ঢাকা, রবিবার, ১৪ পৌষ ১৪৩১, ২৯ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৬ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

মুক্তমত

ক্ষমা করে দিও হে নেতা

ফজলুল বারী, কন্ট্রিবিউটিং এডিটর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১০৫৪ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২২, ২০১১
ক্ষমা করে দিও হে নেতা

আমি কখনও আওয়ামী লীগ করিনি। মুক্তিযুদ্ধের প্রশ্নে একপক্ষীয় অবস্থানের কারণে আমার সমর্থন আওয়ামী লীগ এনজয় করে।

আব্দুর রাজ্জাকের কর্মী হবার সুযোগও কখনো হয়নি। সম্পর্ক যা তা একজন রাজনৈতিক নেতার সঙ্গে একজন সাংবাদিকের। এরশাদবিরোধী আন্দোলনের সময় আমরা সাংবাদিকতায় আসা’রা রাজনৈতিক নেতাদের দীর্ঘ ইন্টারভ্যু করতাম। এভাবেই পরস্পরকে জানাশুনা, ঘনিষ্ঠতা। এদের অনেকে তখন গ্রেফতার এড়াতে আন্ডারগ্রাউন্ডে থাকতেন। আব্দুর রাজ্জাকের কিছু খুব ঘনিষ্ঠকর্মী খুব ঘনিষ্ঠ বন্ধু হবার কারণে নেতার তেমন গোপন ডেরায় নিয়ে যেতেন। একজন তারকা রাজনীতিককে খুব কাছে থেকে দেখায় বাড়ত মুগ্ধ উপলব্ধি। বাঙালির মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম কিংবদন্তি। অথচ কি নিরহংকার, সাদামাটা! এরশাদবিরোধী আন্দোলনে তার খুব কাছের একজন শহীদ হন । রাউফুন বসুনিয়া। ডা. জাহাঙ্গির সাত্তার টিংকু, মোজাম্মেল বাবু, ইউসুফ হাসান, আনিসুল হক, তারিক সুজাত, নুরুল ফজল বুলবুল, ওহিদুজ্জামান চান, আব্দুর রাজ্জাক সহ আরও অনেকে তখন তার বিশেষ ঘনিষ্ঠ-বিশ্বস্ত। এমন কত যে দক্ষ সংগঠক, একনিষ্ঠ কর্মী-সংগঠক-নেতা গড়ার কারিগর জননেতা আব্দুর রাজ্জাক!

বাকশাল থেকে আওয়ামী লীগে ফিরে এ দলের অনেক নেতার ভিড়ে হারিয়ে যাননি আব্দুর রাজ্জাক। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে শহীদ জননীর আন্দোলনের অন্যতম সংগঠক হিসাবে প্রতিদিনই মিছিল-মিটিংয়ের অগ্রভাগে ছিলেন। এই আন্দোলনকে কেন্দ্র করেও মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সাংবাদিকদের সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠ যোগাযোগটি আরও বাড়ে। প্রগাঢ় হয়। । শহীদ জননীকে আমরা ডাকতাম আম্মা। তিনি ডাকতেন জাহানারা আপা। সফেদ সাদা পাজামা-পাঞ্জাবির সঙ্গে মুজিবকোট। চির সাদামাটা, সদালাপী। অধূমপায়ী। সারাক্ষণ সবার সুখদুঃখের খোঁজখবর রাখা, প্রয়োজনে সমাধান দেয়া, এসব ছিল তার দৈনন্দিন কার্যসূচিভুক্ত। পাশাপাশি শরীয়তপুরের নির্বাচনী আসন থেকে ধারাবাহিক জিতে আসছিলেন। আওয়ামী লীগের নানা ঝড়ঝঞ্ঝায় এ দলের অনেক নেতা মাঝে মাঝে হারলেও হারের রেকর্ড তার ছিল না। আওয়ামী লীগের গত মেয়াদে পানিসম্পদ মন্ত্রী হন। তার মেয়াদে স্বাক্ষরিত হয় গঙ্গার পানি বণ্টন চুক্তি। অনেক কিছুর সঙ্গে সাফল্যের এ পালকটিও তার।

১/১১’র পর তার নাম হয় সংস্কারবাদী! আওয়ামী লীগ-বিএনপির অনেক নেতা দলীয় সংস্কারের কথা বলেছেন সত্যি। কিন্তু বিএনপিতে যেমন সাইফুর রহমান, মেজর (অবঃ) হাফিজের নেতৃ্ত্বে আলাদা দল হয়েছে আওয়ামী লীগে কি তা হয়েছে? সারা দুনিয়ার রাজনীতিতে সংস্কার একটি চলমান প্রক্রিয়া। যুগের চাহিদায় মানুষের প্রয়োজনে, দাবিতে চলে সংস্কার। বাংলাদেশে তা একটি গালি! স্বল্পশিক্ষিত একদল দল-কানা দলের সংগ্রামী নেতাদের সংস্কারবাদী বলে গালি দেয়! এমন ধৃষ্ট-বেয়াদবরা যে দলে এখন প্রকাশ্যে কিলবিল করে, দেশের মানুষ তাদের কাছে কী আশা করতে পারে? আব্দুর রাজ্জাকরাও ছিলেন ছাত্রলীগের সৃষ্টি, ঐতিহাসিক কাণ্ডারি, আজকের ছাত্রলীগ তো আব্দুর রাজ্জাকদেরটা না। এটি তো সুবিধাবাদী বেয়াদবদের ভাগাড়! সংগঠনের ইতিহাস, নীতি-আদর্শ কিছুই এরা জানে না। বা জানা লাগে না। জানে টেন্ডার আর একটি স্লোগান! নেত্রী আ-আ-ছে-ছে, কোন সে নেত্রী----! আব্দুর রাজ্জাকদের এরা কী জানবে, মানবে! আওয়ামী লীগের কী অমঙ্গল চেয়েছিলেন আব্দুর রাজ্জাক? তাদের সংস্কার চিন্তাকে  অপাংক্তেয় পদদলিত করাতে এ দলটির মঙ্গল না অমঙ্গল হয়েছে? দেশের আজকের পরি্স্থিতি কী বলে? আবুল, শাজাহান, ফারুক খান এসব কী মডেল চরিত্র অর্ধশত বছরের পুরনো আওয়ামী লীগের? এসব সুযোগ সুবিধাবাদী রাজনীতিকদের পদায়নের বিন্দুমাত্র আভাস পেলে গত নির্বাচনে এ দলটিকে মানুষ কি এভাবে পাগলের মতো ভোট দিত?

গত সেপ্টেম্বর থেকে আব্দুর রাজ্জাক লন্ডনের হাসপাতালে আছেন। তার কী কী সমস্যা চলছিল তা মোটামুটি মিডিয়ায় এসেছে। গত সেপ্টেম্বর থেকে কতবার লন্ডন গেছেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম? পররাষ্ট্রমন্ত্রী দীপু মনিসহ সরকারের নেতা-মন্ত্রীরা কতবার গেছেন লন্ডনে? বা শেখ রেহানা তার হাসপাতাল থেকে কত দূরে থাকেন? আব্দুর রাজ্জাককে একবার তারা দেখতে যাবার প্রয়োজন মনে করেছেন? বাংলাদেশের হাইকমিশনার কেন যাননি বা কে নিষেধ করেছেন? শেখ হাসিনা? নিষেধ করে থাকলে বলুন, না করে থাকলেও বলুন। দেশের মানুষের এসব জানার দরকার-অধিকার আছে। আর আব্দুর রাজ্জাক তো মান্নান ভূঁইয়ার মতো বহিষ্কৃত কোনো নেতা নন। খালেদা জিয়ার মতো শেখ হাসিনাও সমান নিষ্ঠুর, তা তো ভাবতে চায়নি কেউ! তিনি আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য। জাতীয় সংসদের পানিসম্পদ বিষয়ক সংসদীয় কমিটির সভাপতি। তার মাপের একজন জাতীয় নেতা হাসপাতালে পড়ে আছেন, আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক, সরকারের চাকুরে হাইকমিশনার  নিষ্ঠুর, আমানবিকের মতো একবারও দেখতেও গেলেন না কেউ; এসব কিন্তু ভালো নজির হলো না। পত্রিকায় এসেছে প্রধানমন্ত্রী তাকে সহায়তার ব্যাপারে আশ্বস্ত করেছেন। কী সেই সহায়তা তাও জানল না কেউ। কারণ লন্ডনের হাসপাতালের খরচ মেটাতে দেশে তার সব জমিজমা সম্পদ  বিক্রি বা ব্যাংকে বন্ধক দিতে হয়েছে।

বাংলানিউজে তার অবস্থার সর্বশেষ খবর পড়ে ভয় বেড়েছে।   চোখ ভিজেছে জলে। ক্রোধও হয়েছে। সবশেষ খবর ডাক্তাররা তার আশা একরকম ছেড়েই দিয়েছেন। যার যার ধর্মমত দোয়া/প্রার্থনা করতে বলেছেন। যদি তাই হয় তাহলে তো আমরা নিষ্ঠুরের মতো আরেক বার অপেক্ষা করতে পারি (দুঃখিত)। তার জন্য সরকারি-রাষ্ট্রীয় কান্নাকাটির অপেক্ষা। রাষ্ট্রপতি-প্রধানমন্ত্রী বার্তা দেবেন। সে জন্যে অভিধান-শব্দকোষ খুঁজে সবচেয়ে উত্তম শব্দসমূহ সংগ্রহ করে রাখা হয়েছে কী? না আরও গবেষণার বাকি আছে? তার মুক্তিযুদ্ধ, আওয়ামী লীগ-দেশের জন্য তার ত্যাগ-তিতিক্ষার অনন্যসাধারণ সব বর্ণনা-বন্দনা! যেসব পড়ে আমরা যাতে বিমোহিত কাঁদতে পারি অঝোর? এরপর নানান বাহারি কর্মসূচিতে সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় সম্মানসহ একটি স্মরণীয় শেষকৃত্য। কয়েকদিন ধরে শুধু শোক আর স্মরণসভা। কেন্দ্রীয় শহীদমিনার থেকে শুরু করে বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলনকেন্দ্রে!

আমাদের ক্ষমা করে দিও হে মুক্তিযুদ্ধের নেতা, প্রিয় রাজ্জাক ভাই। চোখের জলে শুধু লিখব তোমার নাম, জয়গান।

ফজলুল বারীঃ সিডনি প্রবাসী সাংবাদিক।

বাংলাদেশ সময়: ১০৩৪ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২২, ২০১১

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।