ঢাকা, শনিবার, ১৪ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ২৮ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

মুক্তমত

প্রোগ্রামিংয়ের আনন্দ: স্কুলের ছেলেমেয়েরা

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৯৩০ ঘণ্টা, এপ্রিল ৬, ২০১৭
প্রোগ্রামিংয়ের আনন্দ: স্কুলের ছেলেমেয়েরা প্রতীকী ছবি

আমি তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, মাস্টার্সে পড়ি। আমাদের স্যারেরা একদিন ঠিক করলেন আমাদের কম্পিউটার শিখতে হবে। শুনে আমার খুবই উত্তেজিত, কম্পিউটারের নাম শুনেছি, কখনও দেখিনি। সত্যি কথা বলতে কী জিনিসটা দেখতে কেমন সেটা নিয়ে কোনো ধারণাও নেই। মাঝে মাঝে কাউকে কাউকে দেখেছি বিশাল কম্পিউটার ‘প্রোগ্রাম’ ঘাড়ে করে নিয়ে যাচ্ছেন- শুনে যারা অবাক হচ্ছে তাদের বলছি, তখন কম্পিউটার প্রোগ্রামিং করার জন্য সেটা কার্ডে পাঞ্চ করতে হত, প্রোগ্রামটা কম্পিউটারে চালাতে হলে সেই কার্ডগুলো নিয়ে যেতে হত। যার প্রোগ্রাম যত বড় তার কার্ডের বান্ডিল তত বিশাল! সেগুলো আসলেই ঘাড়ে করে নিয়ে যেতে হত।

যা-ই হোক, আমাদের ক্লাশের দশজনকে একদিন স্ট্যাটিস্টিক্যাল ব্যুরো কিংবা এই ধরনের কোনো একটি প্রতিষ্ঠানে নিয়ে যাওয়া হল। সেখানে একজন কম্পিউটারের ওপর একটা লেকচার দিলেন তারপর এক বান্ডিল কম্পিউটার কার্ড কোথায় জানি ঠেসে দিলেন, কার্ডগুলো ঘ্যাচ ঘ্যাচ করে কোথায় জানি অদৃশ্য হয়ে গেল।

ঘানিকক্ষণ পর তিনি জানালেন প্রোগ্রামটা সাফল্যের সাথে ‘রান’ করেছে। কী ঘটেছে কী হয়েছে আমরা কিছুই বুঝতে পারলাম না।

আমি উঁকিঝুকি মেরে ঘরের ভেতরে কম্পিউটার নামক বস্তুটা দেখার চেষ্টা করলাম, বিশাল ঘরের বাইরে আমরা দাঁড়িয়ে আছি, ভেতরে কী আছে, জানি না। তাই কম্পিউটার নামক বস্তুটা আর নিজের চোখে দেখা হল না, তাতে অবশ্যি আমাদের কোনো ক্ষতি হল না। কম্পিউটারের উপর জ্ঞান অর্জন করে খুবই গম্ভীরভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিরে এলাম। বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যান্য ছাত্রছাত্রীরা হিংসাতুর দৃষ্টিতে আমাদের দিকে তাকিয়ে রইল!

এর কিছুদিন পর আমি পিএইচডি করার জন্যে আমেরিকা চলে এসেছি। যে নিউক্লিয়ার ফিজিক্স ল্যাবরেটরিতে কাজ করি সেখানে প্রথমবার সত্যিকারের কম্পিউটার দেখতে পেলাম। দেয়াল ঘিরে এক মানুষ সমান উঁচু ঘরের একমাথা থেকে অন্যমাথা জুড়ে বিশাল কম্পিউটার! সেখানেও কার্ড পাঞ্চ করে প্রোগ্রামিং করতে হয়, আমিও প্রোগ্রামিং শুরু করেছি দেখতে দেখতে আমারও বিশাল বিশাল কার্ডের বান্ডিল জমা হতে শুরু করল!
বছর খানেক পরে ঘরের একমাথা থেকে অন্যমাথা জুড়ে থাকা বিশাল কম্পিউটার সরিয়ে নূতন একটা কম্পিউটার বসানো হল, সেটা আকারে অনেক ছোট, স্টিলের আলমিরার সাইজ। কম্পিউটারের ঘরটা ফাঁকা ফাঁকা লাগতে থাকে। শুধু তা-ই না, কার্ড পাঞ্চ করার যন্ত্র কার্ড রিডার সব উধাও হয়ে গেল। এখন আমাদের রুমে রুমে ছোট ছোট টেলিভিশনের মতো মনিটর সাথে একটা কি-বোর্ড দেওয়া হলো। আমরা নিজেদের রুমে বসে কম্পিউটারে প্রোগ্রাম চালাতে পারি, দেখে আমরা হা হয়ে গেলাম। দূর দূর থেকে মানুষজন এই প্রযুক্তি দেখার জন্যে আমাদের ল্যাবরেটরিতে আসতে থাকে।

আমি তখন আমার পিএইচডির জন্যে কাজ করছি, মাঝে মাঝেই কম্পিউটারে কাজ করতে হয়, তখন হঠাৎ আবিষ্কার করলাম আমার প্রফেসর আমাদের গ্রুপের জন্যেই একটা কম্পিউটার কিনে ফেলেছে। একেবারে খেলনার মতো কম্পিউটার টেবিলের উপর রাখা যায়, দেখে আমি হতবাক হয়ে গেলাম। আমি সেটাতে কাজ করি, যে ক্যালকুলেশন করার জন্যে মাথায় চুল ছিড়ে ফেলেছি সেটা এখন চোখের পলকে করে ফেলা যায়। একদিন ল্যাবরেটরিতে কিছু একটা কাজ হচ্ছে, আমি ঢুকতে পারছি না, কম্পিউটারে কাজ করতে পারছি না। উপায় না দেখে কম্পিউটার আর মনিটরটা একটা ট্রলির উপর তুলে ঠেলে ঠেলে আমার অফিসে নিয়ে যাচ্ছি, আমার একজন প্রফেসর কিছুক্ষণ হা করে আমার দিকে তাকিয়ে রইলেন, তারপর বললেন, “আমি নিজের চোখে এই ঘটনাটি দেখছি! বিশ্বাস হচ্ছে না!”

আমি জিজ্ঞেস করলাম, “কী বিশ্বাস হচ্ছে না?”

প্রফেসর বললেন, “একজন মানুষ আস্ত কম্পিউটার একঘর থেকে আরেক ঘরে নিয়ে যাচ্ছে! কী অবিশ্বাস্য ঘটনা!”

কিছুদিন পর সেই অবিশ্বাস্য ঘটনা থেকেও অবিশ্বাস্য ঘটনা ঘটল। শুনতে পেলাম স্টিভ জবস নামের একজন মানুষ তার ‘আপেল’ কোম্পানি থেকে ম্যাকিন্টশ নামে একটা কম্পিউটার তৈরি করেছে, সেটা হাতে করে নেওয়া যায়। শুধু তা-ই না, সেই অবিশ্বাস্য যন্ত্রটি অনেক ডিসকাউন্টে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের কাছে বিক্রি করা হবে। আমি শুনে মোটামুটি খেপে গেলাম, ঠিক করলাম যেভাবেই হোক সেটা কিনতে হবে।
পিএইচডি স্টুডেন্টদের মাসিক বেতন খুবই কম, কষ্ট করে কোনোমতে খেয়ে-পরে থাকা যায়। কিন্তু ততদিনে বিয়ে করে ফেলেছি, আমার স্ত্রীও আমার সাথে পিএইচডি করছে। সে কীভাবে কীভাবে আমার জন্যে কিছু ডলার ম্যানেজ করল এবং সেটা দিয়ে আমি ম্যাকিন্টশ নামের সেই কম্পিউটারটা কিনে আনলাম। সেই থেকে আমার জীবনটা অন্যরকম হয়ে গেল। প্রথম যেদিন নিজের হাতে তৈরি করা ফন্টে সেই কম্পিউটারের স্ক্রিনে বাংলা দেখা দেখতে পেলাম, আমি সেই দিনটির কথা কোনোদিন ভুলতে পারব না।

একজন মানুষের জীবনে একেবারে নিজের জন্যে ব্যক্তিগত একটা কম্পিউটারের চাইতে বড় একটা কিছু হতে পারে বলে আমার জানা নেই, সৃষ্টিশীল কাজের জন্যে এর থেকে বড় কিছু আমি আমার জীবনে পাইনি!

মজার কথা হচ্ছে এখন যারা ডেস্কটপ কিংবা ল্যাপটপ ব্যবহার করে তারা নিশ্চয়ই আমার সেই ম্যাকিটশ কম্পিউটারের কথা শুনে হাসতে হাসতে মারা যাবেন। সেই কম্পিউটারের অপারেটিং সিস্টেম, লেখালেখির জন্যে ওয়ার্ড প্রসেসর এবং ছবি আঁকার জন্যে একটি সফটওযার সবকিছু থাকত ১২৮ কিলোবাইটের একটা ফ্লপি ডিস্কে! (না, আমি মেগাবাইট লিখতে গিয়ে ভুল করে কিলোবাইট লিখে ফেলিনি! আসলেই ১২৮ কিলোবাইট। সেই ফ্লপি ডিস্কে তারপরও কিছু জায়গা রাখা হত নিজের কাজকর্ম রাখার জন্যে!)

২.
এতক্ষণ যে কথাগুলো লিখেছি সেটা হচ্ছে ভূমিকা। এখন আসল কথায় আসি।

দেশের সবাই জানে কি না জানি না, আমাদের দেশে হাই স্কুলের ছেলেমেয়েদের জন্যে কম্পিউটারের প্রোগ্রামিং প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে। ‘প্রতিযোগিতা’ বিষয়টা আমার খুব পছন্দের বিষয় না। কারণ প্রতিযোগিতার অর্থ হচ্ছে অন্যদের কোনোভাবে পিছনে ফেলে নিজে সামনে এগিয়ে যাওয়া। প্রতিযোগিতা মানেই হচ্ছে একধরনের স্বার্থপরতা! কিন্তু ছেলেমেয়েদের কোনো ধরনের সৃষ্টিশীল কাজে ডেকে আনার জন্যে এর থেকে কার্যকর অন্য কোনো উপায় আমার জানা নেই।

আমরা যখন প্রথম এই দেশে ‘গণিত অলিম্পিয়াড’ শুরু করেছিলাম, তখন কখনও কল্পনা করিনি এত সাড়া পাব, এত ছেলেমেয়ে অংশ নেবে। আমি নিজে যদি কখনও এই ধরনের অলিম্পিয়াড বা প্রতিযোগিতায় উপস্থিত থাকি তাহলে সারাক্ষণই ছেলেমেয়েদের বোঝাই– প্রতিযোগিতাটা আমাদের মূল উদ্দেশ্য নয়, আমাদের মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে একটা উৎসব!

যাই হোক হাই স্কুলের ছেলেমেয়েদের এই প্রোগ্রামিং প্রতিযোগিতাটাও মোটামুটিভাবে একটা উৎসবের মতো। সিলেট এলাকায় এই উৎসবটির আয়োজন করা হয়েছিল আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে। ঠিক তখন সিলেট এলাকায় জঙ্গিদের বিরুদ্ধে অভিযান হচ্ছে, সারা শহরে একধরনের টেনশান। শত শত ছেলেমেয়ে নিয়ে এরকম অনুষ্ঠান না করার জন্যে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী উপদেশ দিচ্ছে, তার মাঝে শত শত ছেলেমেয়ে সময়মতো হাজির হয়ে গেছে। আযোজক আমাদের বিভাগের তরুণ শিক্ষকেরা, তারা আমাকে ডেকে নিয়ে গেল স্কুলের ছেলেমেয়েদের সাথে কথা বলার জন্যে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর রক্ত চক্ষু না দেখার ভান করে আমি ছেলে মেয়েদের সাথে ঘণ্টাখানেক কথা বলেছি। তারা আমাকে যে কথাগুলো বলেছে সেই কথাগুলো সবাইকে জানানোর জন্যে আমি এই বিশাল ইতিহাস লিখতে বসেছি!

ছেলেমেয়েরা আমাকে বলেছে তাদের অভিভাবকেরা মোটেই চান না যে তারা কম্পিউটারে প্রোগ্রামিং করা শিখুক। তাদের বাবামায়েরা চান ছেলেমেয়েরা কোচিংয়ে, প্রাইভেটে মাথা গুঁজে পাঠ্যবই মুখস্থ করতে থাকুক। কারণ তাদের ধারণা কম্পিউটার প্রোগ্রামিং শিখে কোনো লাভ নেই। বাবামায়ের ধারণা জীবনের একমাত্র উদ্দেশ্য হতে পারে পরীক্ষায় ‘জিপিএ-ফাইভ’ পাওয়া।

ছেলেমেয়েদের কথা শুনে আমি একই সাথে বিস্ময় এবং আতঙ্ক অনুভব করেছি।

এটি কেমন করে সম্ভব যে আমাদের দেশের ছেলেমেয়েদের বাবামায়েরা এত বড় একটা ভুল ধারণা নিয়ে থাকতে পারেন? আমি বিষয়টা নিয়ে যখন একটু চিন্তা করেছি। তখন আমার মনে পড়েছে এই বয়সী ছেলেমেয়েরা আমার কাছে মাঝে মাঝেই আরও একটা অভিযোগ করেছে, তারা বলেছে তাদের বাবামায়েরা পাঠ্যবইয়ের বাইরে অন্য কোনো বই পড়তে দেন না।

আমি তাদের বলি একজনকে বই পড়তে না দেওয়া আর খেতে না দেওয়ার মাঝে কোনো পার্থক্য নেই। কোনো বাবামা যদি তার সন্তানকে না খেতে দিয়ে মেরে ফেলতে চান, তখন চুরি করে হলেও কিছু খেয়ে প্রাণটা বাঁচিয়ে রাখার মাঝে যে রকম কোনো দোষ নেই, ঠিক সেরকম চুরি করে, গোপনে বাথরুমে বসে, গভীর রাতে চাদরের নিচে বাতি জ্বালিয়ে বই পড়ার মাঝে কোনো দোষ নেই। এই দেশের বাবামায়েরা আমাকে যতই শাপ-শাপান্ত করুক না কেন আমি ছেলেমেয়েদের যে কোনো মূল্যে বই পড়ার কথা বলে এসেছি এবং বলে যাব।

কম্পিউটার প্রোগ্রামিং শেখার বেলাতেও একই কথা বলা যায়। যারা কম্পিউটারে কোনো ধরনের প্রোগ্রামিং করেছে তারা সবাই জানে বিষয়টা আসলে কিছু নিয়ম মেনে যুক্তিতর্ক বা লজিকের সাহায্যে কম্পিউটারকে কিছু নির্দেশ দেওয়া ছাড়া আর কিছু না। যারা কাজটি করে দেখতে দেখতে তাদের যুক্তি বা লজিকমাফিক কাজ করার ক্ষমতা বেড়ে যায়। কাজটি করার জন্যে মস্তিষ্ককে ব্যবহার করতে হয়, তাই তাদের মস্তিষ্ক দেখতে দেখতে শানিত হয়ে যায়। একটি ছেলে বা মেয়ে যত বেশি তার মস্তিষ্ককে চিন্তা করার জন্যে কাজে লাগাবে তার মস্তিষ্ক তত বেশি শানিত হয়ে উঠবে– এটা বোঝার জন্যে কাউকে রকেট সায়েন্টিস্ট হতে হয় না।

কম্পিউটারের সামনে বসে ফেসবুক করা যতখানি খারাপ, প্রোগ্রামিং করা ঠিক ততখানি ভালো। সবচেয়ে বড় কথা যে ছেলেটি বা মেয়েটি প্রোগ্রামিং করতে শিখে গেছে তার সামনে একটা নূতন জগৎ খুলে দেওয়া হয়েছে, সেই জগতে সে কী করবে, কতখানি করবে, তার কোনো সীমারেখা বেঁধে দেওয়া নেই। মস্তিষ্ক ব্যবহার করতে অনেক সময় একধরনের পরিশ্রম হয়। অন্যদের কথা জানি না, আমার নিজের বেলায় ঠিক তার উল্টো। ক্লান্তির কারণে যখন আমি কিছুই করতে পারি না, একটা বই পর্যন্ত পড়তে পারি না তখনও কোনো বিচিত্র কারণে আমি কম্পিউটার প্রোগ্রামিং করতে পারি আমার জন্যে সেটা একধরনের বিনোদন।

সেদিন একটি ছেলে আমার কাছে একটা ইমেইল পাঠিয়েছে। সে লিখেছে তার খুব প্রোগ্রামিং শেখার ইচ্ছে, কিন্তু তার বাবা তাকে বলছেন যে, সে প্রোগ্রামিং শেখার জন্যে ছোট তার এখানও বয়স হয়নি। কথাটি সত্যি নয়, প্রোগ্রামিং শেখার জন্যে কোনো বয়সের দরকার হয় না। যারা লিখতে শিখেছে তারাই প্রোগ্রামিং করতে পারবে। সত্যি কথা বলতে কী ছোট শিশু যারা এখনও লিখতে শেখেনি তারাও যেন কম্পিউটার প্রোগ্রামিংয়ে হাতেখড়ি করতে পারে সে জন্যে বিশেষ প্রোগ্রামিংয়ের ভাষা তৈরি হচ্ছে, যেখানে বাচ্চারা ছবি বা নকশা জুড়ে জুড়ে প্রোগ্রামিং করতে পারে। এমআইটির মিডিয়া ল্যাবে আমি নিজে সেরকম একটা কাজ দেখে এসেছি!

এত কথা অবশ্যি বলারও প্রয়োজন নেই, কম্পিউটার প্রোগ্রামিংয়ে বয়স যে কোনো বাধা নয়, সেটার সবচেয়ে ভালো উদাহরণ আমাদের চোখের সামনে। প্রোগ্রামিং সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক অলিম্পিয়ার্ডে আমাদের দেশের যে প্রতিযোগীরা মেডেল নিয়ে এসেছে তারা ক্লাশ নাইনে পড়ে! শুধু তা-ই না, বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের ঘাগু প্রোগ্রামারদের যখন প্রতিযোগিতা হয়, তখন মাঝে মাঝে এই ‘বাচ্চাদের’ তাদের সাথে অংশ নেওয়ার সুযোগ দেওিয়া হয়, তখন অবলীলায় তারা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছেলেমেয়েদের হারিয়ে দিতে পারে! কাজেই বয়সটি কোনো বাধা নয়, ছোট ছেলেমেয়েদের উৎসাহ থাকলেই তারা কাজ করতে শুরু করে দিতে পারবে।

যারা প্রোগ্রামিংয়ের কিছুই জানে না তারাও যেন একেবারে শূন্য থেকে প্রোগ্রামিং শুরু করতে পারে সে জন্যে চমৎকার কিছু বইও লেখা হয়েছে। কাজেই বিষয়টি আর জটিল নেই। প্রোগ্রামিংয়ে হাতেখড়ি করার জন্যে দরকার এরকম একটা বই এবং একটা কম্পিউটার।

৩.
সত্যি কথা বলতে কী প্রোগ্রামিং করার জন্যে এখন কম্পিউটারেরও প্রয়োজন নেই, তার কারণ স্মার্ট ফোনেও প্রোগ্রামিং করার জন্যে ‘কম্পাইলার’ (যেটা ব্যবহার করে কম্পিউটার প্রোগ্রাম লিখে সেটা চালানো হয়) পাওয়া যায়। আমি চালিয়ে দেখেছি, ছোট কি-বোর্ডে আমার ভোটকা আঙুল দিয়ে সঠিক অক্ষর স্পর্শ করার জটিলতা ছাড়া আর কোনো সমস্যা হয়নি। কাজেই বলা যেতে পারে কম্পিউটার প্রোগ্রামিং করার বিষয়টি এই প্রথম শহরের স্বচ্ছল পরিবারের গণ্ডি থেকে বের হয়ে প্রত্যন্ত গ্রামের ছেলেমেয়েদের কাছে পৌঁছে গেছে। আমি মনে করি, এই প্রথবার আমাদের দেশের ‘ডিজিটাল ডিভাইড’ দূর করার একটি সত্যিকারের সুযোগ এসেছে!”

হাইস্কুলের ছেলেমেয়েদের প্রোগ্রামিং প্রতিযোগিতা আয়োজন করার সময় আমাদের মাথায় রাখতে হয় কয়টি ল্যাবরেটরিতে কয়টি কম্পিউটার আছে, তাই সর্বোচ্চ কতোজনকে প্রোগ্রামিং করার সুযোগ দিতে পারব। সবাইকে সুযোগ দেওয়া সম্ভব হত না, আমার ধারণা ঠিকভাবে পরিকল্পনা করতে পারলে ইচ্ছে করলে এখন থেকে আমরা যতজন ইচ্ছা ততজনকে প্রোগ্রামিং প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে সুযোগ করে দিতে পারব। ছেলেমেয়েরা শুধু বাসা থেকে তাদের বাবামা, বড় ভাইবোন কিংবা নিজের স্মার্ট ফোনটি নিয়ে হাজির হবে। এক সাথে সবচেয়ে বেশি প্রোগ্রামিং প্রতিযোগিতার একটি গিনিজ রেকর্ড করাও এখন এমন কিছু কঠিন নয়।
৪.
আমাদের এইচএসসির সিলেবাসে ‘সি প্রোগ্রামিং’ নামে একটা বিষয় ছেলেমেয়েদের পড়তে হয়। যেহেতু দেশের সব কলেজে কম্পিউটার ল্যাবরেটরি নেই, তাই ছেলেমেয়েদের কখনও সত্যিকার প্রোগ্রামিং করার সুযোগ হয়নি। তাদের পরীক্ষা নেওয়া হয় লিখিত পরীক্ষা দিয়ে। কম্পিউটার প্রোগ্রামিংয়ের লিখিত পরীক্ষা নেওয়া যে কথা, খেলার মাঠে সাঁতারের পরীক্ষা নেওয়া সেই একই কথা; পুরো বিষয়টা একটা বিড়ম্বনার মতো। যে খুব সুন্দর নাচতে পারে তাকে যদি আমি বলি তুমি কাগজে লিখে দাও নাচার সময় হাত-পা-মাথা-চোখ কখন কিভাবে নাড়াও আমি তোমার নাচটি উপভোগ করব, আমি নিশ্চিত সেই মানুষ আর যা-ই করুক জন্মের মতো নাচা ছেড়ে দেবে। এখানেও সেই একই ব্যাপার কম্পিউটার প্রোগ্রামিংয়ে লিখিত পরীক্ষার কারণে ছেলেমেয়েরা প্রোগ্রামিং সম্পর্কে শুধু যে ভুল ধারণা পাচ্ছে তা নয়, প্রোগ্রামিংয়ের উপর বীতশ্রদ্ধ হয়ে উঠছে!
এই প্রথম একটা সুযোগ এসেছে সবাইকে সত্যিকারভাবে প্রোগ্রামিং শিখিয়ে তাদের সৃষ্টিশীলতার একটা নূতন জগতে নিয়ে যাওয়ার। আমাদের ছোট একটি জীবন, সময়টা যদি উপভোগ না করি তাহলে কেমন করে হবে?

৭ এপ্রিল, ২০১৭

ড. মুহম্মদ জাফর: ইকবাল লেখক ও অধ্যাপক, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়।

বাংলাদেশ সময়: ০০০১ ঘণ্টা, এপ্রিল ৭, ২০১৭
জেডএম/

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।