ঢাকা, শুক্রবার, ১২ পৌষ ১৪৩১, ২৭ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৪ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

মুক্তমত

জিন্নাহর ‘ওসিয়ত’ নাজিমুদ্দেনের ‘নসিয়তে’ বাঙালির ‘না’

এরশাদুল আলম প্রিন্স, ল’ এডিটর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৬১২ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২১, ২০১৭
জিন্নাহর ‘ওসিয়ত’ নাজিমুদ্দেনের ‘নসিয়তে’ বাঙালির ‘না’ অমর একুশে

বাংলার বিরুদ্ধে, বাঙালির বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র আমাদের এক ঐতিহাসিক ললাট লিখন। ব্রিটিশ রাজের সময় বাঙালি ছিলো নিষ্পেষিত, পাকিস্তানি শাসনেও সেই নিষ্পেষণের অবসান হয়নি। বরং পাকিস্তানি শাসনে নিষ্পেষণ আরও নতুন মাত্রা পেয়েছে। 

ব্রিটিশ শাসনে হিন্দি, বাংলা আর উর্দুর ওপর চাপিয়ে দেওয়া হলো ইংরেজিকে। বৃটিশ রাজ্যের রাষ্ট্রভাষা ছিলো ইংরেজি।

ব্রিটিশরা চলে যাওয়ার সময় তারা অবিভক্ত ভারতকে দুই টুকরা করে দুই জনের হাতে তুলে দিলো। লাহোর প্রস্তাব অনুযায়ী, তিন (বা একাধিক) টুকরা তিনজনের হাতে বুঝিয়ে দেওয়ার কথা ছিলো। কিন্তু ব্রিটিশরা দুই টুকরা করেই বন্দর থেকে জাহাজ ছেড়ে দেয়। আর যেনো মনে মনে বলে, ‘আমরা দুই টুকরা করিয়া দিলাম, বাকিটা তোমরা করিয়া লও’।

‘ইংরেজি’ চলে যাওয়ায় ভারত ‘হিন্দি’-কে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে ফিরে পেলো। কিন্তু বাংলা পড়লো বিপাকে। পাকিস্তানের ক্ষমতা তুলে দেওয়া হলো করাচিওয়ালাদের হাতে। ৫৬ শতাংশ ভাগ জনগণের ভাষার বদলে উর্দুই হয়ে গেলো রাষ্ট্রভাষা। হয়তো এটাই নিয়ম আর বাঙালির সেই পুরনো ললাট লিখন আরকি! ক্ষমতার মালিক যে ভাষায় কথা বলে প্রজাদেরও সেই ভাষায়ই কথা বলতে হয়। কিন্তু পাকিস্তানতো কোনো ‘উপনিবেশ’ বা ‘রাজতন্ত্র’ নয় যে রাজা-প্রজার হিসেবে রয়েছে। ক্ষমতার মালিক যদি জনগণ হয় তবে জনগণের ভাষাই হবে রাষ্ট্রভাষা।  

কিন্তু ক্ষমতার মালিক কায়েদে আযম জনগণ বলতে বোঝেন করাচি-ইসলামাবাদ-লাহোর-পাঞ্জাব। সেখানে টেকনাফ-তেতুলিয়ার দাম কই? তাই তিনি উর্দুকেই রাষ্ট্রভাষা করার জন্য উঠে-পড়ে লাগলেন। উত্তরসূরি লিয়াকত আলী-খাজা নাজিমুদ্দিন-নূরুল আমিনও একই পথের পথিক।  

এদিকে জিন্নাহ পরলোক গমন করলেন। ১৯৫১ সালে প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খানও আততায়ীর হাতে নিহত হলেন। কিন্তু গদি তো আর কারও জন্য অপেক্ষা করে না। খান সাহেবের জায়গায় নাজিমুদ্দিন হন প্রধানমন্ত্রী।

১৯৫২ সালের ২৬ জানুয়ারি পল্টন ময়দানে এক বিরাট জনসভার আয়োজন করা হয়। খাজা নাজিমুদ্দিন সেই সভার প্রধান বক্তা ও সভাপতি। সভাপতির ভাষণে তিনি একটু ভিন্ন সুরেই পুরনো বয়ান করলেন, ‘জাতির জনক মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ আজ আর আমাদের মাঝে নেই, তার অন্তিম ইচ্ছা ছিল উর্দু পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হবে। কায়েদে মিল্লাত লিয়াকত আলী খানেরও একই অন্তিম বাসনা ছিল। আসুন আমরা উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করে তাদের প্রতি জাতির কৃতজ্ঞতা ও শ্রদ্ধা নিবেদন করি ও দৃঢ় সংহতির উপর পাকিস্তানকে প্রতিষ্ঠিত করি’।  

এরপর তিনি আবার একটু শক্তভাব দেখিয়ে বললেন, ‘তাদের ইচ্ছার বিরোধিতা করা রাষ্ট্রদ্রোহীতার সামিল। যদিও বিষয়টির সুষ্ঠু মীমাংসার জন্য কেন্দ্রীয় সরকারের পক্ষ থেকে প্রাদেশিক সরকারের অনুমোদনের জন্য প্রেরিত হয়েছে’। খাজা সাহেবের কথা শুনে মনে হলো যেনো জিন্নাহ সাহেবের ওসিয়ত পুরা করতে বাঙালির বাপ-দাদার নামও ভুলে যেতে হবে।  

ওই সভায় উপস্থিত ছিলেন আবদুল মতিন, গাজীউল হক, শামসুল হক, মোশারফ হোসেন প্রমুখ ছাত্রনেতারা। তারা নাজিমুদ্দিনের কথায় অবাক হননি। কারণ, দেশভাগের পরই যে ষড়যন্ত্রের সূত্রপাত, ক্ষণিকেই তা শেষ হবে সেরকম ভাবনা বোকামি। তারা ঠিকই অনুধাবন করলেন যে, ভাষা ষড়যন্ত্র এখনও বন্ধ হয়নি। তাই তারা নতুন উদ্যমে ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম কমিটি’ গঠন করলেন।

সংগ্রাম কমিটি ৩০ জানুয়ারি ও ০৪ ফেব্রুয়ারি দু’টি সভায় কয়েকটি বিশেষ কর্মসূচি হাতে নেয়। তারা এসব সভায় ছাত্র-জনতার উদ্দেশ্যে ভাষার প্রশ্নে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানান। সভায় বক্তব্য দেন- আবদুল মতিন, তাজউদ্দিন, গাজীউল হক, শামসুল হক ও নাদেরা বেগম। এ কমিটিতে গাজীউল হককে সভাপতি  করা হয়। তাদের নেতৃত্বে ধর্মঘটের কর্মসূচি নেওয়া হয়। ০৪ ফেব্রুয়ারি, ১১ ফেব্রুয়ারি, ১৩ ফেব্রুয়ারি পতাকা দিবস ও আন্দোলন দিবস পালন করারও সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।

অন্যান্য সংগঠনও পৃথক কর্মসূচি দিয়ে ভাষা আন্দোলনকে বেগবান করে। ৩০ জানুয়ারি বার লাইব্রেরিতে আতাউর রহমান খানের নেতৃত্বে এক সভা আহ্বান করা হয়। তারা এ সভায় ‘সর্বদলীয় কর্মপরিষদ’ গঠন করে যেখানে গোলাম মাহবুবকে আহ্বায়ক করা হয়। একই সঙ্গে বিভিন্ন সংগঠন থেকে সদস্য নিয়ে ‘ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ’ গঠিত হয় যার সভাপতি হন আবদুল মতিন।  

১৬ ফেব্রয়ারি শেখ মুজিব ও মহিউদ্দিন আহমদ ঢাকা সেন্ট্রাল জেলে অনশন করেন। রাজপথে, ঘরে-বাইরে সর্বত্রই ভাষা আন্দোলনের স্ফুলিঙ্গ তখন তুঙ্গে। বাঙালি দাবি আদায় করেই তবে ঘরে ফিরবে।  

এর পরের ইতিহাস সবারই জানা। ২১ ফেব্রয়ারি ভোর হতে না হতেই বিশ্ববিদ্যালয়ের গেটে, রশিদ বিল্ডিংয়ের সামনে, মেডিকেল কলেজ, ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ (আজকের বুয়েট) ও জগন্নাথ হলের সামনে-সবখানেই পুলিশ ভ্যান-টহল। লাঠিধারী, বন্দুধারী শিরস্ত্রাণধারী, রিভলভারধারী, মেশিগানবাহী পুলিশ সব রাস্তা দখল করে নিয়েছে। বাইরে ১৪৪ ধারা। কিন্তু ছাত্র-জনতা ১৪৪ ধারা মানবে না বলে আগের দিনই ঘোষণা দিয়েছে। ভাষার দাবি আদায় করেই তারা ঘরে ফিরবে।  

২১ ফ্রেব্রুয়ারি সকাল থেকেই বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছাত্ররা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এসে জড়ো হতে থাকে। তারা সবাই ১৪৪ ধারা ভাঙতেই এখানে এসেছে। অতঃপর পুলিশের গুলি বর্ষণ, কাদানে গ্যাস নিক্ষেপ ইত্যাদি ইত্যাদি। রাজপথ রঞ্জিত হলো। ভাই হারিয়ে পেলাম ভাষা।  

১৯৫৪ সালে করাচিতে মুসলিম লিগের সংসদীয় কমিটির সভায় বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করা সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। কিন্তু সরকার তা থেকে দূরে সরে আসে। পরে ১৯৫৬ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি গণপরিষদে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেয়ার জন্য প্রস্তাব উত্থাপন করা হয়। ২৬ ফেব্রুয়ারি বাংলাকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দেওয়া হয়। সংবিধানে লেখা হয়, ‘ The state language of Pakistan shall be Urdu and Bengali’.

বাংলাদেশ সময়: ১২০৭ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২১, ২০১৭
এসএনএস

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।