ঢাকা, বুধবার, ২৮ কার্তিক ১৪৩১, ১৩ নভেম্বর ২০২৪, ১১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

মুক্তমত

শেয়ারবাজারে সব হারানোর ব্যথা

হারুন অর রশিদ, বিনিয়োগকারী | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৭৩৪ ঘণ্টা, অক্টোবর ২৮, ২০১১

ঢাকা: একটি কৌতুক দিয়েই শুরু করি। পাকিস্তানে তখন আইয়ুব খানের সামরিক শাসন চলছে।

নাপিত প্রতিবার আইয়ুব খানের চুল কাটার আগে প্রশ্ন করেন, ‘স্যার, গণতন্ত্র কবে দেবেন?’ আইয়ুব খান কোনো উত্তর দেন না, তবে তার চেহারায় রাগ প্রকাশ পায়। একদিন তিনি নাপিতকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘প্রতিবার চুল কাটার আগে তুমি এ প্রশ্ন কর কেন?’ জবাবে নাপিত জানায়, ‘স্যার, গণতন্ত্রের কথা শোনার সঙ্গে সঙ্গে আপনার মাথার সব চুল দাঁড়িয়ে যায় আর আমার চুল কাটতে সুবিধা হয়।

আমাদের অর্থমন্ত্রীরও হয়েছে সে অবস্থা শেয়ারবাজার নিয়ে কোনো প্রশ্ন করলেই তার অবস্থা হয় দেখার মতো। প্রথম দিকে অনেক হম্বি-তম্বি করলেও, এখন মনে হয় তিনি অসহায়। সাংবাদিকদের তিনি কিছু বলতে না চাইলেও যা বলেন তাতে বাজার আরও পড়ে। বৃহস্পতিবার জাতীয় সংসদে শেয়ারবাজারকে অদ্ভুত বাজার বললেন তিনি। পৃথিবীতে এর সমকক্ষ বাজার না দেখার কথাও জানান। ধন্যবাদ দিতে হয়, অন্তত তিনি রাবিস বা টোটাল রাবিস বলেননি। কারণ আমরা দেখেছি তিনি যে বিষয় নিয়ে বিরক্ত হন তা রাবিস বা টোটাল রাবিস বলেন। শেয়ারবাজার নিয়ে অসহায় অর্থমন্ত্রী যে মন্তব্যই করুন না কেন এক বছর আগেও এ বাজার কিন্তু ‘অদ্ভুত’ ছিল না। লাখো বিনিয়োগকারী, শত ব্রোকারেজ হাউজ, মার্চেন্ট ব্যাংক এবং শেয়ারবাজারের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে চাকরিরত হাজারো মানুষের স্বপ্ন ছিল এ শেয়ারবাজার নিয়ে। লাভ-ক্ষতি নিয়েই এগিয়ে যাচ্ছিল আমাদের শেয়ার বাজার। মাঝে মাঝে ভাবতে অবাক লাভে আওয়ামী লিগ ক্ষমতায় আসলেই শেয়ারবাজার কেন ধংস হয়। ১১৯৬ সালের কথা সবারই মনে আছে নিশ্চিয়ই। সেবার মাত্র ছয় মাসের মধ্যে এ বাজারের বারোটা বাজিয়ে ছিল।

এরপর বাজার ঘুরে দাঁড়াতে ৮/৯ বছর লেগেছে। ১৯৯৬-এর চেয়ে এবারের পতন আরও ভয়াবহ। লাখ লাখ বিনিয়োগকারী হারালেন হাজার হাজার কোটি টাকা, সঙ্গে আছে মার্চেন্ট ব্যাংক থেকে নেওয়া ঋণের টাকা ও সুদ। সঠিক সময়ে সঠিক কাজ না করলে যা হবার তাই হয়েছে। সেসময়ের কথা মোটেই আমলে নেননি আমাদের অর্থমন্ত্রী। বরং শেয়ারবাজারের অস্বাভাবিক উত্থানে সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের পাশাপাশি অর্থ মন্ত্রণালয় এবং বাংলাদেশ ব্যাংকেরও দায় ছিল। শেয়ারবাজারের সঙ্গে যারা সংশ্লিষ্ট তারা জানেন, প্রতিদিনের লেনদেনে সরকারি কোম্পানি ডেসকো, তিতাস, ন্যাশনাল পাওয়ার গ্রিড, পদ্মা ওয়েল, যমুনা ওয়েল এবং মেঘনা পেট্রোলিয়াম বিশেষ ভূমিকা রাখত। শেয়ার প্রতি আয় এবং লভ্যাংশের দিক দিয়ে এসব সরকারি কোম্পানির শেয়ারগুলো বিনিয়োগকারীদের আকৃষ্ট করতো। প্রতিদিনের লেনদেন শীর্ষ দশের মধ্যে বেশ কয়েকটি সরকারি কোম্পানির শেয়ার থাকতো। বিন্তু বছরের শেষ দিকে অর্থ মন্ত্রী জানালেন, পনেরো দিনের মধ্যে সরকারি শেয়ারবাজারের ছাড়া হবে। সঙ্গে সঙ্গে এ কোম্পানিগুলোর শেয়ার দর কমতে থাকলো এবং সরকার শেয়ার ছাড়লে সরকারি এ সব কোম্পানির শেয়ারের দর আরও কমে যেতে পারে ভেবে বিনিয়োগকারীরা সরকারি শেয়ার ক্রয়ে আগ্রহ হারালেন।

সরকারি কোম্পানির শেয়ারের লেন-দেন কম হতে থাকায় অভিহিত মূল্য (ফেস ভ্যালু) পরিবর্তনের সুযোগ নিয়ে ব্যাংক, বিমা ও বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠানের শেয়ারের দাম দুই থেকে তিনগুণ বাড়তে থাকলো। উত্থানের শেষে পতন শুরুর আগে কিছু বড় বিনিয়োগকারী তাদের সিংহভাগ শেয়ার বিক্রি করে দেন। অতি মূল্যায়িত শেয়ার নিয়ে বিনিয়োগকারী বসে রইলেন।

যাদের অনেকের বিরুদ্ধে কারসাজির কথা শুনা যায় তারা ও মার্চেন্ট ব্যাংক
বাজার বেশি পড়ে গেলে অর্থমন্ত্রণালয়, সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন ও ঢাকা এবং চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জ দৌড় ঝাঁপ দিয়ে দু’চার দিনের জন্য বাজার ঠিক করলেন। এরপর আবার পতন শুরু হলো। অবশেষে অর্থ মন্ত্রণালয় কৃষি ব্যাংকের চেয়ারম্যান ইব্রাহীম খালেদকে চেয়ারম্যান করে একটি তদন্ত কমিটি করলো। অনেকের ধারণা ছিল তদন্ত কমিটি গঠনের কারণে বাজার স্থিতিশীল হবে। কিন্তু তা হয়নি, বরং তদন্ত কমিটির কারণেও বাজারের পতন হয়েছে।

ইব্রাহীম খালেদ অনেকের কাছে শ্রদ্বেয় এবং জ্ঞানী ব্যক্তি হিসেবে পরিচিত, কিন্তু তিনি তদন্ত প্রতিবেদনে বাংলাদেশ ব্যাংকের ব্যর্থতার কথা বেমালুম চেপে গিয়ে নিজের সুনামের প্রতি সুবিচার করেননি। কমিটির গঠন হওয়ার আগেএকটি জাতীয় দৈনিকে তিনি আওয়ামী লিগ ও বিএনপির পনেরো জন ব্যবসায়ীর জড়িত থাকার কথা বললেও তদন্ত প্রতিবেদনে এর কোনো প্রতিফলন দেখা গেলো না। বরং এ দু’দলের সাথে সংশ্লিষ্ট যাদের সঙ্গে কথা বললেন, তাতে ধরি মাছ না ছুই পানি এর অবস্থা। যা হোক, সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের পুনর্গঠন এবং কিছু সিদ্ধান্তে শেয়ারবাজার স্বাভাবিক হতে লাগলো। বিনিয়োকারীরা ক্ষতি পূরণের আশায় রইলেন।

জুলাই মাসের শেষ দিকে আবারও কয়েকটি সিদ্ধান্ত বাজারকে পতনের দিকে নিয়ে গেলো যা এখনো অব্যাহত রয়েছে। কারসাজির জন্য কয়েকজনের বিরুদ্ধে মামলা, বাংলাদেশ ব্যাংকের মুদ্রানীতিতে শেয়ারবাজারকে অনুন্নয়নশীল খাত বলা এবং কালো টাকা শেয়ার বাজারে বিনিয়োগ করলে উৎস জানানোর শর্ত রাখা। মামলা হওয়ায় বড় বিনিয়োগকারীরা তাদের হাতে থাকা শেয়ার ব্রিক্রি করে দিয়ে বাজার থেকে বেড়িয়ে গেছেন বলে গুজব উঠলো। লেন-দেনের পরিমাণ দুই হাজার কোটি থেকে পাঁচ শত কোটির মধ্যে নেমে আসলো। সূচকের পতন হতেই থাকলো।

আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য শেখ ফজলুল করীম সেলিমকে ধন্যবাদ দিতে হয়। কারণ তিনি বিনিয়োগকারীদের মনের কথা বলেছেন। ইতিপূর্বেও একবার তিনি ও কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী বিনিয়োগকারীদের পক্ষে বলেছেন। শেখ সেলিম ও মতিয়া চৌধুরীর কথায় মনে হয়েছে তারা বিনিয়োগকারীদের প্রতি যথেষ্ট সহানুভুতিশীল। তবে তারা যদি আন্দোলনকারী বিনিয়োগকারীদের পাশে অন্তত একদিন দাঁড়াতেন তবে তাতে তাদের আন্তরিকতা আরও প্রকাশ পেতো। বিনিয়োগকারীদর আন্দোলন কোন রাজনৈতিক আন্দোলন নয়। নিজেদের ক্ষতিপূরণ এবং পেশার অস্তিত্ব রক্ষার আন্দোলন। অর্থমন্ত্রী এবং অর্থ উপদেষ্টার মন্তব্যে একাধিকবার বাজারের পতন হয়েছে।

বাংলাদেশ ফান্ডের ইউনিট বিক্রয় কার্যক্রমের উদ্ধোধনকালেও অর্থ উপদেষ্টা বিনিয়োকারীদের আশার কথা না শুনিয়ে ক্যারেকটার সার্টিফিটেক দিয়েছেন। কিছুদিন আগে যখন ইউরোপ ও এশিয়ার বাজারে ধস নামলো তখন পত্রিকায় দেখলাম জি-২০ভুক্ত দেশগুলোর রাষ্ট্র্র প্রধানরা মিলিত হলেন শেয়ারবাজারের ধস ঠেকাতে এবং তাদের চেষ্টায় বর্তমানের ইউরোপ ও এশিয়ার শেয়ারবাজার অনেকটা স্বাভাবিক। জাপান এত বড় একটি প্রাকৃতিক দুর্যোগের পরও অতি দ্রুত ব্যবস্থা নিয়ে শেয়ারবাজার স্বাভাবিক করলো। অথচ আমাদের অর্থমন্ত্রী এখন শেয়ারবাজার থেকে দূরে থাকতে স্বাছন্দ্য বোধ করেন। শেয়ার বাজারস্বাভাবিক করার উপায় জাানে না এবং জানার চেষ্টার করেন বলে মনে হয় না। শেয়ারবাজার নিয়ে বিরোধী দল বিএনপির ভূমিকাও যথেষ্ট নয়।

আমাদের অর্থমন্ত্রী শেয়ারবাজারকে স্বাভাবিক করার বিভিন্ন পদক্ষেপের কথা বলেছেন। কিন্তু এ সব পদক্ষেপে কি ক্ষতিগ্রস্থ সাধারণ বিনিয়োগকারীরা সরাসরি উপকৃত হবে? কালো টাকা থেকে সাধারণ বিনিয়োগকারীরা অনেক দূরে তবে কালো টাকা বিনিয়োগের ফলে শেয়ারের দাম বাড়লেই কেবল তারা কিছুটা সুবিধা পাবে। দৈনিক লেন-দেনের উপর ১০ শতাংশের পরিবর্তে শূন্য দশমিক পাঁচ শতাংশ কর স্টক একচেঞ্জের ব্রোকার এবং মার্চেন্ট ব্যাংক এর আয় বাড়াবে। শেয়ারবাজারে বিনিয়োগে দশ শতাংশ কর রেয়াত সুবিধার অধিকাংশই পাবেন বড় বিনিয়োগকারীরা। আমাদের বাণিজ্যিক ব্যাংক এবং আর্থিক অনেক প্রতিষ্ঠান গত বছর শেয়ারবাজার থেকে অনেক মুনাফা করেছে। শেয়ারবাজার পতনে বিনিয়োগকারীরা ক্ষতিগ্রস্থ হলেও মার্চেন্ট ব্যাংক তাদের সুদ ঠিকই নিয়েছে এছাড়া লেন-দেনের উপর কমিশনতো আছেই। এ সব বিনিয়োগকারীর গত জানুয়ারী থেকে আগামী ডিসেম্বর ২০১১ পর্যন্ত ঋৃণের টাকার  উপর যে সুদ হয়েছে তা মওকুফ করলে ক্ষতিগ্রস্থ বিনিয়োগকারীরা কিছুটা হলেও উপকৃত হবে। অর্থ মন্ত্রণালয় এবং বাংলাদেশ ব্যাংক সাধারণ বিনিয়োগকারীদের সুদ মওকুফের ব্যাপারে ভূমিকা রেখে অতীতে তাদের অবহেলা এবং অসর্তকার জন্য বিপর্যস্ত শেয়ারবাজারকে উদ্ধারের কিছুটা চেষ্টা করতে পারেন।    

লেখক: বিনিয়োগকারী: যোগাযোগ:  haroon1967@gmail.com
               
বাংলাদেশ সময়: ০৭২৭ ঘণ্টা, অক্টোবর ২৮, ২০১১

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।