ঢাকা: প্রথমবারের মতো গণতন্ত্রের ভাষায় কথা বললেন স্বৈরাচারের তকমা পাওয়া হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ! শুধু তাই নয়, ভাষা চয়নের ক্ষেত্রেও অনেক সংযমী। এ যেন ভিন্ন এক এরশাদকে দেখলেন দলীয় কর্মীরা!
‘জাতীয় পার্টি মানে এরশাদ, আর এরশাদ মানেই জাতীয় পার্টি’ এটি ছিল এরশাদের একটি কমন বক্তৃতা।
এরশাদের একরোখা নীতির কারণেই মসনদ ছাড়ার পর সবচেয়ে বেশি টানাপড়েনের মধ্যদিয়ে পথ চলতে হয়েছে জাতীয় পার্টিকে। বেশ কয়েক দফায় ভাঙনের কবলেও পড়েছে দলটি। এখন ফের উপনীত ভাঙ্গনের দ্বারপ্রান্তে। বর্তমানে চারটি জাতীয় পার্টি বিদ্যমান। বাংলাদেশে তো বটেই, একটি নামে চারটি দলের অবস্থান বিশ্বেও সম্ভবত বিরল। আর এসব ভাঙ্গাগড়ার সময় ঢাল হিসেবে এরশাদ ব্যবহার করতেন এই বক্তব্য। কিন্তু সেই এরশাদ এবার দল ভাঙ্গনের দ্বারপ্রান্তেও চরম নমনীয়। যাকে শুধু তুলনা করা চলে বাগধারার ‘ভেজা বিড়াল’ এর সঙ্গেই।
অনেকে মনে করছিলেন এবারও হয়তো হুমকি ধামকি দিবেন। কিন্তু সবাইকে অবাক করে দিয়ে তিনি বললেন, ‘জাতীয় পার্টি মানে এরশাদ এ কথা ভুলে যেতে হবে। জাতীয় পার্টি সবার। ’
সোমবার (৮ ফেব্রুয়ারি) রাজধানীর ইমানুয়েলস কনভেনশন সেন্টারে জাতীয় পার্টির যৌথসভায় সভাপতির বক্তব্যে এরশাদ এ কথা বলেন। আর এরশাদের এই বক্তব্যে সারাদেশ থেকে আগত (জেলা ও উপজেলা কমিটির নেতৃবৃন্দ) জাপার নেতৃবৃন্দ একে অন্যের মুখ চাওয়া-চাওয়ি করেন বিস্ময় নিয়ে।
অথচ যৌথসভার শুরুতে স্বাগত বক্তব্যে জাতীয় পার্টির মহাসচিব এবিএম রুহুল আমিন হাওলাদার বলেছিলেন, ‘এরশাদ মানে জাতীয় পার্টি, জাতীয় পার্টি মানে এরশাদ।
এরশাদের এমন বক্তব্যে অবশ্য পরে অবাক হয়ে তার দিকে তাকিয়ে থাকেন হাওলাদার।
এর আগে দলের যে কোন সংকটের সময় হুমকি ধামকি দিয়ে নেতাকর্মীদের বাগে আনার চেষ্টা করতেন এরশাদ। এর আগেও নির্বাচন পরবর্তী সময়ে সংসদ সদস্যদের রওশন এরশাদের সঙ্গ ছেড়ে তার সঙ্গে আসার জন্য অনেক হুমকি ধামকি দিয়েছিলেন। যদিও কোনই কাজে আসেনি তার আষাঢ়ে গর্জন।
হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ একাধিক সভায় প্রকাশ্য বলেছিলেন, ‘যারা আমার অনুষ্ঠানে আসছে না তাদের বিষয়ে কঠোর শাস্তি অপেক্ষা করছে। আগামী নির্বাচনে লাঙ্গল পেতে হলে আমার কাছেই আসতে হবে। লাঙ্গল দেওয়ার মালিক একমাত্র আমি। আর কারো ক্ষমতা নেই। ’
অথচ কথায় কথায় বহিষ্কার আর অব্যাহতি যার অস্থিমজ্জায় জড়িয়ে আছে সেই এরশাদের সভা আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দিয়ে বর্জন করলেন মন্ত্রিসভার সদস্য ও জাতীয় পার্টির সংসদ সদস্যরা। কিন্তু তাদের উদ্দেশ্যে কিছুই বললেন না সোমবার। দিলেন না কোন হুমকি ধামকিও।
সহধর্মিনী যাকে বিভিন্ন কারণে এর আগে বহিষ্কার পর্যন্ত করেছিলেন সেই রওশন এরশাদ এবার ডাক দিয়ে তার সভা বর্জন করলেন। কিন্তু বক্তৃতায় সে প্রসঙ্গে কোনো কিছু বলার ধার দিয়েও গেলেন না এরশাদ।
এর আগে পার্টির ভবিষ্যত কর্ণধার প্রসঙ্গে এরশাদ বলেছিলেন, ‘আমার বয়স হয়েছে, আমি আর বেশি দিন নেই। তাই ছোট ভাইকে ভবিষ্যত কর্ণধার ঘোষণা করেছি। ’
এরশাদের ওই ঘোষণার পর রওশন এরশাদকে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান ঘোষণা করে রওশনপন্থিরা। পরে তারা রওশন এরশাদকেও এক নম্বর কো-চেয়ারম্যান করার দাবি তোলেন।
সোমবারের সভায় বক্তৃতা দেয়ার সময় এই দাবির বিষয়েও অনেক সংযত হয়ে জবাব দিলেন এরশাদ। কারো নাম উল্লেখ না করে এরশাদ এদিন বলেন, ‘আমার স্থলে আসতে চান। তাদের উদ্দেশ্যে বলছি, তাদেরও বয়স হয়েছে। নতুন প্রজন্মের হাতে ক্ষমতা দিন। ’
এতোদিন যে এরশাদ আমিত্বের বড়াই করতেন। গর্জন করে বলতেন,‘আমি এটা করেছি। আমি ওটা করেছি। আমি জাতীয় পার্টি গঠন করেছি। জাতীয় পার্টিকে এতোদূর নিয়ে এসেছি, ইত্যাদি ইত্যাদি। ’ সেই এরশাদ আজ বললেন, ‘আজকে দলের যে অবস্থান তাতে আমার কোন কৃতিত্ব নেই। সব কৃতিত্ব কর্মীদের। কর্মীরাই দলকে এতোদূর নিয়ে এসেছে। ’
যে এরশাদ এতদিন কারও সমালোচনা সহ্য করতে চাইতেন না। কেউ নিজের থেকে বলতে এলে তাকে থামিয়ে দিতেন। এমনকি সভায় সমালোচনার কারণে লাকসাম উপজেলার সভাপতিসহ বেশি কিছু নেতাকে বহিষ্কার পর্যন্ত করেছিলেন। সেই এরশাদ এবার তার বক্তৃতায় বললেন, ‘আমরা অতীত ভুলে সামনের এগিয়ে যেতে চাই বীরবিক্রমে। আমি প্রত্যেকের কথা শুনতে চাই। আমার যদি কোন ভুল থাকে তাও শুনতে চাই। আপনাদের সবার কথা শুনবো। যতক্ষণ সময় প্রয়োজন হয় থাকব।
এরশাদের এই বক্তব্য শেষে এক নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বাংলানিউজকে জানালেন, স্যার(এরশাদ) বড্ড দেরি করে উপলব্ধি করলেন। এমন সহনশীল হলে দেশে চারটি জাতীয় পার্টির জন্ম হতো না। মনে হয় কোন প্যাচে পড়েছেন। না হলে এমন নমনীয় হওয়ার লোক নন তিনি।
যে লোক নিজের স্ত্রীকে পর্যন্ত বহিষ্কারে দ্বিধাবোধ করেননি সে লোক এতো নমনীয় হবেন এমনটা ভাবা যায় না। মনে হয় বেকায়দায় পড়েছেন, বেকায়দা দূর হলে আবার স্বরূপে উন্মোচিত হবেন। তবে তার এই উপলব্ধি যদি স্থায়ী হয় তাহলে জাতীয় পার্টি টিকে থাকবে। না হলে এরশাদের মৃত্যুর পর জাতীয় পার্টি নাম সর্বস্ব হয়ে পড়বে বলেও মন্তব্য করেন ওই নেতা।
তিনি বলেন, এখনও সময় আছে সবাইকে নিয়ে দলকে সংগঠিত করার। তা না করে বহিষ্কার বা অব্যাহতি দিয়ে জাতীয় পার্টিকে সংগঠিত করা যাবে না। শুধু কর্মী দিয়ে দল হয় না। নেতার প্রয়োজন হয়। যারা পথ দেখিয়ে এগিয়ে নিয়ে যান। যার বড়ই অভাব জাতীয় পার্টিতে। যে কারণে বেঈমান হিসেবে চিহ্নিত এবিএম রুহুল আমিন হাওলাদারকে মহাসচিব করতে বাধ্য হয়েছেন তিনি।
তৃণমূলের ওই নেতার কথার সুর ধরে এক জেলা নেতা বলেন, যৌথসভা ডেকেছেন। কিন্তু মন্ত্রিসভায় তিন সদস্য কেউই সভায় উপস্থিত হননি। চল্লিশজন সংসদ সদস্যের মধ্যে উপস্থিত হয়েছেন মাত্র চারজন (তিনিসহ)। তারা যে ব্যক্তিগত ব্যস্ততার কারণে হাজির হননি তেমনটি কিন্তু নয়।
তারা আগেই দিনই ঘোষণা দিয়ে অনুপস্থিত রয়েছেন। উল্টা-পাল্টা করলে তার (এরশাদ) সাধের লাঙ্গল হাতছাড়া হয়ে যেতে পারে। সেই ভয় পেয়ে বসেছে। সে কারণে লেজের দিকে মাথা করেছেন হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। এমন মূল্যায়ন সিনিয়র নেতাদের।
এরশাদের ডাকা এই যৌথসভাকে অনেকটা ফ্লপ বলা চলে। বলতে গেলে সিনিয়র প্রেসিডিয়ামের সদস্যরা কেউই উপস্থিত হননি। প্রেসিডিয়ামের ৪১ জন
সদস্যের মধ্যে মাত্র ১৬ জন উপস্থিত হন। তাদের বেশিরভাগই নবীন মুখ। সিনিয়রদের মধ্যে জিএম কাদের, আব্দুস সাত্তার, সোহেল রানা ও গোলাম কিবরিয়া টিপুকে দেখা গেছে।
এছাড়া মন্ত্রী এমপিদের পথ ধরে সভায় অনেক জেলার কোনো নেতাকর্মী যোগ দেননি। কক্সবাজার, বগুড়া, সুনামগঞ্জ সহ আরও বেশ কয়েকটি জেলার কোনো প্রতিনিধি সভায় যোগ দেননি বলে জানিয়েছে সভায় উপস্থিত একটি সূত্র।
বাংলাদেশ সময়: ১৯৫০ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ০৮, ২০১৬
এসআই/আরআই