ঢাকা, মঙ্গলবার, ১৬ পৌষ ১৪৩১, ৩১ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৮ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

মুক্তমত

খালেদা জিয়ার কবুল!

ফজলুল বারী, কন্ট্রিবিউটিং এডিটর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৭৪৪ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২৯, ২০১১
খালেদা জিয়ার কবুল!

বুধবার ঢাকায় খ্রীষ্টান সম্প্রদায়ের সঙ্গে বড়দিনের শুভেচ্ছা বিনিময়ের সময় খালেদা জিয়ার বলা একটি কথায় চোখ পড়ল। বিএনপি চেয়ারপার্সন সেখানে বলেছেন, ‘বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিতে তারা (আওয়ামী লীগ) এত ঝানু যে, আমরা তাদের সাথে কোনও কিছুতেই পেরে উঠি না।

কোনও দিন পেরে উঠবও না। ’

এটা কী গত ১৮ ডিসেম্বর ঢাকায় আত্মঘাতি একটি পরিস্থিতি সৃষ্টির যে চেষ্টা হয়েছিল পরোক্ষভাবে সেটিরই কবুল অথবা দায় স্বীকার? এমন চেষ্টা ব্যর্থ হলে কিন্তু কেউ দায়দায়িত্ব স্বীকার করে না। সফল হলে নাম দেয় ‘বিপ্লব’! ‘যে যা করেন তার একটি সুন্দর পরিণতি সকলের কাছে প্রশংসিত হয়, ব্যর্থ হলে বদনামের শেষ থাকে না’। এমন রোমান্টিক বিপ্লব স্বপ্নের কী পরণতি ঘটতে পারে সে অভিজ্ঞতা আমাদের রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে জাসদের তা ঢের আছে। জিয়াউর রহমানকে সামনে রেখে তেমন একটি বিপ্লবের ছক এঁটেছিলেন কর্নেল তাহের। সে বিপ্লব আত্মস্মাৎ করে জিয়া হয়ে যান সর্বেসর্বা! আর সেদিন বন্দুকের নলের নিচ থেকে তার জীবন রক্ষাকারী তাহেরের কপালে জোটে ফাঁসির দড়ি! স্বাধীনতার পর হঠাৎ উল্কার মতো উঠে আসা রাজনৈতিক দল জাসদকে পিষে নিচে ফেলে দিয়ে উত্থান ঘটানো হয় বিএনপির।

১৮ ডিসেম্বরের ঘটনা, ঢাকাকে তাহরির স্কোয়ার বানানোর স্বপ্নের রূপকল্প নিয়ে গত কয়েকদিন বিএনপির কিছু সূত্রের সঙ্গে টেলিফোনে কথা হয়েছে। বিদেশে থাকার কিছু সুবিধা আছে। পরিচিত রাজনৈতিক সূত্রগুলোর সঙ্গে ফোনে কথা বলতে গেলে কুশল বিনিময়, দেশে আসেন না কেন, কবে আসবেন, এসব কথাবার্তার ফাঁকে আন্তরিক আরও যেসব কথাবার্তা বলেন, দেশে থাকলে হয়ত এভাবে বলতেন না। কিন্তু সমস্যা যে সেখানেই—নাম প্রকাশ না করা শর্তে! এমন একাধিক সূত্রের বক্তব্য ১৮ ডিসেম্বরের ওই পরিকল্পনা বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব সহ আরও গুরুত্বপূর্ণ অনেক নেতা জানতেন না। ওই রূপকল্পের অংশ হিসাবে শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস, বিজয় দিবসে খালেদা জিয়া কোনও বক্তব্য দেননি। এমনকি দলীয় আলোচনা অনুষ্ঠানেও যাননি। খালেদা জিয়াকে বোঝানো-পড়ানো হয়েছিল দেশের মানুষজন সরকারের ওপর এত বিরক্ত-ক্ষিপ্ত যে মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে একবার প্রেসক্লাবের কাছাকাছি বসে  পড়তে পারলে শেয়ারবাজারে ক্ষতিগ্রস্ত লোকজন সহ নানা শ্রেণিপেশার মানুষেরা সেখানে ছুটে চলে আসবে। আর একটা রাত ওভাবে কাটাতে পারলে পুরো এলাকাটি রূপ নেবে তাহরীর স্কোয়ারে!  

সূত্রগুলোর মতে রূপকল্পটির সঙ্গে দলের জামায়াত ঘনিষ্ঠ চারের অধিক নেতা আর বিএনপিপন্থী একাধিক সাংবাদিক জড়িত। এরশাদ বিরোধী আন্দোলনের সময়কালীন সিপিবি অফিসের মতো প্রেসক্লাবকে স্বপ্নের বিপ্লবের আন্দোলনের কেন্দ্র হিসাবে ব্যবহারের প্রতিশ্রুতি তারা দেন। সরকার যেভাবে তারেক-কোকো আর জিয়া চ্যারিটি মামলাগুলোর বিষয়ে দ্রুতগতি নিয়েছে সে ক্রোধ অথবা হতাশায় খালেদা জিয়া এতে সায় দেন। সে কারণে সরকারকে ফেলে দিতে আর কোনওভাবেই তিনি পরবর্তী নির্বাচন পর্যন্ত অপেক্ষায় রাজি না। কিন্তু সূত্রগুলোর মতে বিএনপিতো কোনও বিপ্লবী দল না বা এর নেতাকর্মীরাও বিপ্লবী ঘরানার না, সে কারণে শুরুতেই নানা গড়বড় দেখা দেয়। ঢাকার আশেপাশের জেলাগুলো থেকে নেতাকর্মীদের নিয়ে আসার দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল, তারাও এতে সেভাবে সাড়া দেননি অথবা পরিস্থিতির নিয়ন্ত্রন যেভাবে দ্রুত প্রতিপক্ষের হাতে চলে যাওয়ায় তারা ব্যর্থতার পরিচয় দেন। নারায়ণগঞ্জ থেকে নেতাকর্মীরা যেভাবে আসছিলেন, অন্য কোথাও থেকে সেভাবে চেষ্টাও করা হয়নি।

 সুত্রগুলোর মতে ঢাকার প্রবেশপথগুলোতে যাদেরকে মুক্তিযোদ্ধাদের অভ্যর্থনার দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল তারা উল্টো খুচরো কিছু কথা কাটাকাটির সূত্রে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়িয়ে প্রথম ভুল করেন। এদের কেউ কেউ বিপ্লবের রূপকল্প নিয়ে আধাআধি তথ্য অথবা ধারণা নিয়ে মনে করেছিল পুলিশের সঙ্গে মারামারিটাই বুঝি বিপ্লব! অথবা এভাবে ঢাকার প্রবেশমুখগুলোতে এমন একটি উত্তাল অবস্থা সৃষ্টি করা গেলে তা ঢাকা অবরোধের মতো অবস্থার সৃষ্টি করবে! আর এমন অবস্থা চলতে থাকলে ইঞ্জিনিয়ার্স ইনষ্টিটিউশন থেকে প্রেসক্লাব এলাকায় মুক্তিযোদ্ধা, নেতাকর্মী, জনতার একটি দখল শুরু হয়ে যাবে। সেখান থেকে সৃষ্টি হবে লাগাতার অবস্থানের আবহ। কিন্তু শুরুতেই প্রচন্ড আঘাত শুরু করে দিয়ে সব পরিকল্পনা ভেস্তে দেয় র্যাব-পুলিশ। এভাবেই তাহরির স্কোয়ার স্বপ্নের বিপ্লবের রূপকল্প শুরুতেই পণ্ড হয়, ভেস্তে যায়! সূত্রগুলোর ধারণা, দলের ভিতর কেউ না কেউ বেঈমানি করে পুলিশ-র‌্যাবের কাছে তথ্য ফাঁস করেছে। অথবা ১৮ ডিসেম্বর যারা ঘটনা শুরু করেছে তাদের মধ্যে সরকারি এজেন্ট ছিল। এসব নিয়ে দলে অভ্যন্তরীণ তদন্ত হবারও তথ্য দিয়েছে সূত্রগুলো।
 
দলের নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনের লোকজন অন্তর্ঘাতের রূপকল্পে বিক্ষুব্ধ। এইপক্ষ মনে করেন এতে করে সিলেট-খুলনা রোডমার্চের সাফল্য ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সরকারি নানা ব্যর্থতায় ক্ষুব্ধ মানুষজনের বিএনপির প্রতি সহানুভূতি।   কিন্তু খালেদা জিয়ার সামনে তারা এসব ক্রোধ প্রকাশের সাহস পাননি। অথবা খালেদা জিয়ার কাছে বার্তা চলে যাবে ভয়ে তারা এসব প্রকাশ্যে বলছেনও না। কিন্তু এটি যে দলের প্রচণ্ড ক্ষতি করেছে, প্রায় ৭ হাজার নেতা-কর্মী নতুন করে মামলার খড়্গের মধ্যে পড়েছেন, এ উপলব্ধি দলে লুকোচাপা নেই। বিএপির পক্ষে অফিসিয়েলি অবশ্য বলা হয়েছে বিএনপি একটি নিয়মতান্ত্রিক দল। চোরাগুপ্তা হামলার বিষয়টি সরকারি রটনা। বুধবারের বক্তৃতায় খালেদা জিয়া বলেছেন, ‘বিএপি কোনও নিষিদ্ধ ঘোষিত দল নয়। বিএনপি যা কিছু করে জনগণকে জানিয়ে করে। চট্টগ্রাম রোডমার্চ থেকে আন্দোলনের নতুন কর্মসূচি ঘোষণা করা হবে। ’ কিন্তু এসব কথা যত বলা হচ্ছে এজেন্সি রিপোর্টিং মতো লেজের দিকে চলে আসছে ১৮ ডিসেম্বরের ব্যর্থ বিপ্লবের রূপকল্পের সারসংক্ষেপ।
 
ফজলুল বারীঃ সিডনিপ্রবাসী সাংবাদিক

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।