বেশ কয়েক বছর আগে মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে অধ্যয়নকালে আমার এক ভাই বলছিলেন, ‘মিনহাজ, আমি অমর হতে চাই’। দুজনের মাঝে ১৭-১৮ বছর বয়সের তফাৎ থাকা সত্ত্বেও অনেকটা সমবয়সী আমার বড় ভাইকে না বলে আমার মত পুচকে একটা স্কুল পড়ূয়া ছেলেকে কথাটা বলার হেতু আমার বুঝে আসে নি।
অনভিজ্ঞতায় ভরা আমার কচি হৃদয় তখনও বুঝতে পারে নি বেতারের জন্য নাটক রচনা করা কত বড় বা ছোট কীর্তি! আদৌ তিনি নাটক লিখে বেতারে পাঠিয়েছিলেন কিনা সেটা যাচাই করার কোন সুযোগও আমার ছিল না। একটা পর্যায়ে অবশ্য ফুফাতো ভাইকে বেশ হিরো হিরো মনে হত। বাংলাদেশ বেতারের জন্য নাটক রচনা করাতো আর কম বড় কথা নয়! তর্কের খাতিরে ধরেই নিলাম অমর হওয়ার জন্য অর্থাৎ মৃত্যুর পরে স্বীয় কর্ম দিয়ে মানুষের হৃদয়ে বেচে থাকতে বেতারের জন্য একটা নাটক রচনা করাই যথেষ্ট। কিন্তু প্রশ্ন জাগে সেই অমর খ্যাতিটা নিজে দাবী কিংবা আবদার করে পেতে চাওয়াটা কোন পর্যায়ের বোকামি?
পৃথিবীর ইতিহাসে যত অমর ব্যক্তি রয়েছে তারা কেউই অমর হওয়ার জন্য কর্ম করেন নি, কর্ম করে অমর হয়েছেন। আশ্চর্যজনক এবং ন্যাক্কারজনক হলেও সত্য বর্তমান অনেক লোক পাওয়া যায় যারা অমর হওয়ার জন্য কর্ম করেন। আন্না হাজারে অমর হওয়ার জন্য আন্দোলনে নামেন নি। তিনি দেশ ও জনগনের জন্য আন্দোলনে নেমেছেন। আমার বিশ্বাস তিনি ইতিহাসে অমরত্বের স্থানে অধিষ্ঠিত হবেন। বেশভূষা আর অন্যান্য ক্ষেত্রে আন্নাকে অনুকরনকারী আমাদের দেশের কিছু সুশীলকেও বেশ পথে প্রান্তরে দেখা যায় অমরত্বের নেশায়। তারা সুকর্ম না কুকর্মের জন্য অমর হবেন সেটা ভবিষ্যতই বাতলে দিবে।
কোন কোন ক্ষেত্রে পুরষ্কারের উদ্দেশ্য কাজ করা ইতিবাচক। উদাহরণস্বরূপ শুধুমাত্র বিশ্বকাপ জয় করার উদ্দেশ্য নিয়ে বাংলদেশ ক্রিকেট দল বিশ্বকাপে অংশগ্রহণ করলে তাতে নেতিবাচক কিছু চোখে পড়ে না। অথবা শুধুমাত্র পদক জেতার জন্য ম্যরাথন দৌড় প্রতিযোগীতায় অংশগ্রহণকারীকেও কোন অবস্থাতেই দোষারোপ করা যায় না। তবে এমন কিছু ব্যাপার আছে যেগুলো পুরষ্কার কেন্দ্রিক হওয়াটা দুঃখজনকই নয় সীমাহীন লজ্জাজনকও বটে। একজন লেখকের কাজ নয়, দায়িত্ব হচ্ছে সমাজের নানা অসংগতি, অন্যায়, অবিচার ইত্যাদিসহ বিনোদন যোগানোর জন্য কলম ধরা। ঠিক তেমনিভাবে রাষ্ট্রের বিভিন্ন দ্বায়িত্বে নিয়োজিত রাষ্ট্রপ্রধান, সরকার প্রধান, মন্ত্রী, আমলাদের দায়িত্ব হল সর্বদিক দিয়ে দেশকে সঠিকভাবে পরিচালনা করা। উদ্দেশ্যমূলক একটি বিশেষ কার্যসিদ্ধি করে দিগ্বিজয়ী মানব বনে যাওয়া কোন লেখক, রাষ্ট্রপ্রধান কিংবা সরকার প্রধানের কাজ নয়। ন্যায়নিষ্ঠভাবে শাসন করা গেলে শান্তি শৃঙ্খলা এমনিতেই প্রতিষ্ঠিত হয়, কোন পুরষ্কার পেয়ে বুঝানো প্রয়োজন পড়ে না দেশের মানুষ সুখে শান্তিতে বসবাস করছে।
নোবেল পুষ্কার বর্তমান বিশ্বের সবচেয়ে মূল্যবান পুরস্কার। তাই বলে নোবেল পুরষ্কার কোন ভাল কাজের একমাত্র স্বীকৃতি হতে পারে না। বিশ্ব শান্তি ধ্বংস করেও যদি শান্তিতে নোবেল পাওয়া সম্ভব হয়, তাহেল নোবেল পুরস্কার প্রাপ্তির জন্য আর যাইই হোক গর্ব করা যায় না। আর এই নোবেল পুরস্কার প্রাপ্তি নিয়ে যখন কেউ দাবী বা আবদার তোলে তাকে সুস্থ জ্ঞানবুদ্ধি আর বিবেক দান করার জন্য মহান আল্লাহর কাছে দোয়া করা ছাড়া কিছুই করার থাকে না। আমাদের দেশের সরকারের শীর্ষমহলের দাবি বাংলাদেশের নোবেল পুরস্কার পাওয়ার অদ্বিতীয় যোগ্য ব্যক্তিত্ব হচ্ছেন বর্তমান প্রধানমন্ত্রী। দেশের একটি অংশে কাল্পনিক শান্তি কায়েম করাই নাকি তাকে এ পুরস্কারে ভূষিত করা ফরয। নিজের মধ্যেই প্রশ্নের অবতারণা হয় মানুষ এত বড় বিবেক বর্জিত, নিচু মন মনাসিকতাসম্পন্ন হয় কি করে? নোবেল পুরষ্কারের চেয়ে সুকর্ম দিয়ে পনের কোটি মানুষের হৃদয়ে হাজার বছর ধরে বেচে থাকাটা কি বেশি মূল্যবান নয়?
ফুফাতো ভাই অমরত্বের আসন পাকাপোক্ত করতে আর কয়টি নাটক রচনা করেছেন জানা যায় নি, অথবা হতে পারে তিনি অমর হওয়ার অভিযান থেকে সরে এসেছেন কিংবা সিটকে পরেছেন। তবে আমাদের প্রধানমন্ত্রী নোবেল পুরস্কার পেতে সমানে এগিয়ে চলেছেন। নিজদেশে এক ইঞ্চি ভূমিতে শান্তি প্রতিষ্ঠিত করতে না পারলেও স্বদেশভূমি পেরিয়ে তিনি ভিনদেশের জন্যও এখন শান্তির মডেল তৈরি করছেন। ডজনখানেক ডিগ্রি নেওয়ার কাজটা অনেক আগেই সাঙ্গ করেছেন। স্কুল কলেজে অনেক মনিষীর নানা ধরনের মডেল সম্পর্কে অধ্যয়ন করেছি, এখনও করছি। এমন আজব মডেলের কথা কখনও কল্পনায় আসে নি। সারাবিশ্বে আন্না হাজারের যে জয়জয়কার তাতে বিরোধী দলে থাকলে বঙ্গবন্ধু এ্যাভিনিউতে নকশি কাথায় আসন গেড়ে ক্ষণিকের বসে থাকা আন্না হাজারে হওয়ারও একটা সুযোগ তৈরি করত। তাতে নোবেল পাওয়ার সম্ভাব্যতাও বৃদ্ধি পেত। আফসোস! এ যাত্রায়ও মনে হয় নোবেল আর মিলল না!
লেখক: ফিনল্যান্ড প্রবাসী ছাত্র ও ব্লগার
ই-মেইল: minhaj6ukl@gmail.com