। সেটিও সংগ্রামের পথ ধরেই। একসময় আমরা উপলব্ধি করলাম, বাংলা আমাদের ভাষা, বাংলাদেশ আমার দেশ, আমরা বাঙালি। এ উপলব্ধি থেকেই প্রথমত স্বকীয়তা ও পরে স্বাধিকার আন্দোলন। এখানে ভাষা আন্দোলন রয়েছে, শিক্ষা আন্দোলন রয়েছে, ছয় দফা আন্দোলনসহ আরও অনেক মাইলফলক। সব মিলিয়েই আমাদের সাংস্কৃতিক আন্দোলন। অতঃপর এ সাংস্কৃতিক বোধ থেকেই জাগ্রত হয় স্বাধীনতার চাহিদা।  

৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ

পাকিস্তানিরা আমাদের ভাষা ও সংস্কৃতির সঙ্গে বাঙালিত্বের সম্পর্ক উপলব্ধি করেই প্রথম হামলাটি করে ভাষা ও সংস্কৃতির ওপর। ১৯৪৭ সাল থেকে ১৯৫২ সাল পর্যন্ত পুরোটা সময় জুড়েই বাঙালিকে ভাষার জন্য লড়াই করে যেতে হয়েছে। পাকিস্তানিরা ঠিকই বুঝতে পেরেছিল, বাঙালির সাংস্কৃতিক চেতনাকে রোধ করতে পারলে সে মাথা তুলে দাঁড়াতে পারবে না। সে কারণেই দীর্ঘ পাঁচ বছর ধরে নানা ছলচাতুরি করে ভাষার ওপর ভাষা, সংস্কৃতির ওপর সংস্কৃতিকে চাপিয়ে দিতে চেয়েছে। কিন্তু ততোদিনে বাঙালির সঙ্গে তার সংস্কৃতি ও ভাষার এক নাড়ির সম্পর্ক তৈরি হয়ে গেছে। বাঙালি সেই নাড়ির টানেই অবশেষে স্বাধীনতার সংগ্রামে অবতীর্ণ হয়। একবার যখন সে তার পরিচয় জেনে গেছে তখন অস্ত্রের মুখেও তার আত্মপরিচয়কে ভুলে যাবে কী করে? তাই আমাদের সংস্কৃতি ও ভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে লেগেছে পাঁচ বছর কিন্তু স্বাধীনতার অধিকার অর্জনে লেগেছে নয় মাস। কারণ, আত্মপরিচয় উপলব্ধিটাই জরুরি, বাকিটা সময়ের দাবি। হয় রক্ত, রাজপথ নয় রাজনীতি- যেকোনো পথেই তার আবির্ভাব ঘটেই।  

আমাদের জীবনে একুশ আসে একুশ যায়। বসন্ত আসে বসন্ত যায়। হালে ভ্যালেন্টাইনস আসে ভ্যালেন্টাইনস যায়। একেকটির একেক রঙ। একুশে কালো, বসন্তে হলুদ, ভ্যালেন্টাইনসে লাল, বৈশাখে লাল-সাদা। এতো এতো রঙ আমাদের জীবনে। কিন্তু যারা এতো এতো রঙ এনে দিলেন আমাদের জীবনে, তাদের অবস্থান আমাদের জীবনে কোথায়? এ প্রশ্নে জীবনানন্দের কথাই মনে পড়ে, ‘গভীর অন্ধকারের ঘুমের আস্বাদে আমার আত্মা লালিত; আমাকে জাগাতে চাও কেন? --- হে স্মৃতি, হে হিম হাওয়া, আমাকে জাগাতে চাও কেন?

বছর কয়েক আগে কুমিল্লার ওয়ার সিমেট্রিতে গিয়েছিলাম। সবুজ ঘাসের মাঝে হাঁটতে হাঁটতে দু’টো সমাধির ওপর চোখ আটকে গেলো। লেখা দেখলাম, ‘He died for those, whom He loved to live in peace’. আরেকটির ওপর লেখা ছিলো, ‘The sun went down while it was yet a day’. আমরা ভালো আছি, শান্তিতে আছি। কিন্তু দিন শেষ হওয়ার আগেই যে সূর্যকে বিদায় নিতে হয়েছে তাকে ভুলি কী করে?

বাংলাদেশ সময়: ০৮৫১ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২১, ২০১৭
এসএনএস
 

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।