ঢাকা, শনিবার, ৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

মুক্তমত

‘ফার্স্ট ল্যাঙ্গুয়েজ’ সমাচার

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৫১২ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১৫, ২০১৮
‘ফার্স্ট ল্যাঙ্গুয়েজ’ সমাচার ভাষার ফেব্রুয়ারি আশার ফেব্রুয়ারি

যারা একাধিক ভাষা জানেন, তাদের সামনে ‘ফার্স্ট ল্যাঙ্গুয়েজ’ নামক একটি প্রসঙ্গ চলে আসে। বিশেষত উন্নত বিশ্বে, যেমন ইউরোপ ও আমেরিকায় অনেক সময় একাধিক ভাষা জানার দরকার পড়ে।

কারণ, সেসব সমাজ বহুভাষী। সেখানে বহু ভাষা চলে।

মানুষকেও তাই নানা ভাষা জানতে হয় সমাজ-সংসারের নানা কাজকর্মের সুবিধার্থে।

কিন্তু, প্রশ্ন হলো, ব্যক্তির প্রথম ভাষা বা ফার্স্ট ল্যাঙ্গুয়েজ হবে কোনটি? যে দেশে জন্মেছে সেদেশের ভাষা? নাকি মাতৃভাষা? প্রশ্নটি আরও স্পষ্ট করলে বলতে হয়, ফার্স্ট ল্যাঙ্গুয়েজ কি মাতৃভাষা হবে? নাকি যে দেশে জন্মেছে সেদেশের ভাষা?

সমস্যাটি আজকাল অনেক প্রবাসী বাংলাভাষী পরিবারকেই মোকাবেলা করতে হচ্ছে। কারণ, তাদের সন্তানরা পারিবারিকভাবে বাংলাভাষী। আবার যে দেশটিতে তারা জন্ম নেয়, সেদেশের প্রচলিত ভাষাটিকেও শিশুকালেই চমৎকারভাবে শিখে ফেলে। অর্থাৎ মায়ের মুখের ভাষা এবং জন্মস্থানের ভাষা, উভয়টিই অনর্গল বলতে পারে। উভয়টিতেই তারা সাবলীল। প্রশ্ন হচ্ছে, তার ‘ফাস্ট ল্যাঙ্গুয়েজ’ কোনটি?

লক্ষ্য করে দেখা যাচ্ছে, পূর্ব-পুরুষের ভাষা নয়, ফার্স্ট ল্যাঙ্গুয়েজ হিসেবে জন্ম-দেশের বা পিতামাতার প্রবাসের ভাষাকেই স্বাভাবিকভাবে আয়ত্ত করে নিচ্ছে মাইগ্রেটেড অভিবাসীদের উত্তর-পুরুষরা। প্রবাসী পরিবারের পরের জেনারেশনের একটা অংশ হয় তাদের পূর্ব পুরুষদের মাতৃভাষা পিতা-মাতার অসচেতনতা ও অবহেলার কারণে একেবারেই শিখছে না, নয়তো নিজ আগ্রহ ও গৃহের অনুকূল পরিবেশে আংশিকভাবে রপ্ত করতে চাইছে। এতেই তৈরি হচ্ছে সমস্যা।

পিতামাতার জন্মগত ফার্স্ট ল্যাঙ্গুয়েজ হারিয়ে তাদের প্রবাসের ভাষাটিকেই প্রথম বা প্রধান ভাষা রূপে গ্রহণ করছে তারা। তারা হয়ে যাচ্ছে ইংরেজি বা ফরাসি বা স্প্যানিশভাষী। তারা যে বাংলাভাষী, সে তথ্যটিই হারিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু ভাষা শুধু বলার বিষয়ই নয়, ভাষা এক ধরনের উত্তারাধিকারও বটে। ঐতিহ্য আর সংস্কৃতির মতো জগতের প্রত্যেকটি ভাষারই নিজস্ব ভাণ্ডার আছে। আছে বিষয়বস্তু ও প্রকাশভঙ্গির একটি অন্তর্নিহিত স্বকীয়তা। যার মাধ্যমে মানুষের আবেগ, অতীত, অনুভূতি ইত্যাদি পরম্পরা-সূত্রে গ্রথিত থাকে।

ভাষার ভিত্তিতেই ব্যক্তি বা পরিবার বা সমাজের মূল্যবোধ, অর্জিত জ্ঞান, বিশ্বাস (জীবনদর্শন) আর ঐতিহ্যসূত্র বিকশিত হয়। সামাজিক মূল্যবোধগুলো সক্রিয়ভাবে চিন্তাধারায় কিংবা কথপোকথনের মাধ্যমে ভিন্ন ভিন্ন বৈশিষ্ট্যে বাস্তবতা পায় ভাষার হাত ধরেই।

ফলে বাংলাভাষী পরিবারের কেউ যদি প্রজন্মান্তরে ইংরেজিভাষী বা ফরাসিভাষী হয়ে যায়, তাহলে তার জাতিগত ঐতিহ্য, সাংস্কৃতিক ধারাবাহিকতা ও মনোজগতের কাঠামোটিই ভেঙে যেতে পারে। তার চিন্তা ও চেতনায় হাজার বছরের বাংলাভাষা ও বাঙালি সত্তাটিও তখন আর খুঁজে পাওয়া যাবে না। নতুন শেখা ভাষা-জগতের একজন নবীন সদস্য হিসাবে সে হয়ত কথা-বার্তা বলতে পারবে, কিন্তু সে-ভাষার ইতিহাস-ঐতিহ্য-পরম্পরার সঙ্গে মোটেও একাত্ম হতে পারবে না। কারণ, নতুন ভাষাটি অনাদিকাল ধরে তার নয়। ভাষাটির ঐতিহ্য ও অতীতে তার পূর্ব-পুরুষের কোনও অবদান নেই। নিজেকে সে গভীরতম অর্থে সে-ভাষার অংশ করতে পারবে না।

সম্ভবত এ কারণেই ইহুদিরা কখনই নিজেদের ভাষা ভুলে যায়নি। ইহুদিরা শতশত বছর বিশ্বের নানা দেশে আশ্রয়ের সন্ধানে চরে বেড়িয়েছে। এক দেশ থেকে তাদেরকে তাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে আরেক দেশে। ইসরায়েল রাষ্ট্রটি হওয়ার আগে ইহুদিরা এমনিভাবে নানা দেশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে বহিরাগত রূপে জীবন-ধারণ করেছে। প্রয়োজনে সেসব দেশের ভাষা শিখেছে, সংস্কৃতিকে বুঝেছে। কিন্তু নিজেদের আদি ভাষা হিব্রুকে (Hebrew) বিস্মৃত হতে দেয়নি। ঘরে ব্যক্তিগত পযায়ে হিব্রু চর্চা করেছে। প্রাচীন হিব্রু সাহিত্যের ইতিহাসকে নিজেদের চর্চায় সংরক্ষণ করেছে।

ইহুদিদের ভাষাপ্রেম ও ভাষা-সংরক্ষণের কারণে দেখা গেল, যেদিন ইসরায়েল রাষ্ট্রটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, ঠিক সেদিন থেকেই সেখানকার রাষ্ট্রভাষা হিব্রু। আরব, ইউরোপ, রাশিয়া, আমেরিকা, জার্মানি ইত্যাদি যেখান থেকেই ইহুদিরা এসে ইসরায়েলে বসতি স্থাপন করুক না কেন, হিব্রু বলতে তাদের মোটেও অসুবিধা হচ্ছে না। বরং হিব্রু ভাষা বিশ্বে ছড়িয়ে থাকা ইহুদিদেরকে নতুন রাষ্ট্র ইসরায়েলে নৈকট্য লাভ করতে ও একাত্ম হতে সাহায্য করেছে।

হিব্রু ছাড়াও আরেকটি ভাষাকে তারা রক্ষা ও সংরক্ষণ করতে সচেষ্ট হয়েছে। যদিও ভাষাটি হিব্রুর মতো প্রাণ পায়নি। ভাষাটি হলো ইড্ডিশ (Yiddish), যা ছিল পূর্ব ইউরোপীয় অঞ্চলের দেশগুলোতে বসবাসকারী ইহুদিদের ভাষা। বহু বিখ্যাত ইহুদি লেখক ছিলেন ইড্ডিশভাষী।

অতএব, নতুন দেশে গেলেই এবং জন্ম থেকে সেদেশের ভাষাটি সম্পূর্ণভাবে রপ্ত করলেও জাতিগত অর্থে প্রাপ্ত ভাষাটিই মানুষের ফার্স্ট ল্যাঙ্গুয়েজ হওয়ার দাবি রাখে না। জাতিসত্তা ও সাংস্কৃতিকভাবে প্রাপ্ত ভাষাটিই ফার্স্ট ল্যাঙ্গুয়েজ হওয়ার দাবিদার।

নাগরিকত্ব বদলের মতো যারা ফার্স্ট ল্যাঙ্গুয়েজ বদলের চেষ্টা করেছেন বা করছেন, তারা নিজেদের পায়ে কুড়াল মারছেন। নিজের অস্তিত্ব ও জাতিগত পরিচিতিকে নস্যাৎ করছেন। জীবনের জন্য সকল ভাষাই শেখা যাবে এবং শেখা উচিতও। কিন্তু সেটা নিজের জন্মগত ভাষাকে জলাঞ্জলি দিয়ে নয়।

বাংলাদেশ সময়: ১০৫৯ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১৫, ২০১৮
এমপি / জেএম

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।