ঢাকা: নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশন (নাসিক) নির্বাচনে ৩০ অক্টোবরের মেয়র পদে ভোটাভুটিতে অবশেষে ডা. সেলিনা হায়াত আইভী বিজয়ী হয়েছেন।
কিন্তু তার আগের রাতেই ঘটে গেছে আরও একটা নাটক।
এই সরে দাঁড়ানোর কারণ হিসেবে তিনি সাংবাদিকদের জানালেন, হাইকমান্ডের নির্দেশে নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তিনি। এ কথা বলার পর পরই তিনি কেঁদে ফেলেন। কাঁদলেন এ কারণে যে, তিনি ঘোষণা দিয়েছিলেন যে, একমাত্র মৃত্যু ছাড়া তিনি নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়াবেন না। কিন্তু, মৃত্যু পর্যন্ত তাকে যেতে হয়নি, তার আগেই জাতীয়তাবাদী দলের শীর্ষ পর্যায়ের নেতাদের নির্দেশে (নাকি সিদ্ধান্তে!) নাসিক নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়াতে হলো।
কান্নাটা সেই কারণে, কারো বিরুদ্ধে নালিশ জানিয়ে বা তার প্রতিপক্ষ দল আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে বিষোদগার করে নয়। নিজের সব ইচ্ছাই হার মানলো দলীয় নেতাদের সিদ্ধান্তে, এই কারণে।
তিনি সাংবাদিকদের আরও জানালেন, ‘আমি সম্পত্তি বেচে নির্বাচনে দাঁড়িয়েছিলাম এবং আমার পক্ষে গণজোয়ার সৃষ্টিও হয়েছিল। ’
এর কারণ হিসেবে আওয়ামী লীগ সমর্থিত মেয়র পদের প্রার্থীর সমর্থনের ব্যাপারে আওয়ামী লীগের একের পর এক নাটক। আওয়ামী লীগ শামীম ওসমানকে সমর্থন দেবে না আইভীকে?- এই প্রশ্ন নিয়ে সারাদেশের মিডিয়ায় গুঞ্জন ও সাধারণ মানুষের মধ্যে এক ধরনের তোলপাড় সৃষ্টি হয়েছিল।
শেষ পর্যন্ত সব গুঞ্জনের অবসান হলো শামীমের পক্ষে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় তিন নেতার সমর্থন ও মাঠে প্রচারণা শুরুর পর। পরিষ্কার হয়ে গেল আওয়ামীলীগ শামীম ওসমানকে সমর্থন করেছে।
কিন্তু শেষ পর্যন্ত আওয়ামী লীগের নাটকে সিদ্ধান্তে অনড় ও অটল রইলেন নারায়ণগঞ্জের সাবেক পৌর মেয়র ও শহর আওয়ামী লীগের সহসভাপতি সেলিনা হায়াত আইভী। তিনি মিডিয়ার ভাষায় তখন পরিচিতি লাভ করলেন ‘আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী’ প্রার্থী হিসেবে।
স্থানীয় আওয়ামী লীগের হাতেগোনা কয়েকজনের সমর্থন নিয়ে মনের জোর বাড়িয়ে মাঠে নেমে পড়লেন আইভী। নাগরিক কমিটি এবং সংস্কৃতি কর্মীরা তাকে সমর্থন দিয়ে গান রচনা, প্রচার-প্রচারণায় নিরবে কাজ করে যেতে লাগলেন।
এর পাশাপাশি দেখা গেল, কোনো কোনো সংবাদমাধ্যম শামীম ওসমানকে পরোক্ষ সমর্থন দিয়ে সংবাদ প্রতিবেদন ছাপতে শুরু করে। এসে যায় মিডিয়ায় বিভক্তি। সাধারণ মানুষের আলোচনায় চলে আসে যে, অমুক মিডিয়া অমুককে সমর্থন দিয়েছে। অমুক মিডিয়া তাকে সমর্থন দিয়েছে। ঠিক যেন গ্রেট ব্রিটেনের নির্বাচন! ব্রিটেনের অত্যন্ত প্রভাবশালী দৈনিক ‘দ্য গার্ডিয়ান’ বামঘেঁষা বলে সে দেশের মানুষ জানে। আবার দ্য সান বা অন্য মিডিয়াগুলো একটু ডানঘেঁষা!
নাসিক নির্বাচনে ঠিক তেমনি সাধারণ মানুষের চায়ের কাপে ঝড় উঠলো কোন সংবাদমাধ্যম কাকে সমর্থন করছে! তবে আইভীর পক্ষে বড় বড় সংবাদমাধ্যমগুলোর সমর্থন তেমন একটা চোখে পড়েনি।
এরই ফাঁকে নারায়ণগঞ্জের বিএনপি কর্মীরা আশায় বুক বাঁধলেন যে, আওয়ামী লীগের দুই প্রার্থীর ভোট ভাগাভাগির ফলাফলটা তৈমুরের পক্ষেই যাবে। কিন্তু তখন কি তারা জানতেন যে, তৈমুর শেষ পর্যন্ত বিএনপিরই বলির পাঁঠা হয়ে যাবেন?
অবশেষে ২৯ অক্টোবরের মধ্যরাতে সংবাদকর্মীরা বিএনপির আরেক নাটকের খবর ছড়িয়ে দিলেন সারা পৃথিবীতে।
নাসিক এলাকার ভোটাররা ৩০ অক্টোবর সকালে যখন সবাই ভোট দিতে যাবেন, তখন তারা সংবাদমাধ্যমের কল্যাণে জানলেন, বিএনপি সমর্থিত প্রার্থী তৈমুর আলম খন্দকার নাসিক নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা থেকে সরে দাঁড়িয়েছেন।
বিএনপি দলীয় কর্মীরা কেউ কেউ সরাসরি আওয়ামী লীগকে দায়ী করে বিক্ষোভ মিছিল করেছেন ২৯ অক্টোবর রাতেই। আর এদিকে ‘তৈমুর রুমালে চোখ মুছলেন’ দলীয় সিদ্ধান্তের কারণে। এখানে কেউ কেউ অভিযোগও করেছেন যে, এখানে দলীয় কিছু হিসাব-নিকাশও নাকি ছিল। তৈমুরকে বসিয়ে দেওয়ার পেছনে আর্থিক লেনদেনের কথাও বলেছেন দলীয় কর্মীরা। কিন্তু কেউ সঠিকভাবে এর হিসাব মেলাতে পারেননি।
তারা ভেবেছেন বিএনপির কেন্দ্রীয় কমান্ড হয়ত এ সরকারের অধীনে আর নির্বাচন করবে না। আর তাই হয়ত তৈমুরকে নির্বাচন থেকে বসে যেতে হলো! কেউ কেউ ভেবেছেন যে, তৈমুরের ‘রাজনৈতিক ক্যারিয়ার’ শেষ করে দেওয়ার জন্য খোদ বিএনপির কিছু নেতা চেয়েছেন যেন, তৈমুর নাসিক নির্বাচন থেকে সরে যাক। তিনি সরে গেছেন। হয়ত এর ফলটা আইভীর ঘরেই গেছে। কিন্তু রাজনৈতিকভাবে বিএনপি কতটা লাভবান হলো, এ প্রশ্ন খোদ স্থানীয় বিএনপি নেতাকর্মীদের মধ্যেই জেগেছে।
কথা উঠেছে যে, স্বয়ং তৈমুরও নাকি ২৯ অক্টোবর জানতেন না যে, শেষ পর্যন্ত তার এ পরিণতি হবে। জানলে তিনি নির্বাচনী খরচের জন্য সম্পত্তি হয়ত বিক্রি করতেন না।
কত কষ্টে একজন বলতেন পারেন, ‘আমি সম্পত্তি বেচে নির্বাচনে দাঁড়িয়েছি। ’ সেই কথাই সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন তৈমুর আলম। তার ধারণা ছিল, নাসিক নির্বাচনে তিনি বিজয়ী হতেও পারেন আওয়ামী লীগের বিভক্ত ভোটের কারণে। সেজন্য তৈমুর নিজে ছিলেন খুবই আশাবাদী যে, নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশনের (নাসিক) প্রথম মেয়র হবেন তিনিই।
কিন্তু শেষ পর্যন্ত সে আশার গুড়ে বালি পড়লো!
তিনি ভাবলেন কী, আর হলো কী! বলির পাঁঠা হয়েই নির্বাচন থেকে তাকে বিদায় নিতে হলো!
তার দল কি তার এই কষ্ট, বেদনার মূল্যায়ন করতে পারবে, নাকি পরবর্তী নির্বাচনগুলোতে প্রার্থী মনোনয়নে ‘মনোনয়ন বাণিজ্য’ করবে- এ প্রশ্ন নাসিক নির্বাচন থেকে করুণভাবে বিদায় নেওয়া তৈমুর তার দলের কাছে করতেই পারেন।
তবে সে মূল্যায়নটা হবে- দলের একনিষ্ঠ নেতাকর্মী হিসেবে নয়, ‘বলির পাঠা’ হিসেবে! তাই নয় কি?
লেখক: সাংবাদিক
ashishbiswas@rocketmail.com
বাংলাদেশ সময়: ১৪২১ ঘণ্টা, ৩১ অক্টোবর, ২০১১