ঢাকা, বুধবার, ২৭ কার্তিক ১৪৩১, ১৩ নভেম্বর ২০২৪, ১১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

মুক্তমত

দিবানিদ্রা ভঙ্গ করিয়া টাইমবোমায় জল সিঞ্চনই শ্রেয়

সাইফুদ্দিন আহমেদ নান্নু, অতিথি কলামিস্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৪৪০ ঘণ্টা, অক্টোবর ১৬, ২০১১
দিবানিদ্রা ভঙ্গ করিয়া টাইমবোমায় জল সিঞ্চনই শ্রেয়
পদাধিকার বলে জ্ঞানী নই বলে আমার কথার বাজারমূল্য হয়তো নেই। তবুও বলি, আমি একটি টাইমবোমার টিক্-টিক শব্দ শুনতে পাচ্ছি।
এ  শব্দ ক্রমশ স্পষ্টতর হচ্ছে। বোমাটির ধ্বংসক্ষমতার সর্বোচ্চ মাত্রাটা জানি না ,তবে এটা নিশ্চিত জানি একটা বড় ধাক্কা সমাগত। যাদের দেয়ালে এ ধাক্কাটা প্রথমেই আছড়ে পড়বে তারা এখনও আত্মতুষ্টিতে নিমগ্ন, বিজয়ানন্দে উদাসীন। অথচ সময়ের ঘড়ি চিতার ক্ষিপ্রতায় শেষ প্রান্তের দিকে নিঃশব্দে ছুটছে।  

এ টাইমবোমার উৎস বঙ্গোপসাগরের গভীরে নয়, নয় সুন্দর বনের শ্যামল অরণ্য।   বোমাটির ডেটনেটর, টাইমার সক্রিয় হয়ে টিক টিক করে বাজছে উপজেলা পরিষদের নির্বাচিত চেয়ারম্যানদের মনোজগতে। অপমান-অবহেলা, উপেক্ষা, আশাভঙ্গ আর বঞ্চনার আতুর ঘরে এ বোমার জন্ম। প্রচণ্ড ক্ষোভের প্রশমন এবং প্রতিশোধের বাঁশিটা নিজ হাতে বাজানোর  জৈবিক তাড়না থেকে এ বোমা বিস্ফোরিত হবে রাজনীতির অস্থির এক সময়ে। আর এ  বিস্ফোরণের প্রত্যক্ষ আঘাত প্রথমে আছড়ে পড়বে আমলাতন্ত্রের মাঠপর্যায়ের প্রতিনিধি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদের মসনদে, এরপর সরকারের শক্তির দুয়ারে। এ আমার শংকা এবং উদ্বেগ। কেন এ শংকা এ প্রশ্ন থাকতেই পারে। সেজন্যে  বলে নেওয়া ভাল যে, আমরা সহজেই সব ভুলে যাই। আর ভুলে যাই বলেই একটু পিছন ফিরে পুরনো কাঁসুন্দি ঘাঁটা  প্রয়োজন, নইলে এ শংকার হেতু মিলবে না।

কমবেশি সবারই মনে থাকবার কথা,এক এগারো পরবর্তী ফখরুদ্দিন সরকার, প্রভুবৎ দাতাগোষ্ঠি এবং ড্রইংরুমবিলাসী সুশীল সমাজ,এ তিনচক্র মিলে স্থানীয় সরকারের হবু জনপ্রতিনিধিদের মনে জাগিয়ে দিলেন দিগ্বিজয়ের স্বপ্ন। স্থানীয় সরকার ব্যবস্থার দ্বিতীয় স্তর উপজেলা পরিষদকে কাঁদামাটির খাড়ি থেকে একটানে তুলে আনলেন এবং সোজা ছেড়ে দিলেন হাইস্পিড হাইওয়ের পিচঢালা পথে। রুগ্ন ও মৃতকল্প একজন মানুষকে তার মরণশয্যা থেকে একটানে হিমালয়ের চূড়ায় বসিয়ে দেওয়ার মত অবস্থা।   উপজেলা পরিষদ এবং তার হবু চেয়ারম্যানদের বিস্তর ক্ষমতার অধিশ্বর করে জারি করা হল ‘উপজেলা পরিষদ অধ্যাদেশ- ২০০৮’। মাঠ পর্যায়ের ডাকসাইটে শত শত রাজনৈতিক নেতা, সামাজিক ব্যক্তিত্ব, বিত্তের বেপারীরা আনন্দে মাতোয়ারা হয়ে ঝাঁপিয়ে পড়লেন বিপুল ক্ষমতার অধিশ্বর উপজেলা চেয়ারম্যান পদে নির্বাচিত হতে। গ্রাম-জনপদ চষে, কোটি  টাকা বিনিয়োগ করে আর বাড়ি বাড়ি ভোট ভিক্ষা চেয়ে অর্জন করলেন ‘উপজেলা চেয়ারম্যান, অথবা ‘ভাইস চেয়ারম্যানের’ তখ্ত। সম্ভাব্য এক নবশক্তির আড়ম্বরপূর্ণ উত্থান । অপেক্ষা শুধু অধ্যাদেশের আইনি রূপান্তরের । তাহলেই  বনে যাওয়া যাবে উপজেলার ভাগ্যবিধাতা। মানুষ ভাবে এক হয় আরেক । অধ্যাদেশের আইনি রূপান্তর এমন কায়দায় ঘটলো যাকে ‘পর্বতের মুসষক প্রসব’ বললেও বেশি  বলা হয়। বজ্রাহত বৃক্ষের ন্যায় থমকে গেলেন নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা।

বিচার বিভাগ পৃথকীকরণের ফলে ক্ষমতাহীন হয়ে পড়া আমলাতন্ত্র মাঠপর্যায়ে তাদের প্রভুত্ব জিইয়ে রাখার উদগ্র বাসনা পোষন করলেন এবং টি আর, কাবিখা, রাস্তা-সেতু-কালভার্টের ঠিকাদারির নিয়ন্ত্রণ হাতছাড়া হবার ভয়ে সন্ত্রস্থ হয়ে পড়লেন বর্তমান জাতীয় সংসদের সদস্যগণ। স্বার্থরক্ষায় এমপি এবং আমলারা যুথবদ্ধ হলেন। এদের কম্বিং অপারেশনের মুখে ফখরুদ্দীন সরকার প্রণীত উপজেলা পরিষদ অধ্যাদেশটি হিমালয় থেকে ধপাস করে ভূ-পাতিত হল। ঐ অধ্যাদেশকে কেটে ছেঁটে ‘বামুন’ বানিয়ে বিল আকারে যখন সংসদে পেশ করা হল তখন তা গগণবিদারী ধ্বনি ভোটে পাশও করলেন এমপিরা। সঙ্গে সঙ্গে উপজেলা চেয়ারম্যানদের স্বপ্নসৌধ, হাতেপাওয়া ক্ষমতার কুতুব মিনারটি মোমের মত গলে পড়লো বেদনার সৈকতে। উপজেলা চেয়ারম্যানরা বনে গেলেন নিধিরাম সর্দার। পরের ইতিহাস সবারই জানা, উন্নয়ন কার্যক্রমের স্টিয়ারিং হাতে তুলে নিলেন মাননীয় সংসদ সদস্যবৃন্দ আর আমলাতন্ত্রের পাঠশালার হেডমাস্টার হয়ে উপজেলার প্রশাসনিক ক্ষমতার নাটাই নাচাতে শুরু করলেন ইউএনও সাহেবেরা। বেচারা উপজেলা চেয়ারম্যানদের সান্তনা পুরস্কার হিসেবে কাঠি-লজেন্সের মত হাতে ধরিয়ে দেয়া হল একটি করে জলপাই রঙের পাজেরো গাড়ি। পাজেরোতে চেপে শুধু হাওয়া খাওয়া  ছাড়া  করবার মত কিছুই আর অবশিষ্ট রইল না তাদের। এরপর যথারীতি বাদ-প্রতিবাদ, সভাসমাবেশ, বিবৃতি, আন্দোলনের হুমকি-ধমকিতে মাঠগরম করলেন `উপজেলা ট্র্যাজেডি`র  নায়কেরা । মাঝে মধ্যে তর্জন-গর্জন; আবার সব শান্ত। শুনশান নিরবতা নেমে এল চারিদিকে। এমপিদের ক্ষমতার দাপট আর আমলাদের কূট কৌশলের হুইসেলে থমকে গেলেন আন্দোলনকারী চেয়ারম্যানরা।

বিপদটা ঘটে গেছে এখানেই। আমাদের সদাশয় সরকার,সংসদ সদস্যবৃন্দ এবং আমলাতন্ত্র এই নিরবতাকে ধরে নিলেন শেষ বাঁশি হিসাবে। উপজেলা চেয়ারম্যানদের ক্ষমতা হরণের লড়াই থেকে অর্জিত বিজয়ের  সুখপ্রদ আনন্দে বিভোর হয়ে আছেন এমপি এবং অমলারা। এরা  ভেবে বসে আছেন এ লড়াই শেষ, শত্রু পর্যুদস্ত । এতিম বনে যাওয়া উপজেলা চেয়ারম্যানরা সুবোধ বালকের মত সফেদ পাঞ্জাবি গায়ে চড়িয়ে পাড়া বেড়াচ্ছেন। কোমর সোজা করে দাঁড়ানো তো দূরের কথা স্বপ্ন দেখবারও সাধ্যি এদের আর কস্মিনকালে হবে না।
এ নিরবতা যে প্রবল ঝড়ের পূর্বাভাস সেটি বুঝতে ব্যর্থ হচ্ছেন আমাদের সরকার বাহাদুর, এমপি সাহেব এবং আমলাতন্ত্রের তাবৎ কুশীলবরা । ব্যর্থ হচ্ছেন বলছি এ জন্য যে, বর্তমান সরকারের ক্ষমতার মেয়াদের অর্ধকাল পেরিয়ে গেছে অথচ উপজেলা চেয়ারম্যানদের ছিটেফোঁটা দাবি পূরণের কোনও আয়োজন এমন কি লক্ষণও কোথাও নেই । চেয়ারম্যানরা যে জমিদারী চাইছেন সেই জমিদারী না হোক মুখরক্ষার জন্য নিদেন পক্ষে একখণ্ড ভিটেমাটির ব্যবস্থাতো সরকার করতে পারতেন, কিন্তু করেনি। বসতবাড়ি বলতে আমি কিন্তু পাজেরো গাড়ির মত প্লট কিংবা বাড়ির কথা  বলছি না। উপজেলা প্রশাসন পরিচালনার দৃশ্যমান কিছু প্রশাসনিক ক্ষমতা এবং কিছু উন্নয়ন কার্যক্রমের কর্তৃত্ব এদের উপর ছেড়ে দিলে এমপি সাহেব এবং আমলাতন্ত্রের বাড়াভাতে ছাই নিশ্চই পড়তো না। অথচ বঞ্চিত-ক্ষুব্ধ চেয়ারম্যনদের ক্ষোভ,যন্ত্রনা বঞ্চনার কিছুটা  উপশম হলেও হত। কিন্তু নিরঙ্কুশ সংসদীয় ক্ষমতা এবং কর্তৃত্ববাদী আমলাতন্ত্র এর কোনটা  না করে নিরুদ্বিগ্ন বসে আছে। আগামীতে যে কটা দিন হাতে আছে সে দিনগুলিতেও  করবে বলে  মনে হয় না। আর ক্ষমতার শেষ প্রান্তে এসে ছিটেফোঁটা দক্ষিণায়  চিড়ে ভিজবে না।     

সরকার এবং সরকারের বুদ্ধিদাতারা ধরে নিয়েছেন, তৃণমূল জনগোষ্ঠির সাথে সরাসরি সম্পৃক্ত এই জনপ্রতিনিধিরা তাদের মেয়াদের শেষ দিন পর্যন্ত এমনই সুবোধ হয়েই থাকবেন এবং  পরবর্তী  নির্বাচনে দাঁড়িয়ে নিজেদের আবারও নিধিরাম সর্দারের আসনে সমাসীন করবেন। এমন অংক দেখতে সরল হলেও আসলে কিন্তু সরল নয়। রাজধানীর বাইরে বসতি বলে আমি  টের পাই ক্ষমতা কেড়ে নেবার অপমান এবং যন্ত্রনায় এরা পলে পলে দগ্ধ হচ্ছেন,ফুঁসছেন। সামান্য পাজেরোর সাধ্য কি এ হিমালয়সম যন্ত্রনার অনলকে নেভায়। এদের অন্তরাত্মা ছাইচাপা আগুনের মত জ্বলছে। এইতো মাত্র কদিন আগে এক খবরে দেখলাম উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যাদের অপেক্ষাকৃত নমনীয় একটি অংশ তাদের পদত্যাগপত্র স্বাক্ষর করে রেখেছেন সম্ভাব্য আন্দোলনের প্রাক প্রস্তুতি হিসেবে।
অন্যদিকে উপজেলা চেয়ারম্যানদের কট্টর এবং বৃহত্তর অংশের নেতারা এ মাসের শেষ সপ্তাহে চূড়ান্ত কর্মপন্থা নির্ধারণের জন্য ঢাকায় বসছেন। এরাই গত বছরের ২ অক্টোবর  ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে আয়োজিত প্রেস কনফারেন্সে আঙ্গুল তুলে বিশুদ্ধ ব্যাকরণে বলেছিলেন “ সরকার এবং প্রশাসনের অভ্যন্তরের বিশেষ একটি গোষ্ঠী পরিকল্পিতভাবে সরকার, উপজেলা পরিষদ এবং জনগণের মধ্যে দূরত্ব সৃষ্টির পাঁয়তারা করছে যা গণতান্ত্রিক সরকারের সফলতার জন্য মোটেই অনুকূল নয়। এই দূরত্বের খেসারত সময় মত দিতে হবে। `
এতো গেল তাদের ব্যাকরণসম্মত ভাবনা। ব্যাকরণবহির্ভূত খেলার কথা খোলাসা করে বলেননি কেউ। বলবার কথাও নয়। লক্ষ্মণ দেখে মনে হচ্ছে সামনে একটি খেলা জাতি দেখতে যাচ্ছে। খেলাটি হবে অগ্নিকুণ্ডে বাযুপ্রবাহের মত।

আমাদের রাজনীতির ময়দান বড় দু`দলের স্বভাবজাত বৈরিতায় এমনিতেই তপ্ত হয়ে ছিল। এর সাথে যুক্ত হয়েছে তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা বাতিল, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার, গ্রেনেড হামলা মামলা, তারেক-কোকোর বিচার প্রসঙ্গ। বর্তমান সরকারের ক্ষমতার মেয়াদ যত কমে আসতে থাকবে বিএনপি-জামাত তত্ত্বাবধায়ক ইস্যুকে সামনে নিয়ে মামলার ফাঁস থেকে বেরিয়ে আসবার জন্য তত তীব্র মরণকামড় দিতে থাকবে। এ লড়াইয়ে পরাজয়ের অর্থ বিএনপি-জামায়াত জানে বলেই এরা থাকবে জানবাজ। এমন ঘোর যুদ্ধের দামমা যখন বেজে উঠবে ঠিক তখনই মাঠে নামবে আপাতঃ শান্ত চেয়ারম্যানরা। সরকারকে বাড়তি চাপে ফেলে নিজেদের দাবিদাওয়া আদায় করে নেবার এটাই হবে মোক্ষম সময়।   উপজেলা পরিষদের ক্ষমতায়নের দাবি প্রকাশ্য ইস্যু থাকলেও এদের ভেতরে কাজ করবে এমপি এবং আমলাদের প্রতি প্রতিশোধ পরায়নতা। এর বাইরেও একটি দীর্ঘ মেয়াদী লক্ষ্যও তারা অর্জন করতে চাইবেন।   সেটি হচ্ছে এবার যারা চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছেন তাদের নব্বই ভাগই আগামী উপজেলা নির্বাচনে দাঁড়াবেন এবং জিতবেন বলে আশাও করেন। সেজন্য  তারা তাদের আগামী মেয়াদের  ক্ষমতাকে  নিষ্কণ্টক করে রাখবার দুর্লভ সুযোগটি হাতছাড়া করবেন না। এরা জানেন, যে দলই ক্ষমতায় আসুক এমপি এবং আমলারা তাদের বন্ধু হবে না। তাই  বিরোধী দলের আন্দোলনের চাপে অস্থির সরকারকে বাগে এনে নিজেদের অধিকার যতটুকু পারে আদায় করে নেবার শেষ চেষ্টাটা  করবেন উপজেলা চেয়ারম্যানরা । সরকারের শেষ সময় বলে আমলাতন্ত্র তার স্বভাবসিদ্ধ সুবিধাবাদী কাজটি করবে। এসময় এরা নিরপেক্ষতার খোলসে ঢুকে যাবে এবং ঐ খোলসের ভেতরে নিরাপদে বসে উঁকি মেরে পর্যবেক্ষণ করবে হাওয়া কোনদিকে বইছে এবং কি করলে সে হাওয়ায় মিশে যাওয়া যাবে।  
উপজেলা চেয়ারম্যানদের প্রতি মারমুখী হয়ে থাকা সংসদ সদস্যরাও সেই বৈরি সময়ে আমলাদের মত রক্ষণশীল ভূমিকায় যেতে বাধ্য হবেন। কারণ তাদের রাতের ঘুম তখন হারাম থাকবে ক্ষমতার পালাবদল চিন্তায়,পরবর্তী নির্বাচনে মনোনয়ন পাওয়া-না-পাওয়ার হিসাব এবং মনোনয়ন পেলে ভোটে জিতে আসার ভাবনায়। সঙ্গত কারণে  অতি সন্নিকটের সংসদ নির্বাচনের আগে উপজেলা চেয়ারম্যানদের এমপিরা ঘাঁটাতে চাইবেন না। এমপি সাহেবেরা জানেন দলীয় মনোনয়ন-যুদ্ধ এবং ভোটের বাজারে নিধিরাম সর্দার চেয়ারম্যানদের কলকাঠি নাড়বার ক্ষমতা অনেক। উপজেলা চেয়ারম্যানদের জনভিত্তি এমপিদের চেয়ে কোনও অংশে কমও নয়। এরা এমপিদের মত কোনও দলীয় মার্কায় ভোট নেননি, ব্যক্তি পরিচয়েই নির্বাচনী বৈতরণী পার হয়েছেন। এমপি সাহেবেরা সে হিসাবটা  কমবেশি জানেন।

উপজেলা চেয়ারম্যানদের আপাতঃ অদৃশ্য হয়ে যাওয়া আন্দোলন বর্তমান সরকারের ক্ষমতার মেয়াদের এক থেকে দেড় বছর আগে হঠাৎ করেই বেগবান হবে বলে আমার পর্যবেক্ষণ। তখন সরকার কি করবে ? অতীত অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে  শেষ বছরটায় সরকার প্রায় সর্বক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে অনেকটাই অকার্যকর  হয়ে পড়ে।   ক্ষমতার শেষ প্রান্তে এসে সরকারকে ব্যস্ত থাকতে হয় অনিবার্য কিছু বিড়ম্বনা সামলে পুনরায় ক্ষমতায় ফিরে আসার পথ সুগম করতে। আমার ধারণা বিএনপি জামায়াতের কম্বাইন্ড ‘ডু অর ডাই’ অ্যাকশনের মুখে অন্যবারের চেয়ে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগকে এবার বেশী নাকাল হতে হবে।   ক্ষমতা কেন্দ্রের কলকাঠি নাড়া আমলাতন্ত্রও তখন থাকবে ‘ধরিমাছ না ছুঁই পানি’ মুডে।
হিসেব কষে দেখেছি, ঠিক এমনই একটি সময়ে  উপজেলা চেয়ারম্যানরা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কাছ থেকে প্রশাসনিক ক্ষমতা জোর করে ছিনিয়ে নেবার মরিয়া চেষ্টা চালাবেন। এ কথা এত জোর দিয়ে বলবার কারণ কী।   কারণটা সোজা ,এই ক্ষমতা অধিগ্রহণের (কেউ হয়তো ছিনতাই বলবেন) সাথে জড়িয়ে আছে ক্ষমতাহীনতার লজ্জা অপনোদন, বঞ্চনা আর অপমানের প্রতিশোধ নেয়া এবং নির্বাচনকালে যে মোটা বিনিয়োগ হয়েছিল তার যতটুকু পারা যায় ততটুকুই ঘরে তুলে আনাবার তাগিদ। কথায় বলে না,পুত্রশোক ভোলা সহজ,  অর্থশোক নয়! উপরন্তু এরা ভুলে যায়নি নির্বাচিত হবার পর উপজেলা পরিষদ ভবনে নিজের পছন্দ মত একটি অফিসকক্ষও তারা সসম্মানে পাননি।   উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদের কাছ থেকে হয় তা মিনতি জানিয়ে কিংবা লড়াই করে আদায় করতে হয়েছে।

ধরে নিই ৪৮০ জন উপজেলা চেয়ারম্যান তাদের হাজার হাজার সমর্থক নিয়ে দাবি আদায়ে মাঠে নামলেন। মিছিল মিটিং সড়ক অবরোধ হরতালের পর হরতাল দিয়ে ৪৮০ টি উপজেলা অচল করে ফেললেন। ভেবে দেখুন দেশজুড়ে কতবড় অস্থিরতা শুরু হবে তখন। পুরো দেশটাই থমকে দাঁড়াবে। অবস্থাটা কি দাঁড়াবে ? বিএনপি জামায়াতের আন্দোলনের সাথে এটি হবে সরকার এবং প্রশাসনের জন্য গোদের উপর বিষ ফোঁড়া। বিএনপি সমর্থক উপজেলা চেষারম্যানরা তাদের এ আন্দোলনকে সহিংস এবং সরকার বিরোধিতার দিকে নিয়ে যাবার চেষ্টা যে করবেন না তার গ্যারান্টি কে দেবে? অপ্রীতিকর ঘটনা কিংবা সহিংসতার কথা  নাইবা বললাম। এমন ঘটনা যদি ঘটে তখন মাঠপর্যায়ের প্রশাসন যে মুখথুবড়ে পড়বে তাতে কোনও সন্দেহ নেই।  
চেয়ারম্যানদের এ  লড়াইয়ের  প্রথম প্রহরেই লজ্জাকর পতন ঘটবে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদের ক্ষমতার দুর্গের। কারণ তার তাদের পাশে সাধারণ কিংবা অসাধারণ কোনও মানুষই থাকবে  না। ‌`প্রভুর বিপদে ভক্ত মেলে,ভৃত্য মেলে না। ` আমাদের আমলারা সাধারণ মানুষকে ভক্ত বানাতে পারেন না, যতটা পারেন ভৃত্য বানাতে। আমাদের আমলাতন্ত্র প্রাসাদের অভ্যন্তরে অসীম ক্ষমতা ধারণ করলেও মাঠে তারা নির্জীব-নিঃসাড়। আমার বিশ্বাস এবং শংকা আমলাতন্ত্র এবং সংসদ সদস্যদের সাঁড়াশি চাপে আপাত: নির্বীর্য উপজেলা চেয়ারম্যানরা এক-একটা টাইমবোমা হয়ে বসে আছেন। সময় হলেই সয়ংক্রিয়ভাবে একযোগে বিস্ফোরিত হবেন। এই বিস্ফোরণের প্রথম ধাক্কাটা উপজেলা নির্বাহী অফিসারদের ক্ষমতার দেয়ালে লাগলেও বিস্ফোরণজনিত শক্ওয়েভের তীব্রতা মাঠ প্রশাসনকে পর্যুদস্ত করে আছড়ে পড়বে আমলাতন্ত্রের হৃদপিণ্ডে। আর এই হৃদপিণ্ডকে বুকে ধারণ করা বর্তমান সরকারকে ফেলে দিতে পারে ৭ কিংবা ৮ রিখটার স্কেলের ভূকম্পন-ঝুঁকিতে। অতএব ‘দিবানিদ্রা ভঙ্গ করিয়া টাইমবোমায় জল সিঞ্চনই শ্রেয়`’।
বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।