ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১২ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৮ নভেম্বর ২০২৪, ২৬ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

মুক্তমত

‘মাস্টার সাব আমি নাম দস্তখত শিখতে চাই’

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৫১০ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ৮, ২০১৭
‘মাস্টার সাব আমি নাম দস্তখত শিখতে চাই’ চাই সবার জন্য শিক্ষা

সদ্যপ্রয়াত নায়করাজ রাজ্জাক ১৯৭৯ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘অশিক্ষিত’ নামের একটি চলচ্চিত্রে গেয়েছিলেন, ‘মাস্টার সাব আমি নাম দস্তখত শিখতে চাই/কোনোদিন কেউ যেন বলতে না পারে তোমার ছাত্রের বুদ্ধি নাই।’

রাজ্জাক সেই সিনেমায় রহমত ভাই চরিত্রে অভিনয় করেন। দ্বৈতকণ্ঠে তার সঙ্গে ছিলেন মাস্টার সুমন নামের একজন শিশুশিল্পী, যে তার রহমত ভাইকে অক্ষর-জ্ঞানসম্পন্ন মানুষ বানাতে চায়।

‘অশিক্ষিত’ নামের সেই চলচ্চিত্রে গীত গানটির মূল বক্তব্যে বলা হয়েছিল--
‘রহমত ভাই তোমায় নাম দস্তখত শেখাতে চাই
কোনোদিন কেউ যেন বলতে না পারে তোমার কোনো বিদ্যা নাই,
বিদ্যা বড় অমূল্য ধন সবার চেয়ে দামি
তোমার কাছে পড়তে এসে জেনেছি তা আমি
লেখা-পড়া শিখে তুমি মানুষ যখন হবে
মরে গেলে দুনিয়াতে মনে রাখবে সবে
শিক্ষা-দীক্ষায় বড় যারা দেশের ও দশের মাথা তারা
এই কথাটি কাজে কর্মে মনে রেখ তাই
ও রহমত ভাই...

এই গানের জন্য জনপ্রিয় চলচ্চিত্রটির মুক্তির ১৩ বছর আগে ১৯৬৬ সাল থেকে ইউনেস্কো ৮ সেপ্টেম্বরকে আন্তর্জাতিক স্বাক্ষরতা দিবস হিসেবে পালন করে আসছে। এ দিবসটি পালনের মাধ্যমে সারাবিশ্বের মানুষকে তারা বলতে চায়, স্বাক্ষরতা একটি মানবীয় অধিকার এবং সর্বস্তরের শিক্ষার ভিত্তি। প্রতিবছর একটি বিশেষ প্রতিপাদ্যকে সামনে রেখে স্বাক্ষরতা দিবস পালন করা হয়। ‘অশিক্ষিত’ চলচ্চিত্রের পোস্টারস্বাক্ষরতা আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত মানবীয় অধিকার হিসেবে বিশ্বে গৃহীত হয়ে আসছে। এটি ব্যক্তিগত ক্ষমতায়ন এবং সামাজিক ও মানবীয় উন্নয়নের হাতিয়ার হিসেবে গ্রহণযোগ্য। এমনকি শিক্ষার সুযোগের বিষয়টি পুরোপুরি নির্ভর করে স্বাক্ষরতার ওপর। স্বাক্ষরতা মৌলিক শিক্ষার ভিত্তি হিসেবেও কাজ করে। দারিদ্র্য হ্রাস, শিশু মৃত্যুর হার হ্রাস, সুষম উন্নয়ন এবং শান্তি ও সমৃদ্ধি বিকশিতকরণের ক্ষেত্রেও স্বাক্ষরতা প্রয়োজনীয় হাতিয়ার হিসেবে গণ্য হয়।  

‘সবার জন্য শিক্ষা’ শীর্ষক স্লোগান বাস্তবায়ন করতে স্বাক্ষরতাকে ভিত্তি হিসেবে মনে করার পেছনে যথেষ্ট কারণ রয়েছে। একটি মানসম্মত মৌলিক শিক্ষা মানুষকে স্বাক্ষরতা ও দক্ষতার সঙ্গে তৈরি করতে সহায়তা করে। অক্ষর-জ্ঞানসম্পন্ন মা-বাবা তাদের সন্তানদের বিদ্যালয়ে পাঠাতে উৎসাহিত হন, অব্যাহত শিক্ষায় নিজেকে প্রবেশে প্রণোদনা ও উৎসাহ পান এবং উন্নয়নের দিকে সমাজ ও দেশকে ধাবিত করার ক্ষেত্রে মানবসম্পদ রূপে সাহায্য করেন।

দেশে দেশে স্বাক্ষরতার সংজ্ঞা অনেক আগে থেকে প্রচলিত থাকলেও ১৯৬৭ সালে ইউনেস্কো প্রথম স্বাক্ষরতার সংজ্ঞা চিহ্নিত করে এবং পরবর্তী সময়ে প্রতি দশকেই এই সংজ্ঞার রূপ পাল্টেছে। এক সময় কেউ নাম লিখতে পারলেই তাকে স্বাক্ষর বলা হতো, কিন্তু বর্তমানে স্বাক্ষর হিসেবে চিহ্নিত করার জন্য অন্তত তিনটি শর্ত মানতে হয়। এগুলো হলো, ব্যক্তি নিজ ভাষায় সহজ ও ছোট বাক্য পড়তে পারবে, সহজ ও ছোট বাক্য লিখতে পারবে এবং দৈনন্দিন জীবনে সাধারণ হিসাব-নিকাশ করতে পারবে। এই প্রত্যেকটি কাজই হবে ব্যক্তির প্রাত্যহিক জীবনের সঙ্গে সম্পর্কিত।

সারাবিশ্বে বর্তমানে এই সংজ্ঞাকে ভিত্তি করে স্বাক্ষরতার হিসাব-নিকাশ করা হয়। ১৯৯৩ সালে ইউনেস্কো এই সংজ্ঞাটি নির্ধারণ করে; তবে বর্তমানে এটিও চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে। অনেক আন্তর্জাতিক ফোরাম বা কনফারেন্স থেকে স্বাক্ষরতার সংজ্ঞা নতুনভাবে নির্ধারণের কথা বলা হচ্ছে, যেখানে স্বাক্ষরতা সরাসরি ব্যক্তির জীবনযাত্রা পরিবর্তনের সঙ্গে সম্পর্কিত হবে। তথ্য-প্রযুক্তিগত মৌলিক জ্ঞান ও দক্ষতার বিষয়টিগুলোও এক্ষেত্রে প্রাধান্য বা অগ্রাধিকার পাচ্ছে।

কারণ, স্বাক্ষরতার বহুবিধ ব্যবহারের মাধ্যমে মানুষের মধ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব। শুধু স্বাক্ষরতার মাধ্যমে অর্থনৈতিক মুক্তিই নয়; বরং সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও মানসিক মুক্তি আনয়নের মাধ্যমে প্রাত্যহিক জীবনে শান্তি প্রতিষ্ঠা করাই এর লক্ষ্য। কেননা স্বাক্ষরতা শান্তি স্থাপনে অবদান রাখে এবং মানুষের ব্যক্তিগত স্বাধীনতা অর্জনে সহায়তা করে। শুধু তা-ই নয়, বিশ্ব সম্পর্কে ভালো ধারণা অর্জনেও স্বাক্ষরতা কাজ করে। যিনি লিখতে ও পড়তে পারবেন, এক মাত্র তিনিই জানবেন দেশ ও দেশের বাইরে কোথায় কী ঘটছে। এটি এমন একটি মাধ্যম, যা পারস্পরিক দ্বন্দ্ব ও সংঘাত নিরসন এবং প্রতিরোধেও সহায়তা করে। স্বাক্ষরতার সঙ্গে শান্তির সম্পর্ক বা যোগাযোগ এতটাই বেশি যে, অস্থিতিশীল, অগণতন্ত্রকামী এবং সংঘাতপূর্ণ দেশগুলোতে স্বাক্ষরতার পরিবেশ প্রতিষ্ঠিত করা কিংবা বজায় রাখা জরুরি বলে বিবেচিত হয়। উন্নয়নের জন্য স্বাক্ষরতাকে মূল শর্ত ধরা হয়।

বাংলাদেশে স্বাক্ষরতার হার কত—এই প্রশ্নে সঠিক তথ্য পাওয়া যায় না।  সরকারি ও বেসরকারি হিসাবেও আছে বিস্তর গরমিল। সরকারিভাবে বলা হয়, দেশে স্বাক্ষরতার হার ৬৫ শতাংশ। অন্যদিকে, বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো বা বিবিএসের জরিপ অনুযায়ী, ২০১২ সালে ১৫ বছরের বেশি বয়সীদের স্বাক্ষরতার হার ছিল ৬০.৭ শতাংশ, ২০১১ সালে ছিল ৫৮.৮ শতাংশ, ২০১০ সালে ৫৮.৬ শতাংশ। আর ২০০৯ সালে ছিল ৫৮.৪ শতাংশ। বিবিএসের হিসাব বলছে, গত পাঁচ বছরে স্বাক্ষরতার হার আমরা বাড়াতে পেরেছি মাত্র ৩ শতাংশ। এভাবে চললে, দেশটি পুরো নিরক্ষরতামুক্ত করতে একুশ শতক পার করতে হবে।

ইউনিসেফের তথ্য অনুযায়ী, ১৯৭১ সালে আমরা যখন স্বাধীনতা লাভ করি, তখন দেশে স্বাক্ষরতার হার ছিল ১৬.৮ শতাংশ। ১৯৭৪ সালে স্বাক্ষরতার হার দাঁড়ায় ২৫.৯ শতাংশ। ১৯৯১ ও ২০০১ সালে সেই হার দাঁড়ায় যথাক্রমে ৩৫.৩ শতাংশ ও ৪৭.৯ শতাংশ। ২০১০ সালে স্বাক্ষরতার জরিপে ৫৯.৮২ শতাংশে পৌঁছানোর কথা বলা হয়েছিল। কিন্তু ততটুকু উন্নতি করা সম্ভব হয়নি।

দক্ষিণ এশিয়ার প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে স্বাক্ষরতার হার তুলনাকালে দেখা যায়, ভারতে স্বাক্ষরতার হার ৭৪.৪ শতাংশ, নেপালে ৬৬ শতাংশ, ভুটানে ৬৪.৯ শতাংশ, শ্রীলঙ্কায় ৯৮.১ শতাংশ, আমাদের পেছনে আছে পাকিস্তান (৫৫ শতাংশ) ও আফগানিস্তান (২৪ শতাংশ)। আমাদের আরেক প্রতিবেশী, নানা কারণে বিতর্কিত ও সমালোচিত  মিয়ানমারের স্বাক্ষরতার হারও যথেষ্ট অগ্রসর, ৮৯ শতাংশ।

উন্নয়ন ও শান্তির পূর্বশর্ত শিক্ষা
স্বাক্ষরতা একটি দেশের শান্তি ও অগ্রগতির জরুরি শর্ত। পৃথিবীতে এমন একটি দেশও নেই যে শতভাগ স্বাক্ষর হয়েও গরিব কিংবা অশান্ত অথবা পশ্চাৎপদ। উন্নত ও সমৃদ্ধ প্রতিটি দেশই আগে শতভাগ বা তার কাছাকাছি স্বাক্ষর হয়েছে, তারপর উন্নতি করেছে।  

আর আমরা? দেশের ৩৯ শতাংশ মানুষকে নিরক্ষর রেখে কেমন করে সামনে উন্নয়নের পথে এগুতে পারি? সরকার ডিজিটাল বাংলাদেশ করার কথা বলছে। কিন্তু সেটি কি বিপুলসংখ্যক মানুষকে নিরক্ষর রেখে সম্ভব?

স্বাক্ষরতার হার বাড়ানোর জন্য গণশিক্ষা, উপানুষ্ঠানিক শিক্ষাসহ নানা উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। সরকারের পাশাপাশি আছে বেসরকারি উদ্যোগও। কিন্তু কোনোটাই আমরা ভালোভাবে করতে পারিনি। বহু ব্যক্তি ও পরিবার এখনো রয়েছে অজ্ঞতার গভীর অন্ধকারে।

২০০৮ সালের নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগ যে নির্বাচনী ইশতেহার ঘোষণা করেছিল, তাতে শিক্ষা ও বিজ্ঞান অনুচ্ছেদে বলা হয়: ‘২০১০ সালের মধ্যে প্রাথমিক স্তরে নিট ভর্তি ১০০ শতাংশে উন্নীত করা এবং ২০১৪ সালের মধ্যে দেশকে নিরক্ষরতামুক্ত করা হবে। ’

এখন ২০১৪ নয়, ২০১৭ সাল। কিন্তু আমরা স্বাক্ষরতার হার শতভাগ দূরের কথা, আশানুরূপ পর্যায়েও পৌঁছাতে পারিনি।  দেশকে নিরক্ষরতামুক্ত করা এখনো অধরা স্বপ্ন হয়েই রয়েছে।  আমরা জানি না, দেশে সেই দিন কবে আসবে, যখন একজন লোকও বলবে না, ‘মাস্টার সাব আমি নাম দস্তখত শিখতে চাই’।  

লেখক
ড. মাহফুজ পারভেজ
কবি, গল্পকার, শিক্ষাবিদ এবং অধ্যাপক, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

বাংলাদেশ সময়: ২০৪০ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ০৮, ২০১৭
এইচএ/

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।