ঢাকা, শনিবার, ১৩ পৌষ ১৪৩১, ২৮ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৫ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

মুক্তমত

মন্ত্রীদের সাংবাদিক খেদানো ‘ভদ্রতা’

সৈকত হাবিব, ফিচার এডিটর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১১৪৯ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ১৩, ২০১১
মন্ত্রীদের সাংবাদিক খেদানো ‘ভদ্রতা’

[আমার এই সামান্য রচনাটি দুই ‘অসামান্য ব্যক্তিত্ব’ নৌমন্ত্রী শাজাহান খান ও যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেনকে নিবেদিত। ]

মূলকথায় যাবার আগে একটা ছোট্ট গল্প বলে নেওয়া যাক।

ইংল্যান্ডের রাজসভার এক অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত হয়েছেন একজন কবি। তিনি তথাকথিত অভিজাত ছিলেন না, বরং নিজের প্রতিভায় সম্মানিত হয়েছেন। কিন্তু এই ব্যাপারটি পছন্দ হয়নি এক ‘অভিজাত’ লর্ডের। তিনি কবিকে এক হাত দেখে নেবার মানসে ডেকে ফোঁড়ন কাটলেন, ‘আচ্ছা, আপনার বাবা তো ভদ্রলোক ছিলেন না, তাই না?’ লর্ড মহোদয় বুঝতে পারেননি কবির ব্যঙ্গ কত তির্যক হতে পারে। কবি শুধু বললেন, ‘আপনার বাবা কিন্তু ভদ্রলোক ছিলেন!’

পাঠক, কী বুঝলেন?

আমরা প্রায়শই দেখি, কী ক্ষমতাসীন দল আর কী বিরোধী দল, গণমাধ্যম যখন তাদের দায়িত্ব-কর্তব্য, ক্ষমতা আর ‘ভদ্রলোকী’ ভান সম্পর্কে নেহায়েত  বাধ্য হয়েই প্রশ্ন তোলে, তখন তারা তেলেবেগুনে জ্বলে ওঠেন। তাদের প্রতিক্রিয়া ও আক্রোশ ভদ্রতা ও ভব্যতার সব মাত্রা ছাড়িয়ে যায়। ভাবখানা এমন, যেন সব সাংবাদিক তাদের কেনা গোলাম, তাদের সঙ্গে যাচ্ছেতাই ব্যবহার করা যায়।

তারা নিজের দলের অধস্তনদের কাছ থেকে যে তোষামোদি পেয়ে থাকেন, মনে করেন সাংবাদিকরাও তা করবেন। অথচ তারা একবারও ভাবেন না, আজ তারা যে মন্ত্রী-এমপি বা সরকারের বড় বড় পদাধিকারী, তার নেপথ্যে মিডিয়া ও সাংবাদিকদের সমালোচনামূলক ভূমিকা সবচে বেশি। কারণ পূর্ববর্তী ক্ষমতাসীনদের অন্যায় ও অপব্যবহার আর দুর্নীতির বিরুদ্ধে জনমত গঠন করার কারণেই আজকের ক্ষমতাবানরা ‘মহিমান্বিত’।

আমাদের এই মহামতিরা একটু ভাবেন না, তারা যেভাবে মিডিয়াকে নিজের স্বার্থে ব্যবহার করতে চান, সেটাই যদি হতো তাহলে ইংরেজদের হাত থেকে স্বাধীন ভারত-পাকিস্তান, পাকিস্তানিদের হাত থেকে স্বাধীন বাংলাদেশ, কিংবা স্বৈরাচারের হাত থেকে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার হতো না। আজ আপনারা যারা মন্ত্রী-এমপি কিংবা বিপুলভাবে ক্ষমতাবান, তাদের কপালে এই শিকে না-ও ছিঁড়তে পারত।

মিডিয়াকে সমঝে দেবার এই অভ্যেসটি আসলে স্বৈরাচার আর দুর্নীতিবাজ আর লুটেরাদের কৌশল, যারা জনগণকে অন্ধকারে রেখে নিজেদের ফায়দা লুটতে চায়। এটা কোনো গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার আচরণ কোনোভাবেই হতে পারে না। আর যদি গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় এমনটি ঘটে তাহলে বলতেই হবে ওটা আসলে গণতন্ত্রের মোড়ক আর যারা এই ‘গণতন্ত্রের’ ধ্বজাধারী তারা আসলে এক-একজন ছদ্মবেশী স্বৈরাচারমাত্র।

কেন এসব কথা? তাহলে একটি খবরের অংশবিশেষ দেখুন : ‘দেশের সড়ক যোগাযোগ ও সড়কের জীবননিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়ে সাম্প্রতিক সময়ে ব্যাপক আলোচনার মধ্যে রোববার ‘জাতীয় সড়ক নিরাপত্তা কাউন্সিলের’ ২০তম সভার আয়োজন করে যোগাযোগ মন্ত্রণালয়।

ওই অনুষ্ঠানের সংবাদ সংগ্রহের জন্য যোগাযোগ মন্ত্রণালয় থেকে শনিবার বিভিন্ন গণমাধ্যমে আমন্ত্রণপত্র পাঠানো হয়। সরকারি স্মারক নম্বরের চিঠিতে আমন্ত্রণ পাঠানো হলেও অনুষ্ঠানস্থল থেকে ‘একপ্রকার অপমান’ করেই বের করে দেওয়া হয় সাংবাদিকদের।

আমন্ত্রণকারী যোগাযোগমন্ত্রী  সৈয়দ আবুল এবং পরিবহন শ্রমিকদের নেতা ও নৌমন্ত্রী শাজাহান খান দুর্ব্যবহার করে রেল ভবনের মিলনায়তন থেকে সাংবাদিকদের একপ্রকার জোর করেই এদিন বের করে দেন। ’

আসুন আমরা আরও একটু জানি : ‘রেলভবনের অডিটোরিয়ামে সকাল সাড়ে দশটায় অনুষ্ঠান শুরুর নির্ধারিত সময়ের আগেই অতিথিসহ সাংবাদিকরা সেখানে যেতে শুরু করেন। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন, স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শামসুল হক টুকু এদিন বৈঠকে আমন্ত্রিত ছিলেন। তারাও নির্ধারিত সময়ে আসেন।

অনুষ্ঠানের সভাপতি যোগাযোগমন্ত্রী আবুল হোসেন নির্ধারিত সময়ের আধাঘণ্টার বেশি সময় পরে অনুষ্ঠানস্থলে উপস্থিত হন। যদিও তার অপেক্ষা না করেই অনুষ্ঠান শুরু করে দেওয়া হয়। জাতীয় কমিটির সভার শুরুতে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান তাদের নেওয়া বিভিন্ন পদক্ষেপের বিবরণ দিয়ে অনুষ্ঠান শুরু করেন।

সব ঠিকঠাকই চলছিল।

কিন্তু মন্ত্রী আবুল হোসেন আসার পরেই যেন ব্যত্যয় ঘটে। তিনি আসার পর মন্ত্রীর বেশে থাকা পরিবহন শ্রমিক নেতা শাজাহান খান কী যেন বললেন আবুল হোসেনকে। তার পরেই শাজাহান হেঁকে উঠে বললেন, ‘সাংবাদিকরা এই সভায় থাকতে পারবেন না। বাইরে যান। ’

সাংবাদিকরা তার কথার প্রতিবাদ জানালে তিনি বলেন, ‘এটি কোনও জনসভা নয়, তাহলে তো পল্টনেই করতাম। ’  

নৌমন্ত্রী এভাবে কথা বলতে শুরু করলে সাহারা ও টুকুও তার পক্ষে অবস্থান নিয়ে বলেন, ‘আপনাদের চলে যাওয়ার অনুরোধ করছি। ’

সাংবাদিকরা এর আগের বৈঠকের কথা উল্লেখ করে বলেন, ‘সাম্প্রতিকতম সময়ে এ ধরনের বৈঠকের ব্যাপারে মানুষের আগ্রহ রয়েছে। ’ সভার সংবাদ সংগ্রহের জন্য যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের আমন্ত্রণপত্রের ভিত্তিতেই এখানে এসেছেন জানালে সাংবাদিকদের যোগাযোগমন্ত্রী বলেন, ‘এটি আমাদের ভুল হয়ে গেছে। ’ (সূত্র : বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম)

বুঝুন অবস্থা। ডেকে নিয়ে এ অপমানের মধ্যে কোন্ মাজেজা নিহিত?

সাম্প্রতিককালে পরিবহন শ্রমিকনেতা নৌমন্ত্রীর হঠকারী মন্তব্য আর যোগাযোগমন্ত্রীর বেহাল যোগাযোগ এবং সড়ক দুর্ঘটনায় দেশের দুই মেধাবী সন্তান তারেক মাসুদ ও মিশুক মুনীরসহ অনেকের মৃত্যু গোটা দেশকে নাড়া দিয়েছে। আর মিডিয়া সেটাই যথাযথভাবে তুলে ধরার চেষ্টা করেছে। কিন্তু এতে তারা উভয়েই বেশ নাখোশ হয়েছেন। তারা মনে করছেন, তাদের অক্ষমতা ও হঠকারিতা তুলে ধরে মিডিয়া বাড়া ভাতে ছাই দিয়েছে। ফলে এক ধরনের ‘বদলা’ হিসেবেই যেন সাংবাদিকদের তারা ছবক দিতে চেয়েছেন। কিন্তু অন্ধ হলেই কি প্রলয় বন্ধ থাকে?  

প্রিয় মন্ত্রীদ্বয়, সাংবাদিক হিসেবে আমাদের দুঃখ কী জানেন, ক্ষমতায় গেলে আপনারা ‘বিচার মানি কিন্তু তালগাছটা আমার’ নীতিতে চলে যান। এবং বন্ধুকেও শত্রুজ্ঞান করেন। এটা কি ক্ষমতার উত্তাপ নাকি ব্যক্তিগত জীবনে গণতন্ত্র চর্চা না করার মানসিকতা ? অথচ ক্ষমতা জিনিসটা যে বড় অস্থায়ী, সেটা আপনাদের চেয়ে ভালো কে জানে? আর যখন ক্ষমতার বাইরে থাকেন, তখন আমরা আপনাদের খুব কাছের মানুষ হয়ে উঠি। কারণ, তখন আপনাদের পাশে মিডিয়াই দাঁড়ায়। এবং মিডিয়ার এই ভূমিকায় আপনারা অতি সন্তোষ বোধ করে থাকেন।      

গণতন্ত্রের যে কটি পূর্বশর্ত তার মধ্যে ব্যক্তিজীবনে পরমতসহিষ্ণুতার চর্চা, অপরের স্বাধীনতায় বিশ্বাস, গঠনমূলক সমালোচনার অধিকার আর গণমাধ্যমের স্বাধীনতা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কেননা গণতান্ত্রিক শাসকগোষ্ঠী দেশের নানা পথ ও মতের স্বাধীন মানুষের বিপুল ভোটে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিমাত্র। তাদের সব ক্ষমতা গণমানুষের আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন সংবিধান এবং যথাযথ আইনের মধ্য দিয়ে সীমাবদ্ধ। ফলে তারা যে ধরনের দায়িত্ব-কর্তব্য পালন ও ক্ষমতার প্রয়োগ করবেন, তা অবশ্যই হবে জনগণের কাছে জবাবদিহিমূলক। কিন্তু জনগণ জনে জনে এসে তাদের কাছে জবাবদিহি চাইবেন না, বা বাস্তবে তা সম্ভবও নয়। গণতান্ত্রিক দেশে সে কাজটিই করে থাকে গণমাধ্যম। আর একটি গণতান্ত্রিক দেশে  প্রকৃত গণমাধ্যমের কাজ জনগণের মতের প্রতিফলন ঘটানো। অন্যদিকে রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারকরা কী করছেন, কীভাবে করছেন, কতটা করছেন; তারা যেসব পরিকল্পনা করছেন তার কতটা বাস্তবায়ন হচ্ছে; তারা যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন/দিচ্ছেন, তার কতটা বাস্তবায়ন করছেন; তারা নেতা হিসেবে দলের জন্য আর রাষ্ট্রের প্রতিনিধি হিসেবে দেশের জন্য  কী কাজ করছেন; তারা তাদের ওপর ন্যস্ত ক্ষমতার কতটা ব্যবহার/অপব্যবহার করছেন-- মোটকথা মিডিয়া পর্যবেক্ষকের ভূমিকা পালন করে থাকে। গণমাধ্যমকে যে চতুর্থ রাষ্ট্র বলা হয় সেটি এমনি এমনি নয়, বরং তার এই দায়িত্বশীলতার জন্যই।

কিন্তু আপনারা কী করলেন? দেশের এই মুহূর্তের একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু, যে বিষয়ে দেশের প্রায় প্রতিটি নাগরিকের স্বার্থ জড়িত, তার কাজ করার ক্ষেত্রে সাংবাদিকদের কেবল বাধাই দিলেন না, অপমানিতও করলেন, তাদের ‘শিক্ষা’ দিতে চাইলেন। খুব ভালো কথা।

দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, ইতিহাস থেকে কেউ শিক্ষা নেয় না। আপনারাও নেবেন না। আর এই মুহূর্তে তার দরকারও নেই। সরকারি, দলীয় ও সাংগঠনিক ক্ষমতাই আপনাদের উদ্ধার করবে। কিন্তু যখন আপনারা মন্ত্রী থাকবেন না, তখনও এই সাংবাদিকরা থাকবেন। আর আপনাদের এই ‘ভদ্রটা’টুকুও তাদের মনে থাকবে।

আপনারা যে ‘ভদ্রলোক’, এটা অস্বীকার করার ‘ক্ষমতা’ আছে কার?

saikathabib@gmail.com

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।