ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ৬ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২১ নভেম্বর ২০২৪, ১৯ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

মুক্তমত

বাংলাদেশের আইনে শ্রমিকের অধিকার ও সুরক্ষা

খাদেমুল ইসলাম | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৯৪৭ ঘণ্টা, মে ১, ২০২৪
বাংলাদেশের আইনে শ্রমিকের অধিকার ও সুরক্ষা

সভ্যতার বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে শ্রমিক শ্রেণির ভূমিকা বৃদ্ধি পেয়েছে। মানবসভ্যতার শুরু থেকেই শ্রমের বিনিময়ে উপার্জনের প্রথা ছিল।

তবে প্রযুক্তির বিকাশের সঙ্গে শিল্পায়নের কারণে প্রাতিষ্ঠানিক শ্রমজীবী মানুষের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে। একদা মানুষকে কৃতদাস হিসেবে বিক্রি করা হতো। কালের বিবর্তনে কৃতদাস প্রথা বিলুপ্ত হলেও শ্রমিক শ্রেণির প্রতি নানা বৈষম্য রয়েই গেছে। বিভিন্ন সময়ে শ্রমজীবী মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য আইনগত কাঠামোও তৈরি হয়েছে। তদুপরি নানাভাবে শ্রমিক শ্রেণি বৈষম্যের শিকার হয়ে থাকে। বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে শ্রমিকদের জন্য কি ধরনের আইনগত অধিকার ও সুরক্ষা রয়েছে সে বিষয়ে আলোকপাত করা হলো।

শ্রমিকদের সার্বজনীন আইনগত অধিকার:
যোগ্যতা অনুযায়ী কর্ম লাভ এবং কর্ম অনুযায়ী পারিশ্রমিক পাওয়ার অধিকার সার্বজনীনভাবে স্বীকৃত। ১৯৪৮ সালে ঘোষিত জাতিসংঘের সার্বজনীন মানবাধিকারের ঘোষণা পত্রেও সেই বিষয়টি স্বীকৃতি পেয়েছে। এই ঘোষণাপত্রের ধারা-২৩ এ বলা হয়েছে- (১) প্রত্যেকের‌ই কাজ করার, স্বাধীনভাবে চাকরি বেছে নেওয়ার, কাজের ন্যায্য এবং অনুকূল পরিবেশ লাভ করার এবং বেকারত্ব থেকে রক্ষিত হবার অধিকার রয়েছে। (২) কোনোরূপ বৈষম্য ছাড়া সমান কাজের জন্য সমান বেতন পাবার অধিকার প্রত্যেকের‌ই আছে। (৩) কাজ করেন এমন প্রত্যেকের‌ই নিজের এবং পরিবারের মানবিক মর্যাদার সমতুল্য অস্তিত্বের নিশ্চয়তা দিতে পারে এমন ন্যায্য ও অনুকূল পারিশ্রমিক লাভের অধিকার রয়েছে; প্রয়োজনবোধে একে অন্যান্য সামাজিক নিরাপত্তা ব্যবস্থাদি দ্বারা পরিবর্ধিত করা যেতে পারে। (৪) নিজ স্বার্থ সংরক্ষণের জন্য প্রত্যেকের‌ই ট্রেড ই‌উনিয়ন গঠন এবং তাতে যোগদানের অধিকার রয়েছে। ধারা ২৪ এ বলা হয়েছে- প্রত্যেকের‌ই বিশ্রাম ও অবসরের অধিকার রয়েছে; নিয়মিত সময়ের ব্যবধানে বেতনসহ ছুটি এবং পেশাগত কাজের যুক্তিসঙ্গত সীমা‌ও এ অধিকারের অন্তর্ভুক্ত।

কর্মক্ষেত্রে উন্নতি ও তাদের সুযোগ-সুবিধার সমতা বিধান করার লক্ষ্যে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও)। ভার্সাই চুক্তি অনুযায়ী ১৯১৯ সালের ১১ এপ্রিল আন্তর্জাতিক সংস্থাটি প্রতিষ্ঠিত হয়। জাতিসংঘের অধিভুক্ত সবচেয়ে প্রাচীন সংস্থা এটি। সুইজারল্যান্ডে এর সদর দপ্তর অবস্থিত। অফিসিয়াল ওয়েবসাইট থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুসারে ১৯৭২ সালের ২২ জুন থেকে বাংলাদেশ আইএলও’র সক্রিয় সদস্য। সদস্য হিসেবে বাংলাদেশ সংস্থাটির ১০টি মৌলিক কনভেনশনের মধ্যে ৮টি এবং চারটি গভর্নেন্স কনভেনশনের মধ্যে দুটি সহ ৩৬টি আইএলও কনভেনশন এবং একটি প্রটোকল অনুমোদন করেছে। সংস্থাটি বাংলাদেশ সরকার এবং শ্রমিক শ্রেণি ও শ্রমিক সংগঠনগুলোর সঙ্গে আইএলও ডিসেন্ট ওয়ার্ক কান্ট্রি প্রোগ্রাম (ডিডব্লিউসিপি) এর মাধ্যমে উপযুক্ত কর্ম পরিবেশ তৈরিতে যৌথভাবে কাজ করছে।

বাংলাদেশের আইনে শ্রমিকদের অধিকার ও সুরক্ষার বিধান:
স্বাধীনতার পর বাংলাদেশের সংবিধানে শ্রমজীবী শ্রেণির সুরক্ষার বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। সংবিধানের অনুচ্ছেদ ১৪-তে বলা হয়েছে, ‘রাষ্ট্রের অন্যতম মৌলিক দায়িত্ব হইবে মেহনতি মানুষকে-কৃষক ও শ্রমিককে-এবং জনগণের অনগ্রসর অংশসমূহকে সকল প্রকার শোষণ হইতে মুক্তি দান করা৷’ সংবিধান প্রত্যেক নাগরিকের পেশা ও বৃত্তির স্বাধীনতা ও জবরদস্তি শ্রম নিষিদ্ধকরণকে মৌলিক অধিকার হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। সংবিধানের ৩৪ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে ‘(১) সকল প্রকার জবরদস্তি-শ্রম নিষিদ্ধ; এবং এই বিধান কোনোভাবে লঙ্ঘিত হইলে তাহা আইনত দণ্ডনীয় অপরাধ বলিয়া গণ্য হইবে। ’  অপরদিকে ৪০ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘আইনের দ্বারা আরোপিত বাধানিষেধ-সাপেক্ষে কোনো পেশা বা বৃত্তি-গ্রহণের কিংবা কারবার বা ব্যবসায়-পরিচালনার জন্য আইনের দ্বারা কোনো যোগ্যতা নির্ধারিত হইয়া থাকিলে অনুরূপ যোগ্যতাসম্পন্ন প্রত্যেক নাগরিকের যেকোনো আইনসঙ্গত পেশা বা বৃত্তি-গ্রহণের এবং যেকোনো আইনসঙ্গত কারবার বা ব্যবসায়-পরিচালনার অধিকার থাকিবে। ’

শ্রমিকদের আইনগত সুরক্ষার জন্য বাংলাদেশ ২০০৬ সালে শ্রম আইন পাশ করেছে। একইসঙ্গে আইনকে কার্যকর প্রয়োগের জন্য ২০১৫ সালে শ্রম বিধিমালা অনুমোদন দিয়েছে। এছাড়া শ্রমিকদের কল্যাণে শ্রমিক কল্যাণ ফাউন্ডেশন আইন ২০০৬ পাশ ও শ্রমিক কল্যাণ ফাউন্ডেশন বিধিমালা ২০১০ অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। এসব আইনের কার্যকর প্রয়োগের লক্ষ্যে পর্যায়ে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে শ্রম আদালত ও শ্রম আপিল আদালত। এসব সার্বজনীন মানবাধিকারের ঘোষণা, আইএলও কনভেনশন এবং দেশের সংবিধান, আইন ও বিধিমালার আলোকে ২০১৫ সালে প্রকাশ করা হয় শ্রমিক অধিকার নির্দেশিকা। তার আলোকে বাংলাদেশে শ্রমিকদের আইনগত অধিকার সমূহ সংক্ষেপে আলোচনা করা হলো।

নিয়োগপত্র, পরিচয়পত্র, সার্ভিস বই: শ্রম আইন অনুযায়ী শ্রমিকদের স্বীকৃত অধিকার সমূহের মধ্যে রয়েছে, মালিক কর্তৃক নিয়োগপত্র, ছবিসহ পরিচয়পত্র এবং নাম, ঠিকানা, যোগদানের তারিখ, ছুটি ইত্যাদি তথ্য সম্বলিত সার্ভিস বইয়ের ব্যবস্থা করতে হবে (ধারা-৫ ও ৬)।

কর্মঘণ্টা ও মজুরি: শ্রমিকের কর্মঘণ্টা হবে দৈনিক ৮ ঘণ্টা এবং সপ্তাহে হবে ৪৮ ঘণ্টা। তবে বাড়তি কর্মঘণ্টার পারিশ্রমিকসহ একজন শ্রমিক দৈনিককে দিয়ে সর্বোচ্চ ১০ ঘণ্টা কাজ করানো যাবে (ধারা ১০০ ও ১০২)। নিম্নতম মজুরি নির্ধারণ করতে হবে, নিম্নতম মজুরির চেয়ে কম মজুরি দেওয়া যাবে না এবং মজুরির ক্ষেত্রে নারী-পুরুষ বৈষম্য করা যাবে না।

ছুটি: ছুটি একজন শ্রমিকের গুরুত্বপূর্ণ আইনগত অধিকার। একজন শ্রমিক সপ্তাহে পূর্ণ একদিন ছুটি পাবেন এবং বছরে কমপক্ষে ১১ দিন বেতনসহ উৎসব ছুটি ভোগ করতে পারবেন (ধারা-১১৮)। চাকরি থেকে অবসর, ছাটাই, ডিসচার্জ বা অবসানকালে ছুটি পাওনা থাকলে শ্রমিক সেই ছুটির মজুরি প্রাপ্য হবেন (ধারা-১১)।

অবসর ও গ্রাচুইটি ও ভবিষ্যৎ তহবিল: কোনো শ্রমিক ভবিষ্যৎ তহবিলের সদস্য হলে চাকরির অবসানকালে তিনি সেই তহবিলসহ অন্য পাওনাদি থাকলে তা ৩০ দিনের মধ্যে ফেরত পাবেন (ধারা ২৯ ও ৩০)। একজন শ্রমিকের স্বাভাবিক অবসরের বয়স হবে ৬০ বছর। এছাড়াও অন্য কোনোভাবে চাকরির অবসান হরেও তাকে শ্রম আইনে প্রাপ্য সুবিধা দিতে হবে। যে কারণেই চাকরি যাক তাকে গ্রাচুইটি ও ভবিষ্যৎ তহবিল থেকে বঞ্চিত করা যাবে না। অবসরকালেও উপযুক্ত মনে করলে তাকে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেওয়া যাবে (ধারা ২৮)। কোনো শ্রমিক দুই বছরের বেশি সময় চাকরি করা কালে মারা গেলে প্রত্যেক বছর ও তার অতিরিক্ত ছয় মাস সময়ের জন্য এক মাসের বেতনের সমপরিমাণ অথবা গ্রাচুইটি যা বেশি হয় তা প্রদান করতে হবে। তবে তিনি কোনো বাধ্যতামূলক বীমা-স্কিমের আওতাভূক্ত হলে এবং ক্ষতিপূরণ দেয়া হলে এর মধ্যে যা বেশি হয় সেটাই দিতে হবে (ধারা ১৯)। চাকরির অবসানের পর তার অভিজ্ঞতা ও দক্ষতার প্রমাণ সম্বলিত একটি প্রত্যয়নপত্র পাবার অধিকারী হবেন (ধারা ৩১)।

নারী শ্রমিকের বিশেষ সুবিধা: কোনো নারীকে বিনা অনুমতিতে রাত ১০টা হতে ভোর ৬টা পর্যন্ত কোনো কাজ করতে দেওয়া যাবে না (ধারা ১০৯)। নারী শ্রমিক সন্তানসম্ভবা হলে সন্তান প্রসবের পূর্বে ৬ মাস কাজ করলে তিনি প্রসবের আগে ও পরে ৮ সপ্তাহ করে প্রসূতিকালীন সুবিধা পাবার অধিকারী হবেন (ধারা-৪৬)।

সুস্থ কর্মপরিবেশ: সুস্থ্য কর্মপরিবেশের জন্য প্রতিষ্ঠানের পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা ও পর্যাপ্ত বায়ু চলাচলের সুবিধা থাকতে হবে। এছাড়া ধুলোবালি ও ধোঁয়া থেকে সুরক্ষা, বর্জ্য অপসারণ, অতিরিক্ত ভিড় এড়ানো, পান করার ব্যবস্থা, প্রস্রাব-পায়খানার ব্যবস্থা এবং আবর্জনা ও পিকদানির ব্যবস্থা থাকতে হবে (ধারা ৫১ ও ৬০)।   প্রাথমিক চিকিৎসা সুবিধা, ক্যান্টিন ও শিশু কক্ষের ব্যবস্থা থাকতে হবে ( ধারা ৮৯, ৯২ ও ৯৪) ।

দুর্ঘটনা রোধ ও ক্ষতিপূরণ: কারখানায় দুর্ঘটনা রোধে পর্যাপ্ত ব্যবস্থা থাকতে হবে। ভবন ও যন্ত্রপাতির নিরাপত্তা, অগ্নিকাণ্ড সম্পর্কে সতর্কতা অবলম্বন, চোখের নিরাপত্তা, বিপজ্জনক ধোয়াসহ যন্ত্রপাতি ব্যবহারে নিরাপদ ব্যবস্থা থাকতে হবে। চাকরি চলাকালে দুর্ঘটনার শিকার হলে মালিককে আইন অনুযায়ী ক্ষতিপূরণ দিতে হবে (ধারা ১৫০, ১৫১)।

ট্রেড ইউনিয়ন গঠন: শ্রমিক ও মালিকের সম্পর্ক অথবা শ্রমিক ও শ্রমিকের সম্পর্ক নিয়ন্ত্রণ করার লক্ষ্যে কোনো পার্থক্য ছাড়াই সকল শ্রমিকের ট্রেড ইউনিয়ন গঠন এবং নিজস্ব পছন্দের ট্রেড ইউনিয়নে যোগদানের অধিকার থাকবে (ধারা ১৭৬)।

আইনে যে অধিকার ও সুরক্ষার কথা থাকুক না কেন, অনেক ক্ষেত্রে শ্রমিককে সেই অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হয়। অনেক সময় অধিকার চাইতে গিয়ে আইনগত হয়রানি বা মামলা-মোকদ্দমার মুখোমুখিও হতে হয়। মনে রাখতে হবে শ্রমিক উৎপাদনের মূল উপাদান। তাই শ্রমিকের অধিকার ও নিরাপত্তা ছাড়া কখনও মালিকের নিরাপত্তা নিশ্চিত হবে না। স্থিতিশীল অর্থনীতি ও টেকসেই উন্নয়নের জন্য মালিক-শ্রমিক বোঝাপড়া এবং শ্রমিকের প্রাপ্য অধিকার নিশ্চিত করা সবার আইনগত ও নৈতিক দায়িত্ব।

লেখক: অ্যাডভোকেট, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট।    

বাংলাদেশ সময়: ১৯৪৭ ঘণ্টা, মে ১, ২০২৪
কেআই/এমজে

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।