আজকের প্রশ্ন হলো হুসাইন আজাদ কি একজন কবি? তার ‘অক্ষত আয়না’ কি একটি কবিতার বই? কিন্তু তার চেয়েও বড় প্রশ্ন-এ প্রশ্নের সুরাহা করার আমি কে? তৃতীয় প্রশ্নে আমি একজন পাঠক। কোনো কোনো কবির কাছে পাঠক নারায়ণ আবার কোনো কোনো কবির কাছে পাঠক মুর্খ-দেবতা।
সে যা-ই হোক, জীবনানন্দের আসন অক্ষত রেখে যদি একজন ‘কবির আবেগোত্থিত অনুভূতির বিন্যাস’এর দিকে তাকাই তবে ’অক্ষত আয়না’ এ কবিতা-অন্তঃপ্রাণ পাঠক হৃদয়ের অনুভূতিকে নাড়া দিতে পেরেছে। আমি কবিতা পড়ি, তবে নিয়মিত নই। বোদ্ধাতো নই-ই।
হুসাইন আজাদ কবিতার মহাকালকে বিশ্বাস করেন। যে কবি মহাকালকে বিশ্বাস করেন তিনি আসলে নিজেকে মহাকালের গর্ভেই সমর্পণ করেন। তাই তিনি শুধু সৃষ্টি করে যান। কবি বলেছেন, ‘সময় তোমার গায়ে এতো রঙ/কোথা থেকে নাও ভাসিয়ে কোথা/সুখের গাছে ভাঙো গড়ো টঙ/জীবন কেনো এমন খরস্রোতা’। কবি জীবনের রং বিন্যাসে বিশ্বাস করেন, বিশ্বাস করেন জীবনের খরস্রোতা প্রবাহকে। সেখানে উজান আছে, ভাটি আছে। কিন্তু সব ছাড়িয়ে যা আছে তা হলো জল-সাগরের দিকেই যার অভিযাত্রা। কবি বিশ্বাস করেন জীবনও তাই। মহাকালের দিকেই তার অভিযাত্রা। সেখানে ভুল আছে, আছে নানা বাঁক। তবুও যেতে চাই বহুদূর। তাই কালের আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে কবি নিজেকেই নিজে প্রশ্ন করেন, ‘ঘুম আসে না প্রতি পদে ভুল/ওপার সুরুজ যায় উদয়ে কবে/ভুল-নদীতে সাঁতরে ভুলি কূল/সময়! এমন রঙের কিবা হবে?’ কবি তার প্রথম কবিতাতেই জীবনের সব ভুল গুলোকে স্বীকার করে নিচ্ছেন। ‘অক্ষত আয়না’ও তো তার জীবনেরই এক সৃষ্টি। তবে কি কবি এভুলও স্বীকার করে নিচ্ছেন? কবি যদি সত্য বলে থাকেন, তবে এখানেই খুঁজে পাই ‘কবি হুসাইন আজাদ’কে। কারণ, ‘প্রতিটি সত্য শব্দই কবিতা’। কবির জন্ম হয় সত্যের মাঝে, বেঁচেও থাকেন সত্যের মাঝে। সে সত্য তিনি যা বিশ্বাস করেন, মান্য করেন, পালন করেন তাই-ই।
পাঠক কবির কাছ থেকে সেই সত্যকেই জানতে চান। যে সত্য পাঠকের কাছে উদ্ভাসিত নয়, সে সত্যকে কেবল কবিই পারেন সাধারণের কাছে তুলে ধরতে। আমরা অধমরা যে আধারে আকুল হই, পথ হারাই, কবি সে অন্ধকারের মাঝেই আলোকের সন্ধান করেন। কবির কাছে তাই কালো আর আলো দুই ভিন্ন রং মাত্র। এর বেশি কিছু নয়-দুইয়ে মিলেই জীবন। হুসাইন আজাদ সেই জীবনের রংকেই তুলে ধরেছেন তার কবিতায়। এখানে জীবন আছে, মরণ আছে, প্রেম আছে, আছে বিরহ, প্রকৃতি, দু:খ-বেদনা। সব মিলেই তো জীবন।
হুসাইন আজাদ তার কবিতা নিয়ে চিন্তিত নন। তিনি পাঠককে সতর্ক করেছেন এই বলে, ‘এই কবিতা হঠাৎ দেখার, এই কবিতা ঘোরের/এই কবিতা ঝড়ে এলো-মেলো হৃদয়পুরের/এই কবিতা নজর-দূরের তারচে’ বুকের মাঝের/এই কবিতা স্বপ্নবোনা সকাল-দুপুর সাঁঝের’। কবি বলছেন যে তার কবিতা ঘোরের হতে পারে অথবা এলো-মেলো শব্দযুগলমাত্র-কিন্তু তারপরও এ কবিতা তার হৃদয়পুরের, তার বুকের কাছের। এখানে কবি কবিতার মহাকালকে যেমন বিশ্বাস করেন, তার চেয়েও বেশি আস্থা রাখতে চান তার হৃদয়ের অব্যক্ত শব্দমালাকে; যা শুধু কবিই শুনতে পারেন। আর শুনতে পান তারা, যারা শুনতে চান। যারা না বুঝেও, না শুনেও কবিতার একাডেমিক অন্তর্জালে নিজেকে জড়িয়ে রাখেন কবি তাদের ব্যাপারেও সজাগ। তাই আবার তিনি বলেন, ‘ম-তে যারা মিশর বোঝো/সুযোগ মতো ‘মন’/সব বুঝেও বুঝবে না ‘ধূর’/এই করেছো পণ?”। কবি সব জেনেই সৃষ্টি করে যান, বলে যান তার হৃদয়ের প্রতিটি সত্য শব্দ---কবিতা।
সৃষ্টিতেই যেনো কবির সব আনন্দযজ্ঞ। এখানে কবির পেছনে অথবা সমুখে তাকানোর সুযোগ নেই। তিনি সৃষ্টি সুখের উল্লাসে মাতোয়ারা হয়েই ব্যক্ত করে যান তার হৃদয়ের অব্যক্ত শব্দমালা। তিনি জানেন, ‘অক্ষত আয়না’ তার প্রথম পদক্ষেপ। ভবিষ্যতে তার এ আয়না অক্ষত থাকবে, না-কি কবিতার অ্যানাটমিতে হয়ে যাবে ক্ষত-বিক্ষত, তা নিয়ে কবি বিমর্ষ নন। তাই কবি বলে যান, ‘হাঁটতে হবে অনেকটা পথ/গুনতে হবে তারা/ভাগ্য কৃপায় রোপণ হবে/সুখ সবুজের চারা। ’ অনেকটা পথ তাকে যেতে হবে, সৃষ্টি করতে হবে অনেক। কিন্তু অবশেষে কবি সেই নিয়তির কাছেই নিজেকে সপে দিয়েছেন। কবি এখানে সাফল্যে (Success) বিশ্বাস করেন না। কারণ, সাফল্যতো একটি বৈষয়িক ব্যাপারমাত্র। সেখানে কে কবি হলো আর কে হলো না, কোনটি কবিতা অথবা কোনটি না- এরকম আরো কত শত প্রশ্ন। কিন্তু কবিতো বিশ্বাস করেন তার হৃদয়ের একান্ত শব্দমালাকে যা তিনি সত্য বলে বিশ্বাস করেন। তাই কবি বিশ্বাস করেন সার্থকতায় (Fulfillment)। কারণ, তিনি হৃদয়ের কথা বলিতে ব্যাকুল এক কবি। কেউ শুধাক আর না-ই শুধাক। এখানেই তার পূর্ণতা, সার্থকতা অথবা Fulfillment ।
সৃষ্টিই তার কাছে প্রেম, অথবা প্রেমই তার কাছে সৃষ্টি। এ প্রেমে তিনি হয়তো কখনো একাই কৃষ্ণ। কবিতাই তার কাছে কৃষ্ণলীলা। প্রেমের এ মিছিলে তার পাঁজড় ভাঙছে, চাপা ব্যথা কলজে টেনে ধরছে- তবুও তিনি প্রেমে মশগুল এক কবি। তিনি এক অনুভূতির সওদাগর। তার সব কবিতায়ই নানা অনুভূতির প্রকাশ হয়েছে; বিকাশ হয়েছে। কখনো তিনি প্রেমাতুর, কখনো তিনি প্রকৃতির প্রেমিক, আবার কখনো তিনি দুঃখ-বিলাসী এক ভবঘুরে। এসবই মানব-জীবনের নানারূপ ও বৈচিত্র। মানুষ বিরহের মাঝে যেমন প্রেম খোঁজে, তেমনি প্রেমের মাঝেও বিরহ খোঁজে। কভু সে দুখের মাঝে সুখ আবার কখনো বা সুখের মাঝেও দুঃখ যাচে। মানুষের কতো রূপ, কতো বৈচিত্র্য!
এ কবি প্রেমিক। কিন্তু প্রেম নিয়ে তার দহনজ্বালাও কম নয়। এ দহনজ্বালায় কবি কখনো নিজে জ্বলেন কখনো জ্বালান তার প্রেয়সীকে। কিন্তু শেষতক শত জ্বালাও-পোড়াওর মাঝেও কবি তার প্রেমিকাকে রাখতে চান অক্ষত। অক্ষত আয়নায় দেখতে চান প্রেয়সীর মুখ। প্রেমিকা তার শত প্রেমে আকুল, কিন্তু কবি বলেন, ‘মনের পাঠক মন দিয়েছে কেবল তোমায় পাঠে’! কিন্তু কবি এও জানেন, প্রেমিকার রঙিন চশমা যেদিন ভাঙবে, সেদিনও প্রেমের আলোয় উদ্ভাসিত হবে না প্রেমিকার হৃদয়। বরং সেখানে রচিত হতে পারে বড়জোর আরেকটি ব্যর্থ কবিতা!
কিন্তু আমরা জানি, কবির একেকটি ব্যর্থ কবিতা কবি ও কবিতার মাঝে এক সফল প্রেমের পরিণতি। সে প্রেমে পাঠক সিক্ত হবেই। কবির হৃদয় থেকে উৎসারিত গুঞ্জনে কান পেতে যা শুনি- তাতো আমাদেরই জীবন, প্রেম ও প্রকৃতির এক চির-পরিচিত চেহারা। ‘অক্ষত আয়না’য় যা প্রতিবিম্বিত হয়েছে মাত্র, নতুন রূপে, ভিন্ন চেতনায়।
বাংলাদেশ সময়: ১৭২৫ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২৫, ২০১৭
এএ