ঢাকা, রবিবার, ৭ পৌষ ১৪৩১, ২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৯ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

কবিতা

ইরানের কবি ফোরুগ ফারখজাদের কবিতা

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৭২৭ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১৪, ২০১৮
ইরানের কবি ফোরুগ ফারখজাদের কবিতা ইরানের কবি ফোরুগ ফারখজাদের কবিতা

ইরানের আধুনিক ধারার কবি ফোরুগ ফারখজাদকে বিংশ শতাব্দীর নারী কবিদের মধ্যে অত্যন্ত প্রভাবশালী বিবেচনা করা হয়। তেহরানে কবি ফারখজাদের জন্ম হয় ১৯৩৫ সালে। তার পিতা মোহাম্মদ বাঘের ফারখজাদ পেশায় ছিলেন সেনা বাহিনীর কর্নেল। তার জননীর নাম তুরান ভাজিরি-তেবার..

এ দম্পতির সাতটি সন্তানের তৃতীয় ফোরগ স্কুলে নবম শ্রেণী অব্দি পড়াশোনা করে ছবি আঁকা ও সেলাইয়ের কাজ শেখেন। ষোল বছর বয়সে তার বিয়ে হয় বিখ্যাত রম্যরস রচয়িতা পারভিজ শাপুরের সাথে।

এক বছর পর কবি ফারখজাদের কায়মার নামে এক পুত্র সন্তানের জন্ম হয়, যাকে নিয়ে কবি রচনা করেন ‘আ পোয়েম ফর ইউ’ শিরোনামের কবিতাটি। বছর দু’য়েক পর, ১৯৫৪ সালে এ দম্পতির বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটলে কবি তাদের শিশুপুত্র কায়মারকে সাবেক স্বামীর তত্ত্বাবধানে রেখে তেহরান ফিরে গিয়ে কবিতা চর্চায় সম্পূর্ণ আত্মনিয়োগ করেন। ১৯৫৫ সালে প্রকাশিত হয় তার প্রথম কাব্য গ্রন্থ ‘দ্য ক্যাপটিভ’।

কবির কবিতায় নারীবাদের বলিষ্ট প্রকাশ থাকায় তাকে মোকাবেলা করতে হয় নানাবিধ সামাজিক নিষেধাজ্ঞা ও নেতিবাচক সমালোচনার। ১৯৫৮ সালে কবি ইউরোপ ভ্রমণে যান, পরবাসে নয় মাস অবস্থানের দিনগুলোতে তার সাথে সাক্ষাৎ হয় লেখক ও চিত্র নির্মাতা ইব্রাহিম গোলেস্থানের, যিনি কবি ফারখজাদকে তার সহজাত প্রবণতা স্বাধীনভাবে প্রকাশ করতে উৎসাহিত করেন। স্বদেশে ফিরে কবি প্রকাশ করেন ‘দ্য ওয়াল’ ও ‘দ্য রেবেলিওন’ নামে দু’টি কাব্যগ্রন্থ।

এ সময় কবি আগ্রহী হয়ে ওঠেন চলচ্চিত্র নির্মাণের কলাকৌশলে। পরবর্তীতে তিনি তাব্রিজ অ ল সফর করেন এবং কুষ্ঠরোগাক্রান্ত মানুষদের দিনযাপন নিয়ে নির্মাণ করেন একটি চলচ্চিত্র। ১৯৬২ সালে তার নির্মিত ‘দ্য হাউস ইন ব্ল্যাক’ নামক ফিল্মটি অর্জন করে একাধিক আন্তর্জাতিক মানের স্বীকৃতি সূচক পদক। এ চলচ্চিত্রের শুটিংয়ের সময় হোসেইন মানসোরি নামে কুষ্ঠরোগাক্রান্ত এক দম্পতির পুত্র সন্তানের সাথে তার অন্তরঙ্গতা গড়ে ওঠে। পরবর্তীতে বালক মানসোরিকে দত্তক হিসাবে নিয়ে কবি তেহরান ফিরে বসবাস করতে শুরু করেন তার মায়ের বাড়িতে।

১৯৬৩ সালে প্রকাশিত হয় ‘অ্যানাদার বার্থ’ নামে তার একটি দীর্ঘ কবিতা যা আধুনিক ধারার কাব্যকলার সৌধে যুক্ত করে নবতর ভাবনার একটি সুদর্শন মিনার। ১৯৬৭ সালে ১৩ ফেব্রুয়ারি গাড়ি চালনারত অবস্থায় দুর্ঘটনার মুখোমুখি হলে, হাসপাতালে নেওয়ার পথে মাত্র বত্রিশ বছর বয়সে কবির মৃত্যু হয়। তার অন্যতম একটি বিখ্যাত কবিতা ‘লেট আস বিলিভ ইন দ্য বিগিনিং অব দি কোল্ড সিজন’ প্রকাশিত হয় কবির মৃত্যুর পর। প্রকরণের দিক থেকে এ কবিতাটিকে ফার্সি সাহিত্যের আধুনিক কাব্যকলায় অত্যান্ত উচ্চ মার্গের সৃজন হিসাবে বিবেচনা করা হয়ে থাকে। ইরানে ইসলামি বিপ্লবের পর বছর দশেক ফারখজাদের কবিতার প্রকাশ ও প্রচারকে নিষেধাজ্ঞা দিয়ে রুদ্ধ করা হয়।

এখানে কবি ফোরুগ ফারখজাদের পাঁচটি কবিতার ভাষান্তর উপস্থাপন করা হচ্ছে। এ কবিতাগুলো ফার্সি থেকে ইংরেজিতে অনুবাদ করেছেন মরিয়াম দিলমাঘানি। সেখান থেকে ভাষান্তর করেছেন লেখক মঈনুস সুলতান। কবিতা ও কবির জীবনী বিষয়ক প্রাসঙ্গিক তথ্য অন্তর্জালের পোয়েম হান্টার ওয়বসাইট থেকে চয়ন করা হয়েছে।

পাপ
নিমজ্জিত হয়েছিলাম পাপে – যা আনন্দে ছিলো মধুরিম

বাহুতে জড়িয়ে আগুনের সাপ – সাড়া দেই আমি মৃদু ডাকে

শিহরণ ছড়ানো আলিঙ্গনে তার উষ্ণতা ছিলো অপরিসীম

পরশে জাগিয়েছিলো হরষিত ঊর্মি আমার শরীরের বাঁকে।


সে লগন ছিলো গাঢ় আন্ধকার – নির্জন কুঠুরিতে

তাকিয়েছিলাম – চোখ দু’টি ছিলো তার রহস্যময়

অধর্য্য হৃৎপিণ্ড আমার কাঁপছিল প্রত্যাশার শীতে

চাহিদার কুসুমিত ইন্ধনে জেগেছিলে যুগল প্রণয়।


তার পাশে– খুব কাছাকাছি বসেছিলাম আমি

চুল ছিলো আমার এলোমেলো– বস্ত্রাদি অবিন্যস্ত

তার ঠোঁট আমার অধরে খুঁজেছিল অন্তর্যামী

বাসনার সুরায় শরীর হয়েছিলো আমার ব্যতিব্যস্ত।


কানে কানে শুনিয়েছি তাকে ভালোবাসার অমর গাথা

তোমাকে চাই যে আমি– হে প্রিয় আমার নিখিল প্রাণ

জড়াতে চাই আমার শীত শিহরিত দেহে পরশের কাঁথা

তীব্র সংবেদনে তোমাকে দেহমনে করি যে ধ্যান।


গাঢ় বাসনা তোমার চোখে জ্বেলেছিল অনিকেত শিখা

পেয়ালায় নৃত্য করেছিল মদিরা– লোহিতে বর্ণালী

শয্যায় স্পর্শ শিহরে আমার দেহে জ্বলেছিল নীহারিকা

দখিনা হওয়ায় কেঁপেছিলো সহিষ্ণু আত্মার পুষ্পাঞ্জলি।


কম্পমান আমি– দু’পা আমার পড়েছে

পাপের স্ফুর্তিতে ভরপুর পাঁকে

ভাবতেও পারছি না– কে আমাকে গড়েছে

নির্জন কুঠুরিতে জোড়া হাত প্রেমের চিত্র আঁকে।


ইরানি নারীদের প্রতি আহ্বান

ইরানি নারী – শুধু তুমিই থেকে গেছো

অপমানিত জীবনের শিকলে আবদ্ধ

তোমাকে ঘিরে থাকে নিষ্ঠুরতা ও দুর্ভাগ্য সারাক্ষণ

ছুটে বেড়াবে প্রান্তরে– সুবাতাসের দুয়ার তোমার বদ্ধ

হও একরোখা– শক্ত হাতে ছিন্ন করো এ বন্ধন।


ভরসা করো না অঙ্গীকারের মধুচন্দ্রিমায়

জুলুমে করো না কদাপি মাথানত

ঘৃণা, বেদনা ও ক্রোধের হাতিয়ারে সাজিয়ে

নিজেকে করো সমুন্নত।


তোমার সহজাত আলিঙ্গনে উষ্ণ বক্ষ

যা লালন করে অহংকারী উদ্ধত পুরুষকে

তোমার আনন্দিত হাসির ধ্বনি

তার হৃদয়ে ছড়ায় উষ্ণতার সঞ্জীবনী।


পুরুষ– যে আদতে তোমারই সৃজন

তোমার ওপরে তার প্রভুত্ব সত্যি লজ্জাকর

নারী– সক্রিয় হও, নাও উদ্যোগ

পৃথিবী তোমার প্রতীক্ষা করছে

তোমার সুরলহরীতে ভরাতে চায় তার প্রহর।


হামেশা জর্জরিত হওয়া দুর্ভাগ্য ও দাসত্বের প্রহারে

তার চেয়ে তোমার জন্য সুখকর হবে

ঘুমিয়ে থাকা কবরের অন্ধকারে।

কোথায় সে অহংকারী পুরুষ–

বিচরণ করার দিন শেষ হয়েছে তার প্রভুত্বের রাজ্যপাটে

বলো তাকে–দাঁড়াতে নতমস্তকে তোমার কুটিরের চৌকাঠে।


কোথায় সে পুরুষ সিংহ

বলো তাকে তৈরি হতে

কারণ জেগেছে নারীরা রণসাজে

প্রস্তুত হচ্ছে তারা অরুণিম প্রভাতে

সত্যের আলোয় উদ্ভাসিত তাদের শব্দরাজি

তারা আর কখনও ঝরাবে না অশ্রু

দুর্বলতার শিশিরে সাজাবে না পুষ্পসাজি।


উপহার
আমি কথা বলছি গভীর রাতের অন্ধকার থেকে

এ অন্ধকার গভীর.. গভীরতর

আঁধার হাতড়িয়ে যাই আলোরিক্ততার নকশা এঁকে।


যদি আসো আমার গৃহে হে সখা

নিয়ে আসবে একটি বাতি

আর একটি জানালা

যার ভেতর দিয়ে আমি দেখতে পারি

শহরের সুখী সরণীতে মানুষের পথচলা।


তরঙ্গ
আমার কাছে তুমি যেনো এক তরঙ্গ

ভেসে বেড়াও– বহতা স্রোতে খুঁজে নাও সঙ্গ

এখানে তুমি কখনও নও– ওখানেও নও

তোমাকে খুঁজে পাই না আমি আকাশ-জলধি কোথাও।


যখন আসো– সজোরে ধরো হাত

তোমার দিকে টানো–ছলকায় বুকের প্রপাত

তারপর ত্রস্তপদে ছুটে পালাও

মারাত্মক প্লেগের মতো তোমার পরশ

চারদিকে ছড়িয়ে যাও

ভিন্ন এক ভুবনে ঘুরো-ফেরো

এখানে তোমার টিকিটিও যায় না দেখা ফের

কখনও পাই না হদিস তোমার নির্দিষ্ট গন্তব্যের।


চোখের আলোয় তোমাকে করি অবলোকন

কখনও কাছ থেকে– কখনও দাঁড়িয়ে দূরে

বিদ্রোহী ঢেউ এক তুমি

দূরের বাদ্য বাজে তোমার অন্তর্গত সুরে

স্থিতি হতে পারো না কোনো বাহানায়

কেবলই উড়ে বেড়াও তুমি চিরায়ত ডানায়।


অধৈর্য্য তুমি– সদা অশান্ত– তোমার চাহিদা প্রবল

যে প্রান্তরে নেই পথরেখা

সে চরাচরে তুমি ভ্রাম্যমাণ

আমি নিশ্চিত হৃদয়ের গহীনে তুমি অচল

তোমার অনুশোচনা জন্মভূমিকে ঘিরে হয় ঘূর্ণায়মান।

 
ভেসে বেড়াও দিবস ও নিশি

হ্যাঁ, সত্যিই তুমি শাসনমুক্ত এক রাশ ঊর্মিমালা

সময় কোথায় শিকড় ছড়ানোর

যা থেকে গজাবে পত্রালিতে ভরপুর ডালাপালা।

 
কিন্তু কোনো এক নিশিরাতে

তোমাকে পাওয়ার শিহরণে বেহুঁশ

আমি পরে নেবো– সুদূর সমুদ্র সৈকতের

তৃষ্ণায় তৈরি এক মুখোশ

জন্মভূমি থেকে বহুদূরে

জনহীন দ্বীপের বালুকাময় উদ্যানে

তোমার নাগাল পাবো আমি একদিন

যাত্রার প্রস্তুতি নেবো সে ভুবনের সন্ধানে।

 
হয়তো মৃত্যু হবে পাখিটির

বিষণ্ন বোধ করি আমি

গাঢ় বেদনা পুঞ্জীভূত হয় আমার মনে

অন্তরাত্মা ছেয়ে যায়

বেদনার নীলাভ দংশনে।


ঘরের বাইরে গিয়ে আমি

রাত্রির আঁধার-নিঝুম খোলে ঘঁষি

আমার হিম-শীতল আঙুল

ঠাণ্ডা হওয়ায় ওড়ে আমার খোলা চুল

দৃষ্টিসীমায় প্রতিটি বাতি আচ্ছন্ন অন্ধকারে

বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে এদিকে আসার প্রতিটি সড়ক

দাঁড় করানো হয়েছে প্রহরী প্রতিটি দ্বারে।


কেউ আমাকে পরিচয় করিয়ে দেবে না উদিত সূর্যের সাথে

কপোতের জলসায় ডেকে নেবে না কেউ উজ্জ্বল প্রভাতে।


জাগ্রত রাখো মনে উড্ডয়নের বাসনা

হয়তো মৃত্যু হবে পাখিটির

কীটদষ্ট হবে তার শুভ্র ডানা।


বাংলাদেশ সময়: ১৩২৩ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১৪, ২০১৮
এসএনএস

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

কবিতা এর সর্বশেষ